ব্রিকসের এনডিবি’তে সদস্যপদ পেল বাংলাদেশ
ব্রিকস ব্যাংক বলে পরিচিত নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এনডিবি) সদস্যপদ লাভের মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্য বৈদেশিক অর্থ সহায়তার নতুন আরেকটি উৎস উন্মোচিত হয়েছে।
উদীয়মান অর্থনীতির পাঁচ দেশ; ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার জোট- ব্রিকস। প্রতিষ্ঠাকালীন মূল পাঁচ সদস্য দেশের বাইরে নতুন করে আরও তিনটি দেশ এনডিবি'র সদস্যপদ প্রথমবারের মতো পেয়েছে, যার মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে।
অন্য দুটি দেশ হলো: সংযুক্ত আরব আমিরাত ও উরুগুয়ে।
এনডিবি'র মোট সম্পদ প্রায় ৫ হাজার কোটি ডলার। এর সদর দপ্তর চীনের সাংহাই নগরীতে অবস্থিত।
তবে নতুন উৎসটি থেকে অর্থ সহায়তা পেতে বিনিয়োগ উপযোগী (ব্যাংকেবল) প্রকল্প প্রণয়নের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন অর্থনীতিবিদেরা।
গতকাল বুধবার (১ সেপ্টেম্বর) এক বিবৃতিতে এনডিবি'র প্রেসিডেন্ট মার্কোস ট্রিয়োজো বলেন, "বিশ্বের অন্যতম দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতি বাংলাদেশকে এনডিবি'তে স্বাগত জানাতে পেরে আমরা উচ্ছ্বসিত। স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির বছরে আমাদের সংস্থায় বাংলাদেশের যোগদান একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক অর্জন।"
এনিয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, "স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির স্মরণীয় মুহূর্তে এনডিবিতে বাংলাদেশের সদস্যপদ লাভ অংশীদারিত্বের নতুন সুযোগ সৃষ্টি করলো।"
অর্থমন্ত্রী দ্রুত সদস্যপদ অনুমোদনের জন্য এনডিবি'র গভর্নিং বোর্ডকে ধন্যবাদ জানান।
অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরাও এনডিবি'র সদস্যপদকে বাংলাদেশের জন্য নতুন সুযোগ হিসেবে দেখছেন। তবে ঋণ প্রদানে ব্যাংক উৎসাহী হয় এমন প্রকল্প প্রণয়নের কমতিকে সুযোগটি কাজে লাগানোর মূল বাঁধা হিসেবে উল্লেখ করছেন।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট- এর নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড'কে বলেন, অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগের কমতি থাকায় দেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে এটি সুবর্ণ সুযোগ হতে পারে।
"এআইআইবি তার কার্যক্রম শুরু হওয়ার মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে বিপুল পরিমাণ সহায়তা প্রদান করে। চীন-ভিত্তিক অবকাঠামো ব্যাংকটি কোভিড -১৯ মোকাবিলায় এবং মহামারির বিরূপ প্রভাব থেকে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে উল্লেখযোগ্য সহায়তা প্রদান করেছে। ভারত ও চীন উভয় দেশই এনডিবি'র গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হওয়ায় দু'দিক থেকেই সুবিধাভোগী হবে বাংলাদেশ," যোগ করেন তিনি।
উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার নতুন একটি দেশে কার্যক্রম শুরু করতে যথেষ্ট সময় লাগে বলে উল্লেখ করে তিনি জানান যে, কত দ্রুত তারা কার্যক্রম শুরু করবে, সুবিধার দিকটি তার উপর নির্ভর করছে।
এব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেছেন, "নয়া উদ্যোগটির প্রধান লক্ষ্য টেকসই অবকাঠামো নির্মাণ এবং তারা নিজেদের বিনিয়োগ পোর্টফোলিওর অন্তত দুই-তৃতীয়াংশ পরিবেশবান্ধব সবুজ প্রকল্পে বিনিয়োগ করবে।" তবে এ ব্যাংকের ঋণ পেতে চাইলে যথাযথ বিনিয়োগ উপযোগী (ব্যাংকেবল) টেকসই প্রকল্প পরিকল্পনা প্রণয়ন দরকার বলেও যোগ করেন তিনি।
ড. জাহিদ জানান, বাংলাদেশ এনডিবি থেকে বিনিয়োগ পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে, তবে ঋণ ছাড়করণে দীর্ঘসময় লাগতে পারে। সংস্থাটি নবায়নযোগ্য শক্তির অবকাঠামোতে বিনিয়োগে আগ্রহী, কিন্তু এখাতে আমাদের এখানে বিনিয়োগের সুযোগ খুবই সীমিত। যেমন; সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনে বহু একর জমি প্রয়োজন হয়।
বিশিষ্ট এ অর্থনীতিবিদ মনে করেন, অল্প কিছু দেশে অফিস থাকায় বাংলাদেশের সড়ক ও অন্যান্য অবকাঠামো প্রকল্পে ব্যাংকটি থেকে সীমিত পরিমাণ ঋণ পাওয়া যেতে পারে।
উল্লেখ্য, গত ২০ আগস্টের এক বৈঠকে এনডিবি'র গভর্নিং বোর্ড বাংলাদেশকে সদস্যপদ দেওয়ার সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করে।
এর আগে গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত এক ভার্চুয়াল সভায় বাংলাদেশকে ব্রিকস ব্যাংকে যোগদানের আমন্ত্রণ জানান ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। পাঁচ জাতির এ উন্নয়ন সহযোগী সংস্থায় যোগদানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সেসময় আগ্রহ প্রকাশ করেন। তারপর থেকেই এনডিবি'র সম্ভাব্য সদস্য দেশের তালিকায় ছিল বাংলাদেশ এবং অনুমোদনের পর আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত হলো।
সর্বপ্রথম ১৯৭২ সালে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল- এ দুই উন্নয়ন সহযোগী আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্য হয় বাংলাদেশ। এরপর ১৯৭৩ সালে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও ১৯৭৪ সালে ইসলামিক উন্নয়ন ব্যাংকের (আইএসডিবি) সদস্যপদ লাভ করে। আর সবশেষ ২০১৬ সালে চীনের নেতৃত্বাধীন এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের (এআইআইবি) সদস্য হয়।
বর্তমানে বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের বিনিয়োগ প্রোফাইল ১৪ বিলিয়ন আর এডিবি'র ১২.৩ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে, বাংলাদেশের সঙ্গে পাঁচ বছরের অংশীদারিত্বের স্বল্প সময়েই এআইআইবি'র অর্থায়নে অনুমোদিত ও প্রস্তাবিত প্রকল্পের মোট মূল্যায়ন ৪২০ কোটি ডলার।
ঘোষণার বিবৃতিতে এনডিবি বলেছে, "এর ফলে বাংলাদেশ উদীয়মান বাজার অর্থনীতির দেশগুলোর প্রধানতম উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার সদস্য হলো, যার মাধ্যমে বাংলাদেশের নিজস্ব উন্নয়ন এজেন্ডার লক্ষ্যসমূহ বাস্তবায়ন ও অর্জনেও নতুন সুযোগ সৃষ্টি হলো।"
অবকাঠামো ও টেকসই উন্নয়ন বাস্তবায়নে নতুন প্ল্যাটফর্ম হিসেবে এনডিবি'র সঙ্গে বাংলাদেশের সহযোগিতার সম্পর্ক তৈরি হবে। এতে ব্রিকস-সহ পরবর্তীতে সদস্যপদ লাভকারী দেশগুলোর সঙ্গেও সম্পর্কোন্নয়নের সুযোগ পাওয়া যাবে।
এব্যাপারে অর্থমন্ত্রী তাঁর বিবৃ্তিতে বলেছেন, "মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়নের ভিশন বাস্তবায়নে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সমৃদ্ধ ও সমতা ভিত্তিক বিশ্ব নিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে স্বপ্ন দেখেছিলেন- তা বাস্তবায়নে আমরা এনডিবি'র সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করবো।"
সরকারের উন্নয়নের ভিশন-২০৪১ এবং জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহ (এসডিজি) পূরণে দৃঢ় অঙ্গীকারের কথা ব্যক্ত করে অর্থমন্ত্রী জানান, অর্থনৈতিক ও সামাজিক মান উন্নত করে আগামী ২০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত দেশের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হবে।
গত এক দশক ধরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিকাশের শক্তিশালী গতির কথা তুলে ধরে তিনি জানান, তারপরও আলোচ্য লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সরকার গৃহীত ব্যাপক উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন অব্যাহত রাখতে বহিঃউৎস থেকে বাংলাদেশের বিপুল পরিমাণ আর্থিক সহায়তার দরকার হবে।
"এনডিবি'র সদস্যপদ লাভের মাধ্যমে বৈদেশিক অর্থায়নের আরেকটি উৎস যুক্ত হলো," যোগ করেন কামাল।
বাংলাদেশে কার্যালয় খোলার আগে প্রকল্প সহযোগিতায় বিশ্বব্যাংক, এডিবি, আইএসডিবি এবং এআইআইবি'র সঙ্গে যৌথ-অর্থায়নে যেতে পারে এনডিবি।
উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে বিভিন্ন মানদণ্ড নিশ্চিত করতে হয়, তাই বৃহৎ পরিসরের উন্নয়ন প্রকল্পে দাতা সংস্থাগুলোকে রাজি করাতে ব্যর্থতা রয়েছে বাংলাদেেশর। তবে অন্যান্য দাতা সংস্থা এনডিবি'র সঙ্গে যৌথ অর্থায়নে গেলে এধরনের মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে সাহায্য পাওয়া যাবে।
২০১৫ সালে ব্রিকস ভুক্ত দেশসহ অন্যান্য উদীয়মান অর্থনীতি ও উন্নয়নশীল দেশের অবকাঠামো আর টেকসই উন্নয়ন প্রকল্পে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার লক্ষ্যে এনডিবি প্রতিষ্ঠা করা হয়।
ছয় বছর আগে প্রতিষ্ঠার পর থেকে সদস্য দেশে অন্তত ৮০টি প্রকল্পে অর্থায়ন করেছে এনডিবি, যার মোট অঙ্ক ৩০ বিলিয়ন ডলার। মূলত, যোগাযোগ, পানি সরবরাহ, স্যানিটেশন, দূষণমুক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন, ডিজিটাল ও সামাজিক অবকাঠামো এবং নগর উন্নয়নের বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যাংকটি বিনিয়োগ করছে।
সংস্থাটির প্রদত্ত ঋণে সুদহার প্লাস দশমিক ৬৮ থেকে ১.০৩ শতাংশ, আর ম্যাচিউরিটির মেয়াদ ৮-১৯ বছর।