লুঙ্গির বাজিমাৎ, বেহাল অবস্থায় শুধু তাঁতীরা
অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা হাসিবুল হাসান গত ১৮ জুন রাজধানীর মৌচাকে প্রাইড শোরুমে এসেছিলেন চারটি লুঙ্গি কিনতে। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, 'চার বছর আগে অবসরের পর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পরামর্শক হিসেবে কাজ করছি। গত বছর করোনা শুরু হলে সবাই হোম-অফিস ধারণার সাথে পরিচিত হয়। এখন বেশীরভাগ সময় কাটে বাসায়। ঘর থেকে তেমন একটা বের হই না।'
তিনি বলেন, 'একসঙ্গে আমার জন্য দুইটি লুঙ্গি কিনলে প্রায় দুই বছর ব্যবহার করতে পারি অনায়াসে। কারণ বাসায় কম সময় থাকা হয়। কিন্তু করোনা শুরু হওয়ার পর আমার দুইটা লুঙ্গি এক বছরেরও কম টিকল'।
সাবেক এই ব্যাংকার বলেন, 'এখন দিন-রাত প্রায় ২৪ ঘন্টাই লুঙ্গি পরে থাকতে হয়। ফলে বেশী দিন টেকসই হচ্ছে না। সেজন্য এবার একটু দামী লুঙ্গি ক্রয় করলাম।'
হাসিবুল হাসানের কথা শেষ হলে প্রাইডের শোরুম ম্যানেজার ফজলুল হক বলেন, 'করোনা শুরু হওয়ার পর যে সময়গুলোতে শোরুম খোলা ছিল, তখন আমাদের লুঙ্গির ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়। স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অনেক বেশী পরিমাণ লুঙ্গি বিক্রি হচ্ছে'।
প্রাইড গ্রুপের একজন কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, 'সারাদেশে প্রাইডের ৪৭টি আউটলেট রয়েছে। যেগুলোতে প্রাইড গ্রুপের এইচ আর টেক্সটাইল মিল লিমিটেডের উৎপাদিত শাড়ি, থ্রীপিস, ওড়না ও লুঙ্গি বিক্রয় করা হয়। করোনা শুরু হওয়ার পর প্রায় সবগুলো আউটলেটেই অন্যান্য কাপড়ের চেয়ে লুঙ্গির বিক্রি ভালো হয়েছে। গত বছর প্রায় ৮০ লাখ পিস লুঙ্গি বিক্রি হয়েছে। এ বছর চাহিদা আরও বেশী'।
দেশে ও বিদেশে লুঙ্গির বাজারে এখন চাহিদা বেশী আলাউদ্দিন টেক্সটাইলের 'এটিএম লুঙ্গি', আমানত শাহ টেক্সটাইলের 'আমানত শাহ ও স্ট্যান্ডার্ড লুঙ্গি', পাকিজা টেক্সটাইলের 'পাকিজা লুঙ্গি', প্রাইড লুঙ্গি, স্মার্ট লুঙ্গি, সম্রাট লুঙ্গি, ডিসেন্ট, ইউনিক, রূহিতপুরী, অমর, বোখারী, ফজর আলী, অনুসন্ধান, জেএম, স্কাই, ওয়েষ্ট, তামাই, রংধনুসহ প্রায় ১২৫টি ব্র্যান্ডের লুঙ্গির।
আমানত শাহ টেক্সটাইলের একজন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, 'করোনার মধ্যে লুঙ্গির ব্যবসা বেশ ভালো হয়েছে। প্রতিবছর আমানত শাহ টেক্সটাইল প্রায় দুই কোটি লুঙ্গি উৎপাদন করে। গত বছর সেটি কমেনি। বরং গত বছরের শেষ দিক থেকে লুঙ্গির চাহিদা বেড়েছে'।
পাকিজা লুঙ্গি কালেকশনের ব্যবস্থাপক মেরাজুল হক মেরাজ জানান, 'শ্রমিকরা বেশরিভাগ গ্রামে চলে যাওয়ায় গতবছর করোনার শুরুতে লুঙ্গি উৎপাদনে একটু সমস্যা হচ্ছিল। অল্পদিনের মধ্যে শ্রমিকরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে পুরোদমে কাজে শুরু করলে সেটি কেটে যায়'।
তিনি বলেন, 'করোনার শুরুতে স্থানীয় বাজারে লুঙ্গি সরবরাহে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। বিকল্প উপায়ে লুঙ্গি সরবরাহ করতে হয়েছে। এছাড়াও এই সময় পাকিজা কালেকশন অনলাইনে লুঙ্গি বিক্রয়ে জোর দেওয়ায় ব্যবসা আগের চেয়ে ভালো হয়েছে'।
মহামারিতেও কমেনি রপ্তানি
বাংলাদেশ লুঙ্গি ম্যানুফ্যাকচারার্স, এক্সপোর্ট অ্যান্ড ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও আমানত শাহ গ্রুপের চেয়ারম্যান মোঃ হেলাল মিয়া টিবিএসকে বলেন, করোনাকালীন সময়ে শুধু দেশের বাজারে লুঙ্গির চাহিদা বাড়েনি, বিদেশের বাজারেও স্বাভাবিক সময়ের মতো লুঙ্গি রপ্তানি হয়েছে।
সংগঠনটির দেয়া তথ্য অনুসারে, দেশ ও বিদেশের বাজারে প্রতিবছর প্রায় সাড়ে ১০ কোটি পিস লুঙ্গি বাজারজাত করে দেশের বিভিন্ন লুঙ্গি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। ২০১৯ সালে প্রায় ২০০ কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়েছে। গত বছর সেটি কমেনি। গত বছর প্রায় ১১ কোটি পিস লুঙ্গি উৎপাদন ও সরবরাহ হয়েছে।
ভারত, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, কাতার, ওমান, বাহরাইন, দুবাই, ইরাক, কুয়েত, লিবিয়া, ইন্দোনেশিয়া, কানাডা, ইংল্যান্ড, আমেরিকাসহ বিশ্বের ২৫টি দেশে প্রতিবছর সোয়া দুই কোটি লুঙ্গি রপ্তানি হয় বলে জানা যায়।
বেশীরভাগ লুঙ্গির উৎপাদন হয় নরসিংদী, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলায়। লুঙ্গির সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার বসে নরসিংদীর বাবুরহাট, সিরাগঞ্জের শাহজাদপুর ও টাঙ্গাইলের করটিয়ায়। এসব বাজার থেকেই সারা দেশের পাইকারি ব্যবসায়ীরা লুঙ্গি কিনে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করেন।
নরসিংদী চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ এর প্রেসিডেন্ট মো. আলী হোসেন শিশির টিবিএসকে বলেন, 'করোনার কারণে সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় একটু সমস্যা হচ্ছিল। কিন্তু সরকারের কাছে নরসিংদী চেম্বার আবেদন করলে সমস্যা কেটে যায়। সারাদেশ থেকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা বাঁধাহীনভাবে বাবুরহাটে এসে লুঙ্গি কেনাকাটা করতে পারছে'।
এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত বাবুরহাটসহ নরসিংদীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ৫০০ কোটি টাকার বেশি লুঙ্গি বিক্রয় হয়েছে বলে জানান আলী হোসেন শিশির।
একই কথা বলেন পাবনা ও সিরাজগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ এর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
বাজার দখল করে আছে বড় ব্র্যান্ডগুলো
স্মার্ট লুঙ্গি কালেকশনের ব্যবস্থাপক শরীফুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, 'করোনার মধ্যে রাজধানীহ বিভিন্ন শহরে লুঙ্গির চাহিদা ও সরবরাহ বেশী হয়েছে। মফস্বল অঞ্চলে স্মার্ট লুঙ্গির চাহিদা করোনাকালেও আগের মতো আছে'। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, 'চাকরিজীবীরা বেশীরভাগ শহরে থাকেন। লকডাউনের কারণে বেশীরভাগ লোকজন ঘরে অবস্থান করছে'।
তিনি বলেন, 'গত বছর মফস্বল এলাকার পাইকাররা প্রায় ৩০ লাখ স্মার্ট লুঙ্গি কিনেছে। শুধু রাজধানীতেই প্রায় ১০ লাখ স্মার্ট লুঙ্গি সরবরাহ করা হয়েছে। এছাড়াও বিভাগীয় শহরগুলোতে আগের চেয়ে স্মার্ট লুঙ্গির চাহিদা বেড়েছে। এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত প্রায় ৩০ লাখ লুঙ্গির চাহিদা পূরণ করেছে স্মার্ট গ্রুপ। যা আগের বছরের চেয়ে ভালো। তবে গত ১ জুলাই কঠোর লকডউন শুরু হলে আবার ব্যবসায় বেশ মন্দা দেখা দিয়েছে'।
দেশে ১২৫টি ব্র্যান্ডের লুঙ্গি বাজারে থাকলেও রাজধানী ও এর পাশ্ববর্তী এলাকার বড় লুঙ্গি কারখানাগুলো সবচেয়ে ভালো ব্যবসা করেছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে- এটিএম লুঙ্গি, আমানত শাহ, স্ট্যান্ডার্ড, প্রাইড, পাকিজা, সম্রাট লুঙ্গি, ডিসেন্ট, ইউনিক, ফজর আলী, অনুসন্ধান, জেএম, স্কাই, ওয়েষ্ট, তামাই ও রংধনু প্রভৃতি।
বাংলাদেশ লুঙ্গি ম্যানুফ্যাকচারার্স, এক্সপোর্ট অ্যান্ড ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনের একজ্ন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশীরভাগেরই রাজধানীসহ বিভিন্ন শহরে নিজস্ব শোরুম রয়েছে। এছাড়াও তারা অনলাইনে লুঙ্গি বিক্রয় ব্যবস্থায় জোর দিয়েছে। আবার রপ্তানির ক্ষেত্রেও এই প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে।
ভালো নেই স্থানীয় তাঁতীরা
পাবনা জেলার হাতিগাড়া, বনগ্রাম, সান্যালপাড়াসহ প্রায় ২০টি এলাকায় স্থানীয় তাঁতীরা শাড়ি, গামছা ও লুঙ্গি উৎপাদন করে। পাবনা জেলা তাঁত শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি ইশতিয়াক হোসেন টিবিএসকে বলেন, 'পাবনার প্রায় ৪ লাখ শ্রমিক এই কাজে নিয়োজিত। করোনার শুরুর দিকে কাপড় তৈরির কাাঁচামাল সরবরাহে বেশ সমস্যা হচ্ছিল'।
তিনি বলেন, 'এখন করোনার কারণে তাঁতীরা লুঙ্গির সঠিক দাম পাচ্ছে না। উৎপাদন ঠিক থাকলেও তাঁতীরা ঠিকই কম লাভবান হচ্ছে। বেশ কষ্ট করে টিকে থাকতে হচ্ছে'।
সিরাজগঞ্জের পুকুরপাড়, নগরডালা, ডায়া, খুকনী, শিবপুর গাছপাড়াসহ প্রায় ৩৫টি এলাকায় তাঁত শিল্প রয়েছে। নরসিংদী জেলার প্রায় ৩০টি এলাকায় রয়েছে তাঁত শিল্প। প্রায় সাড়ে তিন লাখ শ্রমিক কর্মরত এসব তাঁতে।
নরসিংদী চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ এর প্রেসিডেন্ট মো. আলী হোসেন শিশির বলেন, 'স্থানীয় তাঁত শিল্প ভালো রাখতে সরকার প্রণোদনা দিয়েছে। এছাড়াও নরসিংদী বণিক সমিতি ও চেম্বার নানা উদ্যোগ নিয়েছে করোনার মধ্যে এই শিল্প চালু রাখতে'।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিআইএলএস) এর পরিচালক (গবেষণা ও উন্নয়ন) নাজমা ইয়াসমিন বলেন, 'দেশে তাঁত শ্রমিক কতজন রয়েছে তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। বলা হয়ে থাকে প্রায় ১৫ লাখ। করোনাকালে সরকার গার্মেন্টস মালিকদের প্রণোদনা দিলেও স্থানীয় তাঁত মালিক ও শ্রমিকরা কিছুই পায়নি বলে জানা গেছে। ফলে তারা বেশ কষ্টে আছে'।