লকডাউন পোশাক শিল্পকে ত্রিশঙ্কু অবস্থায় ফেলে দিয়েছে
চলমান লকডাউনের আওতায় আগামী ৫ আগস্ট পর্যন্ত কারখানা বন্ধ থাকায় ত্রিমুখী সমস্যায় পড়েছে পোশাক শিল্প।
চ্যালেঞ্জগুলি হলো; একদিকে যখন সংক্রমণের সংখ্যা বৃদ্ধির আশঙ্কায় সরকার কারখানা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত বজায় রাখতে চাইছে, অন্যদিকে আইন অনুসারে কারখানা মালিকদের শ্রমিকদের মূল বেতনের অর্ধেকও দিতে হবে।
আবার লকডাউনের কারণে বন্দরে অচলাবস্থা থাকায় বিদেশি ক্রেতাদের কার্যাদেশ বিমানে করে বা এয়ারফ্রেইটারে পাঠাতে হতে পারে, এতে খরচও বাড়বে, কমবে মুনাফা। সঙ্গে কার্যাদেশ হারানোর ঝুঁকিও নিতে হবে তাদের। তারমধ্যেই আবার নির্দিষ্ট সময়ে পুরো বেতন না দিলে আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন শ্রমিক নেতারা।
এ পরিস্থিতিতে পোশাক শিল্প মালিক সংগঠনের নেতারা বলছেন, বেতনের জন্য শ্রমিক অসন্তোষ, কার্যাদেশ এদেশ থেকে অন্যখানে চলে যাওয়া ঠেকানো এবং এয়ারফ্রেইট খরচসহ অদৃশ্য অনেক সমস্যা সমাধানে কারখানা খুলে দেওয়াই একমাত্র সমাধান হবে।
বুধবার (২৮ জুলাই) দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে আলাপে তারা এ পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন।
জানা গেছে, কাজ ছাড়া শ্রমিকদের বেতন দেওয়ার সামর্থ্য না থাকায় পোশাক শিল্প মালিকদের একটি গ্রুপ এখাতের উদ্যোক্তাদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ'কে কারখানা খুলে দেওয়ার ব্যাপারে চাপ দিচ্ছে।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন- বিকেএমইএ'র নেতারাও চাপের মুখে পড়েছেন। কারণ বেশ কিছু কারখানার মালিক সংগঠনকে কাজ ছাড়া বেতন না দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন।
কিছু উদ্যোক্তা নোটিশ দিয়ে জানিয়েছেন যে, ঈদুল আজহার ছুটি মাত্র সাত দিনের, অর্থাৎ গত ২৬ জুলাই পর্যন্ত হিসাব করা হবে। আর এরমধ্যে সরকার কারখানা খুলে দেওয়া সিদ্ধান্ত না নিলে আগামী ৫ আগস্ট পর্যন্ত চলমান লকডাউনের অবশিষ্ট দিনগুলি সাধারণ ছুটি হিসেবে গণ্য করা হবে।
আবার ৫ আগস্টের পর সরকার কারখানা সচল করার সিদ্ধান্ত নিলে, শ্রমিকদের মাসের প্রথম সাত কার্যদিবসের বেতন আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে চলে আসবে।
তবে পোশাক শিল্পের উভয় সংগঠনই জানিয়েছে তাদের সদস্যরা বিদ্যমান বিধিমালা মেনে চলবে এবং আগামী ১ আগস্ট থেকে কারখানা খুলে দিতে তারা সরকারের সঙ্গে আলোচনাও করছে।
এনিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে আলাপকালে বিজিএমইএ প্রেসিডেন্ট ফারুক হাসান বলেন, "১ আগস্ট থেকে কারখানা খুলে দিতে আমরা সরকারকে অনুরোধ করছি। নাহলে অনেক কারখানা নিয়মিত মজুরি ও ছুটির ব্যাপারে শ্রম আইনের আশ্রয় নিতে পারে।"
তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, সরকার ১ আগস্ট থেকে পুনরায় কারখানা চালুর অনুমতি দিলে সংগঠনটি অতিরিক্ত ছুটি হিসাবে জুলাইয়ের শেষ চার-পাঁচ দিন বিবেচনা করার জন্য নিজ সদস্যদের অনুরোধ করবে।
বিকেএমইএ ভাইস প্রেসিডেন্ট ফজলে শামিম এহসানের কথাতেও ছিল বিজিএমইএ প্রেসিডেন্টের বক্তব্যের প্রতিধ্বনি।
তিনি বলেন, "ক্রেতাদের কাছ থেকে আমরা নির্ধারিত সময়ে পণ্যের জাহাজীকরণ নিয়ে চাপের মধ্যে ছিলাম। এই অবস্থায় কিছু পণ্য বিমানে পাঠানোর পরিস্থিতি তৈরি হয়, কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সেটাও স্থবির হয়ে পড়েছে।"
এছাড়া, বন্দর থেকে দ্রুত আমদানি করা কাঁচামাল/যন্ত্রপাতি খালাস না করা হলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জরিমানা আরোপের হুমকি দিচ্ছে বলেও জানান তিনি। আবার, সড়ক পরিবহনেও সমস্যায় পড়ছে তাদের বাণিজ্যিক পণ্য আনা-নেওয়া।
শ্রমিক অসন্তোষের ঝুঁকি:
শ্রমিক নেতারা বলছেন, ১৪ দিনের লকডাউনের পরও যদি সরকার কারখানা চালু করতে না দেয়, তাহলে শ্রম আইনের আওতায় মালিকেরা মজুরি কর্তন ও দেরিতে বেতন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, যা কঠোর আন্দোলন করে রুখে দেওয়া হবে।
শ্রমিক সংগঠন- আওয়াজ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরচালক নাজমা আক্তার জানান, গেল বছরের ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটিতে শ্রমিকেরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
"তাই আমরা সরকারের কাছে অনুরোধ জানাই, কারখানা মালিকেরা এবার যেন লকডাউনের সুযোগ নিয়ে তা আরেকবার পুনরাবৃত্তি করার সুযোগ না পায়।
তিনি আরও জানান, এব্যাপারে তার সংগঠন বৃহস্পতিবার (২৯ জুলাই) শ্রম ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেবে। নিয়মিত মজুরির বদলে কম টাকা দিলে আসন্ন শ্রমিক অসন্তোষের কথাও উল্লেখ থাকবে চিঠিতে।
বাংলাদেশ জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক-কর্মচারী লীগ এর সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি বলেন, "লে-অফের মাধ্যমে শ্রমিকের পাওনা কমিয়ে দেওয়া আমরা মেনে নেব না। রাষ্ট্র কারখানা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত দিয়েছে, এখন কারখানা মালিকরা অক্ষম হলে, দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতে হবে। সরকার সব জায়গায় ভর্তুকি দিতে পারে, এখানেও দিক।" শ্রমিকদের ছুটির ইস্যুটি নিয়ে মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে সমন্বয়ের ঘাটতি ছিল বলেও মতপ্রকাশ করেন তিনি।
এনিয়ে বেশকিছু কারখানার মালিক বিকেএমইএ ভাইস প্রেসিডেন্ট ফজলে শামিম বলেন, তারা "কাজ নেই, তো বেতনও নেই" এমন সিদ্ধান্ত নিতে চান, তবে সংগঠন হিসেবে বিকেএমইএ তাদের আইন মেনে চলতে বাধ্য করার কর্তৃত্ব রাখে, তবে এর বাইরে সংগঠনের কোনো এক্তিয়ার নেই।"
"আমরা দেশের আইন মেনে ব্যবসা করতে চাই, কিন্তু কোনো শ্রমিক সংগঠন যদি তার বাইরে গিয়ে বাড়তি কোনো সুবিধা আদায় করতে চায়; তাহলে তাদের উচিত তা নিয়ে সরকারের দ্বারস্থ হওয়া," যোগ করেন তিনি।
এনিয়ে বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটির নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আখতার বলেন, "গত বছরের মতো করে মূল বেতনের মাত্র ৬০-৬৫ শতাংশ দেওয়া আমরা এবার মেনে নেব না। কেন শ্রমিকরা বারবার প্রতিকূল পরিস্থিতির শিকার হবে!"
তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, সরকার সম্মুখসাড়ির যোদ্ধা হিসেবে কোভিড-১৯ টিকা নিবন্ধনের সুরক্ষা অ্যাপে শ্রমিকদের অন্তর্ভুক্ত না করে চরম অবহেলা করেছে। যেকারণে তারা বর্তমানে টিকা পেতেও নানান রকম চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে।
নাজমা আক্তার বলেন, ব্যবসায়ীরা শ্রমিকদের মানুষ বলেই গণ্য করেন না। আর সেকারণেই "গরিব মানুষ কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয় না" এমন মন্তব্য করেছিলেন বিজেএমইএ'র সাবেক সভাপতি রুবানা হক।
বাংলাদেশ অ্যাপারেল এক্সচেঞ্জ- এর প্রতিষ্ঠাতা ও মুখ্য নির্বাহী মোস্তাফিজ উদ্দিন বলেন, সরকার কারখানা খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে তা শ্রমিকদের মজুরি পরিশোধ, অন্য দেশে অর্ডার চলে যাওয়া ঠেকানো এবং এয়ারফ্রেইট খরচ কমানোর মতো অনেক সমস্যার সমাধান করবে।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, সরকারের কাছে শ্রমিকদের মধ্যে কোভিড সংক্রমণের তথ্য রয়েছে যা কর্তৃপক্ষকে কারখানার খোলার অনুমতি দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় সহায়তা করতে পারবে।
লকডাউনের সময় পণ্য ছাড় করানোর সুযোগ না থাকায় কারখানা বন্ধ অব্যাহত থাকলে বন্দরগুলিতে একটি বড় ধরনের কনটেইনার জট সৃষ্টি হতে পারে, বলেও উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি।