যত্নে তৈরি লক্ষ্মীপুরের হাতে ভাজা মুড়ির কদর এখনও ম্লান হয়নি
অনেক আগে থেকেই হাতে ভাজা গিগজ ধানের চাউলের মুড়ির স্বাদ সারাদেশে বিখ্যাত। তবে গত কয়েক বছর যাবত ধানের বিলুপ্তি এবং মেশিনের মুড়ির চাপে দেশের বিভিন্ন জেলায় অদৃশ্য হয়ে গেছে ঐতিহ্যবাহী এ মুড়ি। ফলে মাহবুবুর রহমান নামক এক ব্যাংক কর্মকর্তা দাবি করেন, বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই এই গিগজ মুড়ির সাথে পরিচিত নন।
কিন্ত লক্ষ্মীপুরের বিভিন্ন এলাকায় প্রায় শতাধিক পরিবার হাতে ভাজা মুড়ি উৎপাদন ও ব্যবসার সাথে জড়িয়ে আছে যুগ যুগ ধরে। ঐতিহ্যবাহী হাতে ভাজা গিগজ মুড়ি তারা শুধু ধরেই রাখেনি, বিশ্ববাজারেও পৌঁছে দিচ্ছে। সুস্বাদু এ মুড়ি দেশ-বিদেশে তৈরি করেছে বিশেষ একটি ব্র্যান্ড।
সারাদেশসহ বিদেশের কিছু রাষ্ট্রেও অনিয়মিতভাবে রপ্তানি হচ্ছে লক্ষ্মীপুরের গিগজ মুড়ি। জেলায় বছরে উৎপাদন হচ্ছে পাঁচশতাধিক টন মুড়ি। সংশ্লিষ্ট উৎপাদনকারী, ব্যবসায়ী এবং স্থানীয়দের সাথে কথা বলে এসব জানা গেছে।
স্থানীয়ভাবে জানা যায়, হাতে তৈরি গিগজ মুড়ি ও ধান ক্রয়বিক্রয়ের জন্য তৈরি হয়েছে ভিন্ন আড়ত ও হাট। সুস্বাদু আর ঐতিহ্যবাহী এ খাদ্যকে টিকিয়ে রাখতে উৎপাদনকারীদের পড়তে হচ্ছে নানা প্রতিকূলতায়। বিশেষ এ মুড়ির ক্রেতাদের অনেকেই জানেনা বিচিত্র এ পেশা সর্ম্পকে।
লক্ষ্মীপুর থানা রোডে অবস্থিত হাতে ভাজা গিগজ মুড়ির আড়তে কথা হয়, সরস্বতী দাস (৪৫) নামের এক নারীর সাথে। রোববার হাটের দিন প্রতি কেজি ১৩০ টাকা দরে আড়তে আসা পাইকারের নিকট বিক্রি করেছিলেন তিনি। পরে সে টাকায় আড়ত থেকে প্রতি মণ (৪০ কেজি) ২২শ টাকা দরে গিগজ ধান ক্রয় করেছিলেন মুড়ির জন্য।
আড়তে ওই সময়ে মেশিনে তৈরি সাধারণ মুড়ি বিক্রি হচ্ছিল প্রতি কেজি ৫০ টাকায়। সাধারণ ধান প্রতি মণ (৪০ কেজি) ৯০০ টাকা দরে। সরস্বতী দাস জানান, স্বাদ, ঐতিহ্য আর প্রাকৃতিকতার কারণে সাধারণ মুড়ির তুলনায় হাতে ভাজা গিগজ মুড়ি এবং গিগজ ধানের দাম প্রায় তিনগুণ বেশি। তবুও এ মুড়ির ব্যাপক চাহিদা। বাড়ি থেকে আড়তে আনলেই মুড়ি বিক্রি হয়ে যায়। গত ৫ বছর যাবত এ ব্যবসার সাথে জড়িত তিনি। তার পুরো সংসার চলছে হাতে ভাজা মুড়ির আয়ে। সরস্বতী দাসের বাড়ি লক্ষ্মীপুর পৌর শহরের সমসেরাবাদ।
একই গ্রামের জোড়দিঘী নামক এলাকায় প্রায় ৩০ পরিবারের প্রধান পেশা হাতে ভাজা গিগজ মুড়ি উৎপাদন। কষ্টকর হলেও বংশগতভাবে যুগ যুগ ধরে তারা জড়িত এ ব্যবসার সাথে। পুরো গ্রামকে মানুষ গিগজ মুড়ির গ্রাম নামে জানে।
গ্রামের বাবুল দাস জানান, দীর্ঘ ৩০ বছর যাবত হাতে ভাজা গিগজ মুড়ি ও খই উৎপাদন করেন তিনি। শহরের ওপর জমি কিনে বহুতল বাড়ি করেছেন। কিন্ত আদি পেশা ছাড়েননি। তিনি হাতে ভাজা মুড়িকে ঐতিহ্যবাহী খাদ্য মনে করেন। বাবুল দাসদের সরকার বাড়ীর প্রায় সব পরিবার এ মুড়ির উৎপাদন ও ব্যবসার সাথে জড়িত।
স্থানীয়ভাবে জানা যায়, লক্ষ্মীপুর জেলা শহরের পৌরসভার সমসেরাবাদ, উত্তর মজুপুর, বেঁড়িরমাথা, কমলনগর উপজেলার করুণানগর, দক্ষিণ গ্রাম, উত্তর গ্রাম, চর জালিয়া, রামগতি উপজেলার চর ডাক্তার এবং রঘুনাথপুর হাতে ভাজা গিগজ মুড়ির জন্য বিখ্যাত। এ ৮টি গ্রামের শতাধিক পরিবারের হাজারো মানুষের প্রধান জীবিকা হাতে ভাজা গিগজ মুড়ি।
ওইসব পরিবারের প্রত্যেক সদস্যই রাতদিনের বেশিরভাগ সময় গিগজ ধান সিদ্ধ করা, শুকানো, চাল ভাঙ্গানো, মুড়ি ভাজা, আড়ত কিংবা দোকানে গিয়ে মুড়ি বিক্রি ও ধান ক্রয়ের মতো কাজের সাথে জড়িত।
বৃহস্পতিবার এবং রবিবার লক্ষ্মীপুর শহরের থানা সড়কের আড়তে হাতে ভাজা মুড়ির হাট বসে। এসময় জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকার ও মুড়ি বিক্রেতারা আসে। সকাল ৯টা থেকে রাত পর্যন্ত মুড়ি ক্রয়বিক্রয় চলে। নির্মল দাসের আড়ত, ক্ষিতিশ বাবুর আড়ত এবং গুপি ভান্ডার জেলার হাতে ভাজা মুড়ির বড় আড়ত। দেশের বিভিন্ন জেলায় এখান থেকে মুড়ি যায়।
আড়তদার স্বদেশ দাস জানান, প্রতি হাটের দিন কমপক্ষে ৫-৬ টন এবং বছরে গড়ে ৫০০ টনের বেশি গিগজ মুড়ি ক্রয় বিক্রয় হয়। আড়ত ছাড়াও বিভিন্ন দোকানীরা উৎপাদনকারীদের থেকে সরাসরিও মুড়ি কিনে থাকেন।
আড়তদার নির্মল দাস জানান, মাঝে মাঝে কয়েকজন ঢাকার রপ্তানীকারক মালয়েশিয়া, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ এবং আমেরিকাতে লক্ষ্মীপুরের মুড়ি রপ্তানি করেন। এ অঞ্চলের প্রবাসীরা বিদেশ যাওয়ার সময় প্রায় ৫-১০ কেজি গিগজ মুড়ি সঙ্গে নিয়ে যান বলেও জানান তিনি।
কমলনগরের চর জাঙ্গালিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ গ্রামের চন্দ্রাধন দাস জানান, হাটের দিন একেকটি পরিবার প্রায় ৫০-৬০ কেজি মুড়ি বিক্রি করেন। বর্তমানে পাইকারী বাজারে প্রতি টন মুড়ির পাইকারী দাম ১ লাখ চল্লিশ হাজার টাকা পর্যন্ত । গোবিন্দ চন্দ্র দাস নামের একজন জানান, একেকটি পরিবার বছরে ১০ থেকে ১৬ টন মুড়ি উৎপাদন করে।
মানিক চন্দ্র দাস নামের এক ব্যবসায়ী জানান, আগে হাতে ভাজা মুড়ির প্রধান উপাদান গিগজ ধানের প্রচুর চাষ হতো। বর্তমানে গিগজ ধানের উৎপাদন প্রায় বিলুপ্ত। জেলার মজুচৌধুরীর হাট, চরবংশী মোল্লারহাট, তোরাবগঞ্জ বাজার, উত্তর মার্টিন বাজার, মতিরহাট, করুণানগর ও রামগতি বাজার ও আড়তে গিগজ ধান ক্রয়-বিক্রয় হয়। গিগজ ধানের পাশাপাশি একই মানের ভূষিহারা, ধলামোডা জাতের দেশীয় ধান থেকেও এ মুড়ি তৈরি হয়।
লীলাবতী দাস (৭৫) নামের এক নারী জানান, ধানের মৌসুমে আর্থিক স্বাবলম্বী ব্যবসায়ীরা সারা বছরের পরিমাণ মতো ধান কিনে বাড়িতে সংগ্রহে রাখেন। আর্থিক সংকটে থাকা ব্যবসায়ীরা প্রতি বাজারে মুড়ি বিক্রয় করার পর সে টাকায় ধানের আড়ত থেকে ধান কিনে বাড়িতে আনে।
অঞ্জনা দাস নামের এক নারী জানায়, ধান থেকে চাউল তৈরি এবং মুড়ি ভাজা পর্যন্ত প্রক্রিয়াটি একটি জটিল কাজ। সে কারণে অনেকে এখন পেশা ছেড়ে দিয়েছেন।
সম্ভু দাস জানান, বাজার থেকে আনা কিংবা বাড়িতে থাকা গিগজ ধান প্রথমে ভাপ দিয়ে পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয়। ২৪ ঘন্টা পরে আবার সিদ্ধ করতে হয়। এরপর ২ দিন রোদে শুকিয়ে চাউল উৎপাদনের উপযোগী করা হয়। ধান থেকে বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষ করে মুড়ির চাউল পেতে কমপক্ষে পাঁচদিন সময় লাগে। ৬ষ্ঠ দিনের মধ্যরাত থেকে মুড়ি ভাজা শুরু করে সকাল ৯টা -১০টার মধ্যে ভাজা শেষে আড়তে নিয়ে যেতে হয়। ৮০ কেজি ধানে সর্বোচ্চ ৪৮ কেজি মুড়ি পাওয়া যায়। প্রতি বাজারেই দাম উঠানামা করে। সারা বছরই মুড়ি চলে। তবে রমজান এবং শীত মৌসুমে বেশি বিক্রি হয় বলেও জানান সম্ভু দাস।
উৎপাদনকারীরা জানান, হাতে ভাজা মুড়িতে লবণ-পানি ছাড়া অন্য কোন পদার্থ দেয়া যায় না; লাকড়ি ছাড়া গ্যাসের আগুনেও এ মুড়ি ভাজা যায় না। বাজারে পাওয়া কোন চাউলেও এ মুড়ি তৈরি করা যায় না।
উৎপাদনকারীরা জানান, মুড়ি ভাজার লোকদের প্রধান সমস্যা পুঁজির অভাবে বছরের শুরুতে ধান মজুদ করতে না পারা। সেজন্য এ কুটির শিল্প বেঁচে রাখতে তারা আড়তদার এবং এনজিও ঋণে আবদ্ধ থাকে। স্বল্প সুদে কোন ব্যাংক থেকে ঋণ পায় না তারা।
অন্যদিকে বৃষ্টির সময় মুড়ির ধান শুকোতে তাদের বড় কষ্ট! বৃষ্টির সময় মুড়ির ধান শুকোনোর জন্য সরকারি সহায়তায় এয়ার ড্রায়ার পেতে চেয়েছেন উৎপাদনকারীরা।
লক্ষ্মীপুরের কমিউনিটি ডিজিটাল নিউজ মিডিয়া অর্গানাইজেশন লক্ষ্মীপুর২৪ এর সাংবাদিক জুনায়েদ আহমেদ জানান, তাদের গণমাধ্যমের স্থানীয় অফিসে সংবাদকর্মীরা প্রতি সন্ধ্যায় ছোলার সাথে হাতে ভাজা গিগজ মুড়ি দিয়ে সান্ধ্য নাস্তা সারেন। তিনি জানান, এ অঞ্চলের একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার গিগজ মুড়ি।
কলেজ শিক্ষক মোঃ আক্তার হোসেন জানান, রমজানে ইফতারে এই মুড়ি ছাড়া কল্পনাই করা যায় না। মেশিনের তৈরি মুড়ির চাউল মেশিনে তৈরি করা হয়। ভাজার সময় বিষাক্ত হাইড্রোজ এবং ইউরিয়া সার মিশ্রিত করা হয়। কিন্ত হাতে ভাজা মুড়িতে সে রকম কিছু মেশানো সম্ভব হয় না। সে কারণে গিগজ মুড়ি শতভাগ নিরাপদ এবং ঐতিহ্য ও আভিজাত্যের প্রতীক। শীতে বাসাবাড়ি ও অফিস আদালতে সকাল-সন্ধ্যায় ছোলা-মুড়ি খুবই জনপ্রিয় একটি খাদ্য।
হাতে ভাজা মুড়ি ব্যবসায়ীদের আর্থিক সংকট নিয়ে কথা হয়, সোনালী ব্যাংক লক্ষ্মীপুরের প্রধান শাখার প্রিন্সিপাল অফিসার (ভারপ্রাপ্ত ম্যানেজার) মোঃ শামছুল ইসলামের সাথে। তিনি জানান, হাতে ভাজা গিগজ মুড়ি একটি ঐতিহ্যবাহী কুটির শিল্প। সোনালী ব্যাংক থেকে কুটির শিল্পে ঋণ নিতে হলে ট্রেড লাইসেন্স প্রয়োজন। কিন্ত মুড়ি উৎপাদনকারীরা ট্রেড লাইসেন্স না নিতে পারলে তাদেরকে সহযোগিতা করা সম্ভব না।
কিন্ত ইসলামী ব্যাংক লক্ষ্মীপুর জেলা শাখার ম্যানেজার মোঃ সানা উল্লাহ জানান, ঐতিহ্যবাহী গিগজ মুড়ি শিল্পকে রক্ষার জন্য ইসলামী ব্যাংক সহজ শর্তে পল্লী উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যেমে ৩০ হাজার থেকে ৩ লাখ টাকা ঋণ দিতে পারে।
অন্যদিকে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের প্রধান তথ্য কর্মকর্তা ফয়সল হাসান জানান, তিনি নিজেও লক্ষ্মীপুরের ঐতিহ্যবাহী হাতে ভাজা গিগজ মুড়ির এক নিয়মিত ক্রেতা। ঐতিহ্যবাহী গিগজ মুড়িকে বাঁচিয়ে রাখতে কৃষক পর্যায়ে গিগজ ধানের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং ব্যাংক ঋণসহ প্রয়োজনীয় সহায়তা নিয়ে এ সম্প্রদায়ের পাশে থাকার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগে জানাবেন বলেও জানান তিনি।