মহাসড়কের রেস্তোরাঁ ম্রিয়মাণ কোলাহলহীন
স্বাভাবিক কোনো সময়ে মহাসড়কের পার্শ্ববর্তী হোটেলগুলোর সামনে দেখা মিলতো, পার্কিংয়ের স্থান গাড়িতে গিজগিজ করছে। সড়কের ধারে মাত্র ২০ মিনিটের বিরতিতে নামা দীর্ঘ ভ্রমণপথের যাত্রীদের খাবার পরিবেশনের জন্য রেস্তোরার ওয়েটারদের মধ্যেও থাকতো ভীষণ ব্যস্ততার আমেজ। তবে সময়ের পালাবদলে বদলে গেছে সব।
বৃহস্পতিবার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে অবস্থিত রেস্তোরা কুমিল্লার মিয়ামি লেইজার স্পটে গেলে দেখা যায়, হোটেলের সামনে পার্কিংয়ের সুবিশাল স্থানে মাত্র ৭টি প্রাইভেট কার। নেই কোনো কোলাহল, পার্কিং নিয়েও নেই কোনো হুড়োহুড়ি।
রেস্তোরাঁয় প্রবেশের মুখেই বসানো হয়েছে একটি জীবাণুনাশক গেইট। নারী এবং পুরুষদের জন্য আলাদা আলাদা ওয়াশরুমগুলো জীবাণুনাশক ছিটিয়ে পরিচ্ছন্ন করে রাখা হয়েছে। হাত ধোয়ার জন্য বেসিনেও রয়েছে লিক্যুইড সাবানের ব্যবস্থা। কিন্তু রেস্তোরাঁর ভেতরে অর্ধেকটাই বন্ধ। যে অর্ধেক চালু রাখা হয়েছে, সেখানেও নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে চেয়ার টেবিলা পাতা হয়েছে। ওয়েটাররাও সবাই মুখে মাস্ক এবং হাতে গ্লোভস পরে আছেন।
স্বাস্থ্য সুরক্ষার এতো আয়োজন। কিন্তু এই আয়োজনের মধ্যেও বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় কুমিল্লার পার্শ্ববর্তী এই রেস্তোরাঁয় মাত্র ৬ জন ক্রেতার দেখা মেলে।
"আমাদের হোটেলের দ্বিতীয় তলা বন্ধ। নিচতলা আর দোতলা মিলিয়ে প্রায় ৫০০ জন একসঙ্গে খাবার খেতে পারেন এখানে। কিন্তু এখন কতোজন আছে সেটা তো দেখতেই পাচ্ছেন," বলছিলেন রেস্তোরাঁর কর্মী মোহাম্মদ পাভেল।
তিনি তার মোবাইলে মহামারি শুরু হওয়ার আগের একটি ছবি দেখান যাতে দেখা যাচ্ছিল রেস্তোরাঁর পার্কিং লটে ৩৯টি বাস এবং কার দাঁড়িয়ে আছে এবং আরও কয়েকটি প্রবেশ করছে।
পার্কিং লটে যত বেশি গাড়ি জমবে তত বেশি বকশিস পান মোস্তফা, যিনি সেখানে গাড়ি প্রবেশ এবং বের হওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। আগে গড়ে দৈনিক ৫০০টাকার মতো আয় করতে পারলেও এখন ২০০ টাকাও আয় হয় না তার।
রেস্তোরাঁর ৪০ জন কর্মীর মধ্যে ডিউটিতে ছিলেন মাত্র ১২ জন। কিন্তু ক্রেতার সংখ্যা কম থাকায় এই ১২ জনের মধ্যেও ছিল না তেমন কোনো ব্যস্ততা।
"লকডাউনের আগে যে পরিমাণ কাস্টমার আমাদের ছিলো, এখন তার মাত্র ছয় ভাগের একভাগ আসে এখানে। এরপরেও স্বাস্থ্য সুরক্ষার পেছনে আমাদের অনেক বেশি ব্যয় করতে হয়," বলছিলেন রেস্তোরাঁর অভ্যর্থনা ডেস্কের কর্মী ওমর।
রেস্তোরাঁর যে অবকাঠামো আর কর্মীদের পেছনে যে খরচ, সব মিলিয়ে লাভ-ক্ষতি সমান করতে হলেও দৈনিক অন্তত ৩ লাখ টাকা তাদের বিক্রির প্রয়োজন। কিন্তু আগের তুলনায় তাদের বিক্রি কমেছে এক তৃতীয়াংশ।
মহাসড়কের পাশে অনেকটাই সুপরিচিত এই রেস্তোরাঁর যাত্রা শুরু হয় বছর চারেক আগে এবং দৈনিক গড়ে সাড়ে ৪ লাখ টাকার বেশি বিক্রি করে আসছেন তারা।
হোটেলটির পরিচালক মোহাম্মদ শাহিন বলেন, "এখন আমাদের দৈনিক বিক্রির পরিমাণ মাত্র ১ লাখ থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা।"
আগামী দিনগুলোতে তার ব্যবসায় ক্ষতির পরিমাণ আরও কতো বাড়বে সে হিসেবই কষছেন তিনি।
"আমরা বুঝতে পারছি , ভ্যাকসিন আসার আগ পর্যন্ত আমাদের এভাবে ক্ষতি নিয়েই এগোতে হবে। ব্যাংকগুলোকে আমরা অনুরোধ করছি, তারা যেন আমাদের কিস্তি ছয় মাস থেকে এক বছরের জন্য স্থগিত করে। তাহলেই আমরা কিছুটা স্বস্তি পাবো।"
কুমিল্লা ও ফেনীর মধ্যবর্তী ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে প্রায় ৫০টি হাইওয়ে হোটেলের একই অবস্থা। এরমধ্যে রয়েছে হাইওয়ে ইন, টাইমস স্কয়ার, অফ-বিট, জমজম, তাজমহল ও নুরজাহানের মতো সুপরিচিত রেস্তোরাঁগুলো।
চার লেনের এই মহাসড়কে বাসের সংখ্যাও বেশ কম। মহাসড়ক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে মূলত কার্গো ভ্যান আর ট্রাক।
ঢাকা, লক্ষীপুর, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার রুটে ৩০টি বাস আছে মিয়ামি রেস্তোরাঁর মালিক শাহিনের।
তিনি বলেন, "সবগুলো বাসই এখন গ্যারেজে আছে। লকডাউন শিথিলের পর সরকার বাস চালুর অনুমতি দিলে আমি দুই দিনের জন্য গাড়িগুলো রাস্তায় নামাই। তবে দুইদিনে আমার লস হয় ২ লাখ ৬০ হাজার টাকা। এরপর বাস বন্ধ করে দেই আমি।"
ক'দিন আগেই করোনা থেকে সুস্থ হয়ে ওঠা শাহীন বলেন, সরকারের ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ থেকেও ঋণ নেওয়ার ইচ্ছা তার নেই।
"অনেকেই এটার জন্য মনোনীত হবেন। কিন্তু আমি মনে করি দ্রুত সময়ের মধ্যে ব্যবসা চাঙ্গা হওয়ার কোনো লক্ষণ যেহেতু নেই, সেহেতু এই লোনটাও উল্টা বোঝা হয়ে দাঁড়াবে একসময়।"
কুমিল্লা জেলা হোটেল মালিক সমিতির সভাপ্তি এমএ মুকিত টিপু বলেন, অনেক রেস্তোরাঁ মালিকই তাদের ব্যবসা বদলে বেকারি বা মুদি দোকানের ব্যবসার দিকে ঝুঁকছেন।
মহাসড়কের পার্শ্ববর্তী অল্প কয়েকটি রেস্তোরাই খুললেও ক্রেতার সংখ্যা খুবই কম। মহাসড়কে বাসের সংখ্যাও অনেকটা কমে গেছে। এরমধ্যে সামাজিক দূরত্বের গাইডলাইন মানতে গিয়ে প্রতি দুই সিট পর পর একজন যাত্রী বসার কারণে বাসে যাত্রী সংখ্যাও অর্ধেক হয়ে গেছে। যাত্রাপথে খাবারের জন্য হোটেলে বাস থামলেও সংক্রমণের ভয়ে অনেক যাত্রীই হোটেলে প্রবেশ করেন না।
সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে তাদেরকেও যেন সহায়তা করা হয় সে দাবি জানান রেস্তোরাঁ মালিকদের সংগঠনের সভাপতি মুকিত।
"রেস্তোরাঁগুলো যাতে এ সময়ে আর্থিক ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারে সেজন্য আমাদের মূল সংগঠন আমাদের কাছ থেকে একটি তালিকা নিয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত মালিক বা কর্মী কেউই কোনো সহায়তা পাননি।"
তিনি বলেন, বন্ধ থাকার ৩ মাস পর রেস্তোরাঁগুলো খুলতে সরকারের পক্ষ থেকে অল্প পরিমাণে কোনো ঋণ দিলেও সেটা বেশ উপকারে আসবে।
মুকিত বলেন, তৈরি পোশাক শিল্প এবং পরিবহন খাতের পর রেস্তোরাঁ খাতেই সবচেয়ে বেশি লোক কাজ করে। কিন্তু এটা এখনো অবহেলিত রয়ে গেছে।
"যে রেস্তোরাঁগুলোয় আগে ৪০ জন কাজ করতো এখন সেখানে মাত্র ১০ জনের মতো কাজ করে। চাকরি হারানো এসব কর্মীদের কাউকে কাউকে আমি দেখেছি সবজি বিক্রি করতে।"
এই সেবাখাতগুলো বর্তমানে সবচেয়ে কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং পুনরায় সবকিছু সচল করে দেওয়ার পরও রেস্তোরাঁ ব্যবসা কিংবা পরিবহনের মতো খাতগুলোতে দ্রুত স্বস্তির দেখা মিলবে না, এমন ধারণাই বিশেষজ্ঞদের।
এ বিষয়ে মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, এই সেবাখাতগুলোতেই করোনার ধাক্কা সবার আগে পড়েছে এবং স্বস্তিও ফিরবে সবার শেষে।
ব্যবসার ধরণের কারণে কয়েকটি ব্যাংক পরিবহন খাতের সঙ্গে যুক্ত আছে, যারা এর করোনার মৌসুমে বেশ সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
ট্যুরিজম এবং হসপিটালিটি ব্যবসাকে আরও দীর্ঘ সময় এই অচল অবস্থার মধ্য দিতে যেতে হবে মন্তব্য করে সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, "সবকিছু সচল হওয়ার পর থেকে পরিবহন সেবার গাড়িগুলো ধারণক্ষমতার অর্ধেক যাত্রী নিয়ে চলাচল করছে। রেস্তোরাঁগুলোর ও দ্রুত সময়ের মধ্যে স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরার কোনো সুযোগ নেই। ফলে সংকট থেকেই যাচ্ছে।"