মুনাফা কমেছে সরকারি কোম্পানির, ব্যতিক্রম শুধু সাবমেরিন ক্যাবল
- ইন্টারনেটের চাহিদা বাড়ায় মুনাফায় উল্লম্ফন
- মহামারীতে ইন্টারনেটের চাহিদা বেড়েছে প্রায় ২৫%
মহামারীর কারণে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ৮১ শতাংশ সরকারি কোম্পানির মুনাফা কমেছে।
সে অর্থবছরে মাত্র দুটি কোম্পানি- বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল কোম্পানি লিমিটেড ও বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের মুনাফা বৃদ্ধি পায়।
পুঁজিবাজারে সরকারি ১৯ টি কোম্পানি তালিকাভুক্ত, যার মধ্যে ১৮ কোম্পানির ২০১৯-২০২০ সালের নিরীক্ষিত আর্থিক হিসাব বিশ্লেষণে এই তথ্য জানা গেছে।
ওইঅর্থবছর মাত্র দুটি কোম্পানির মুনাফা আগের বছরের চেয়ে বেড়েছে আর ৮১% কোম্পানির মুনাফা-ই কমেছে। বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল কোম্পানির মুনাফা ৬৩% আর বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের বেড়েছে ১৩৬.৭৮%।
করোনায় বেশির সরকারি কোম্পানির মুনাফা কমলেও কেবলমাত্র প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যহত রাখতে সক্ষত হয়েছে বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিসিএল)।
করোনায় ইন্টারনেটের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় চলতি ২০২০-২০২১ অর্থবছরের প্রথমার্ধে সাবমেরিন ক্যাবলের মুনাফা বেড়েছে ৯৩%।
প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা জানায়, মহামারীতে ইন্টারনেট ব্যবহার বেড়েছে প্রায় ২৫%।
শিপিং কর্পোরেশন ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে মুনাফা করলেও পরবর্তীতে অব্যহত রাখতে পারেনি। চলতি বছরের প্রথমার্ধে শিপিং কর্পোরেশনের মুনাফা কমেছে ৩৯.১৭%।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) জমা দেওয়া কোম্পানিগুলোর আর্থিক হিসাব অনুযায়ী, সরকারি ১১টি কোম্পানি মুনাফা করেছে। ৭টি কোম্পানি লোকসানে রয়েছে।
২০১৯-২০২০ অর্থবছরে সরকারি কোম্পানিগুলোর নীট মুনাফা ১৫৩৬.১২ কোটি টাকা, যা গতবছরের চেয়েছে ১৬.৪৬% কম। আগের বছর মুনাফা ছিল ১৮৩৮.৮০ কোটি টাকা।
সরকারি কোম্পানির মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৩৫৯.৮০ কোটি মুনাফা করেছে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিষ্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড, তবে এই মুনাফা আগের বছরের চেয়ে ২২.৫৩ শতাংশ কম। আর সবচেয়ে বেশি ৬০.৬৯ কোটি টাকা লোকসান করেছে শ্যামপুর সুগার মিলস লিমিটেড।
গতবছরের মার্চে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) ব্যাপক প্রভাব পড়ে। টানা ৬৬ দিন শাটডাউনের কারণে কারখানা বন্ধ থাকলেও ব্যয় মেটাতে গিয়ে কোম্পানিগুলোর আয় কমে যায়।
করোনা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে শাটডাউন তুলে নেওয়ার পর উৎপাদনে ফেরে শিল্প-কারখানা। তবে এখনো কোভিডের ধাক্কা কাটেনি।
চলতি ২০২০-২০২১ অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) সরকারি কোম্পানির নীট মুনাফা হয়েছে ৭২৪ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩.৪৭% কম। এই সময়ে মাত্র দুটি কোম্পানি সাবমেরিন ক্যাবল ও যমুনা অয়েলের মুনাফা বেড়েছে। আর সবগুলোর আয় আগের বছরের তুলনায় হ্রাস পেয়েছে।
অর্থবছরের প্রথমার্ধে সবচেয়ে বেশি ১৭৯.১৭ কোটি মুনাফা হয়েছে পাওয়ার গ্রীড কোম্পানির। তবে এই মুনাফা আগের বছরের চেয়ে ২৪% কম। আর সবচেয়ে বেশি ৫০.০৬ কোটি টাকা লোকসান করেছে বাংলাদেশ সার্ভিস লিমিটেড।
সরকারী তালিকাভুক্ত লাভজনক কোম্পানিগুলো হলো- ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অফ বাংলাদেশ (আইসিবি), ঢাকা ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (ডেসকো), ইস্টার্ন লুব্রিকেন্টস, যমুনা অয়েল, মেঘনা পেট্রোলিয়াম, পদ্মা অয়েল, পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি, তিতাস গ্যাস এবং ন্যাশনাল টিউবস লিমিটেড।
অন্যদিকে লোকসানের তালিকায় যাদের স্থান হয়েছে- অ্যাটলাস বাংলাদেশ, বাংলাদেশ সার্ভিসেস, ইস্টার্ন ক্যাবলস, শ্যামপুর সুগার মিলস, উসমানিয়া গ্লাস শিট ফ্যাক্টরি, রেনউইক যজ্ঞেশ্বর এবং জিল বাংলা সুগার মিলস।
লোকসানের কারণে গত বছর শ্যামপুর সুগার মিলসের উৎপাদন বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে শ্যামপুর সুগারের লোকসান ৬০.৬৯ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের অর্ধ-বার্ষিকে লোকসান ২৪.৬১ কোটি টাকা।
লোকসানের ধারাতেই রয়েছে আরেক চিনি উৎপাদনকারী জিলবাংলা সুগার মিলস। বিগত অর্থবছরে কোম্পানিটির লোকসান ৫৬.২১ কোটি টাকা। চলতি বছরের অর্ধ-বার্ষিকে জিলবাংলার লোকসান ২২.১১ কোটি টাকা।
উসমানিয়া গ্লাস কোম্পানিও লোকসানে; গত অর্থবছরে বড় লোকসানের পর চলতি অর্থবছরের অর্ধ-বার্ষিকেও লোকসান করেছে ৫.৮৩ কোটি টাকা।
ট্রাভেল ও লেইজার খাতের বাংলাদেশ সার্ভিস লিমিটেড লোকসান করেছে ৪.৬২ কোটি টাকা। করোনায় অতিথি কমে যাওয়ায় আয়ও কমছে কোম্পানিটির। চলতি অর্থবছরের অর্ধ-বার্ষিকে লোকসান ৫০.০৬ কোটি টাকা, যা আগের বছরের ৪০৬.৫৫ শতাংশ বেশি।
বাংলাদেশ সার্ভিসের এক কর্মকর্তা জানান, কোভিডের কারণে অতিথি কমে যাওয়ায় আয়ও কমেছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আর্থিক অবস্থার উত্তরণ হতে পারে।"
আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতের ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) অর্ধ-বার্ষিকে মুনাফা করেছে ৬২.০৯ কোটি টাকা।
আগের বছর একই সময়ে কোম্পানিটির লোকসান ছিল ১৫০.১৪ কোটি টাকা।
২০১৯-২০২০ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে লোকসান হয় ১৩৪.৩০ কোটি টাকা আর দ্বিতীয় প্রান্তিকে লোকসান ১৫.৮৩ কোটি টাকা।
লোকসানে ধুঁকছে প্রকৌশল কোম্পানি
পুঁজিবাজারের প্রকৌশল খাতে চারটি সরকারি কোম্পানির মধ্যে তিনটিই লোকসানে।
অ্যাটলাস বাংলাদেশের ট্রেডমার্কের আওতায় বিশ্বখ্যাত জংশেন ব্র্যান্ড মোটরসাইকেলের বিভিন্ন মডেল তৈরি করে অ্যাটলাস।
২০১৯-২০২০ অর্থবছরে কোম্পানির ক্ষতি হয়েছে ৪.৪৭ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় ৪৭% বেশি।
দেশের প্রথম পাইপ উৎপাদনকারী কোম্পানি ন্যাশনাল টিউবস লিমিটেড ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের লাভ করেছে ১৯ লাখ টাকা।
আগের বছর কোম্পানিটির লোকসান ছিল ৫০ লাখ টাকা। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে মুনাফা করলেও দ্বিতীয় প্রান্তিকে কোম্পানিটির লোকসান হয়।
গত অর্থবছরে ১৭.০৫ কোটি টাকা লোকসানের পর ইস্টার্ন ক্যাবলস চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয়মাসে লোকসান করেছে ৮.৬৯ কোটি টাকা। আগের বছরও লোকসানে ছিল, সেই তুলনায় লোকসান ৯.৮৬% বেড়েছে।
সরকারি চিনি মিলগুলোর জন্য প্রয়োজনী পার্টস তৈরী করা রেনউইক যজ্ঞেশ্বর কোম্পানিও লোকসানে রয়েছে।
২০১৯-২০২০ সালে কোম্পানিটির লোকসান ১৭.০৫ কোটি টাকা আর চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয়মাসে লোকসান ১.৭৪ কোটি টাকা। আগের বছরের চেয়ে লোকসান বেড়েছে ৬০৬.৭৭%।
জ্বালানী ও বিদ্যুত খাতের কোম্পানিগুলো মুনাফায়
জ্বালানী ও বিদ্যুত খাতে তালিকাভুক্ত সরকারি সাতটি কোম্পানিই মুনাফা করেছে। তবে করোনায় মন্দায় ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে সবগুলো কোম্পানির মুনাফা কমেছে।
করোনা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলেও চলতি অর্থবছরে অর্ধ-বার্ষিক হিসাবে ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারেনি এই খাতের কোম্পানি।
দ্বিতীয় প্রান্তিক শেষে মাত্র দুটিকোম্পানির মুনাফা আগের বছরের চেয়ে বেড়েছে। আর পাঁচটি কোম্পানি মুনাফা কমেছে।
২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ডেসকোর মুনাফা ৫৭.৬১% কমে দাঁড়িয়েছে ৪৫.৫৬ কোটি টাকা। আগের বছর মুনাফা ছিল ১০৭.৪৮ কোটি টাকা।
যমুনা অয়েলের মুনাফা ১৪.৪৩% কমে ২০০.১৯ কোটি টাকা, মেঘনা পেট্রোলিয়ামের ১৮.৯৫% কমে ৩০৩.৯১ কোটি টাকা, পদ্মা অয়েলের ৪.৪১% কমে ২৭২.৯৬ কোটি টাকা, পাওয়ার গ্রীডের ১৭.৩৪% কমে ৩১৭.৪১ কোটি টাকা, তিতাস গ্যাসের ২২.৫৩% কমে ৩৫৯.৮০ কোটি টাকা ও ইস্টার্ন লুব্রিকেন্টের মুনাফা ৭৬.৮৩% কমে দাঁড়িয়েছে ৫৪ লাখ টাকা।
করোনায় মুনাফা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে সাবমেরিন ক্যাবলের
করোনা মহামারীতে ঘরের বাইরে আনাগোনা কমে যাওয়ায় অনলাইন নির্ভরতা বেড়েছে। আর সেই সুযোগে মুনাফা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে কোর টেলিকম্যুনিকেশন্স সার্ভিস প্রভাইডার এবংআন্তর্জাতিক সাবমেরিন ক্যাবল অপারেটর বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানীর।
২০১৯-২০২০ অর্থবছরে সাবমেরিন ক্যাবলের মুনাফা হয় ৯৫.৫৯ কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ৬৩.২২১% বেশি। আর অর্ধ-বার্ষিকে মুনাফা হয় ৭২ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৯৩.৪৪% বেশি।
চলতি ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে কোম্পানিটির মুনাফা ৯২.৭২% বেড়ে দাঁড়ায় ২২.০৯ কোটি টাকা আর দ্বিতীয় প্রান্তিকে ৯৪.২১% মুনাফা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৮.৯৪ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানি লিমিটেডের (বিএসসিসিএল) কোম্পানি সচিব মো. আব্দুস সালাম খান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "করোনার সময় অনলাইন নির্ভরতায় ইন্টারনেটের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ার কারণে ভালো মুনাফা হয়েছে। করোনায় ইন্টারনেটের চাহিদা আনুমানিক ২৫% শতাংশ বেড়েছে।"
তিনি বলেন, "করোনার কারণে ব্যবসায় ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে, আগেও ধারাবাহিকভাবে প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তবে করোনায় সেই প্রবৃদ্ধির ধারা আরও ত্বরান্বিত হয়েছে।"
এখন ক্রমেই ইন্টারনেট ব্যবহারের যে চাহিদা, তাতে আগামী দিনে ইন্টারনেট সেবা নিশ্চিতে হিমশিম খেতে হবে। গ্রোথ অনেক ভালো, ফাইভ-জি চালু করলে ইন্টারনেটের চাহিদা আরও বাড়বে। সেই জন্য এখন থেকে প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।"