সনদহীন ভারতীয় অর্গানিক তুলা আমদানির খেসারত দিচ্ছেন স্পিনিং মিল মালিকরা
অর্গানিক কটন হিসেবে অপেক্ষাকৃত বাড়তি দামে ভারতের রপ্তানিকারকদের কাছ থেকে আমদানি করার পর এখন ট্রানজেকশন সার্টিফিকেট (টিসি) বলে পরিচিত সনদ পাচ্ছে না বাংলাদেশের অন্তত ১৮ সুতা কারখানার মালিক ও আমদানিকারক।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) সূত্র জানিয়েছে, আমদানিকারক মিল মালিকরা টিসি সনদের জন্য বারবার সরবরাহকারীদের কাছে ধরনা দিয়েছে; কিন্তু তুলা রপ্তানির পর এক মাসের মধ্যে সনদ দেওয়ার নিয়ম থাকলেও এক বছর পরও সনদ পাননি আমদানিকারক টেক্সটাইল মিল মালিকরা।
ইতোমধ্যে ওই কটন দিয়ে সুতা ও কাপড় তৈরি করে তা বিদেশেও রপ্তানি হয়ে গেছে। বিদেশি ক্রেতাকে এই সনদ দিতে না পারায় বিপুল অঙ্কের আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি ভাবমূর্তি সংকটে পড়তে যাচ্ছেন বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা।
আমদানিকারকদের মতে, অর্গানিক হিসেবে রপ্তানি করলেও বাস্তবে তা না হওয়ায় এবং সম্প্রতি তুলার মান দেখভালকারী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের কড়াকড়ির কারণে সনদ দিতে পারছে না রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো।
বিটিএমএ জানিয়েছে, অর্গানিক কটনের সনদ পণ্য পাঠানোর পর একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বায়ারদের দিতে হয়। কিন্তু তা দিতে না পারায় ইতিমধ্যে ক্ষতিপূরণ চাইতে শুরু করেছেন কোনো কোনো বায়ার। একই সঙ্গে অর্ডার বাতিলের আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে। অথচ সনদের জন্য যোগাযোগ করা হলেও ভারতের রপ্তানিকারকদের কাছ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। আবার কেউ কেউ জাল সনদ দিয়েছে, যা কটনের সনদ সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান, কন্ট্রোল ইউনিয়নের নিজস্ব তদন্তে ধরা পড়ার পর বাতিল হয়েছে।
এ পরিস্থিতিতে নিজেদের উদ্বেগ জানিয়ে ও সমাধান চেয়ে বাংলাদেশে ভারতের দূতাবাস, কটন অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়া ও ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার্স অব কমার্স বাংলাদেশ (আইসিসিবি) সহ সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর কাছে গত মাসের শেষ দিকে চিঠি পাঠিয়েছে দেশের টেক্সটাইল মিল মালিকদের সংগঠন, বিটিএমএ।
চিঠিতে বিটিএমএ বলেছে, সংগঠনের সদস্য মিলগুলো অনৈতিক ও জালিয়াতির শিকার হয়েছে, যা অচিরেই বন্ধ করার উদ্যোগ নিতে হবে।
অর্গানিক কটনের সনদ দিতে না পরায় স্পিনিং মিলগুলোর আর্থিক ক্ষতির কারণে উভয় দেশের দ্বিপাক্ষিক বানিজ্য বাধাগ্রস্ত হতে পারে বলেও আশঙ্কার কথা জানিয়েছে বিটিএমএ।
সংগঠনটির সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন মতব্য করেন, "বিটিএমএ ভুক্ত সদস্য মিলগুলো প্রায়শই ভারত থেকে তুলা আমদানি করে থাকে। তাই এ ধরনের বিপুল আর্থিক ক্ষতির ঘটনা ভারতীয় তুলা রপ্তানিকারকদের সঙ্গে বাংলাদেশের সুতা উৎপাদকদের বাণিজ্যিক সম্পর্ককে চিড় ধরাবে। এ ঘটনা থেকে দুই দেশের সম্পর্কে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হতে পারে।"
বিদেশি ক্রেতাদের নির্বাচিত বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোতে অর্গানিক এ তুলা থেকে তৈরি সুতা সরাসরি বিক্রি করা হয়েছে, পরবর্তীতে এ থেকে উৎপাদিত পোশাক পণ্য রপ্তানিও হয়েছে।
বাংলাদেশি আমদানিকারকরা বলছেন, কম দাম হওয়ায় চাহিদার বেশিরভাগ অর্গানিক তুলা তারা ভারত থেকে আমদানি করেন। এর বাইরে সামান্য পরিমাণ তুলা অন্যান্য দেশ থেকেও আমদানি করা হয়।
বিটিএমএ'র হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ বিশ্ববাজার থেকে ৭৫ লাখ বেল কাঁচা তুলা আমদানি করেছে, যার এক-চতুর্থাংশের বেশি এসেছে ভারত থেকে। অবশ্য এর মধ্যে কী পরিমাণ অর্গানিক কটন আমদানি হয়েছে, সে তথ্য নেই বিটিএমএ এর কাছে।
আমদানিকারকরা জানান, ১৮টি বাংলাদেশি কোম্পানির ২৩টি এলসি'তে আমদানি করা প্রায় ১৬,১০০ টন তুলার টিসি সনদ দিচ্ছে না ভারতীয় রপ্তানিকারকেরা। মাত্র তিনটি রপ্তানিকারক সনদ দিলেও পরবর্তীতে তা জাল প্রমাণিত হয়।
মঙ্গলবার (২৪ আগস্ট) নাগাদ বাজার মূল্য অনুযায়ী প্রচলিত তুলার পাউন্ড প্রতি দর ১.০৫ ডলার, সে তুলনায় প্রতি পাউন্ড অর্গানিক কটনের দাম ১.৭৮ ডলার। সাম্প্রতিক বাজারদর অনুসারে হিসাব করলে দেখা যায়, ১৬ হাজার ১০০ টন আমদানিতে ৬ কোটি ৩০ লাখ ডলার খরচ পড়ছে।
নকল অর্গানিক কটন আমদানির শিকার হওয়ার তালিকায় রয়েছে দেশের অন্যতম বৃহৎ টেক্সটাইল ও পোশাক খাতের প্রতিষ্ঠান এনভয় টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি ভারতের এগ্রিটেক ইন্ডাস্ট্রিজ প্রাইভেট লিমিটেড ও গ্লোসি ইমপেক্স প্রাইভেট লিমিটেড- এর কাছ থেকে ৬০০ মেট্রিক টন অর্গানিক তুলা আমদানি করে।
এক বছর পর হলেও এগ্রিটেক ইন্ডাস্ট্রিজের কাছ থেকে এখনো টিসি সনদ পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে গ্লোসি ইমপেক্স সনদ দিলেও পরবর্তীতে তা জাল হওয়ায় বাতিল হয়ে যায়।
এব্যাপারে এনভয় টেক্সটাইল লিমিটেডের সরবরাহ চক্র প্রধান মো. আতাউর রহমান টিবিএস'কে বলেন, "ওই কটনে ফেব্রিক বানিয়ে আমরা বিদেশি বায়ারদের নির্বাচিত কারখানায় দিয়েছি, যা রপ্তানিও হয়েছে। অথচ ভারতের রপ্তানিকারকদের কাছ থেকে টিসি না পাওয়ায় আমরা বায়ারদের দিতে পারছি না। কটন সরবরাহকারীদের সঙ্গে যোাগাযোগ করলেও তাদের কাছ থেকে কোন সাড়া পাচ্ছি না। অন্যদিকে বায়াররা আমাদের কাছে টিসি চাচ্ছে।"
"আমাদের ধারণা ভারতীয় রপ্তানিকারকরা আমাদের নকল অর্গানিক তুলা সরবরাহ করেছেন। সেজন্যেই তারা আমাদের সনদ দিতে পারছে না।"
ভারতীয় রপ্তানিকারকদের অসাধুতার শিকার আরো দুটি প্রতিষ্ঠান- ম্যাকসন্স স্পিনিং মিলস লিমিটেড ও ইসরাক টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড।
ইসরাক টেক্সটাইল মিলসের সত্ত্বাধিকারী ফজলুল হক বলেন, "আমি মোট দেড় হাজার টন তুলা (অর্গানিক) আমদানি করছি। রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান টিসি দিলেও পরবর্তীতে তা বাতিল হয়ে যায়। আমার মতো, অনেকেই এ সমস্যার শিকার হয়েছেন। ইতোমধ্যেই, আমরা দেশের বাণিজ্যিক কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে যোগাযোগ করেছি, কিন্তু কোন সমাধান পাইনি।"
বিটিএমএ সূত্র জানিয়েছে, তারা অন্তত ৯টি কটন রপ্তানিকারকের নাম জানতে পেরেছে, যারা অর্গানিক কটনের সনদ দিচ্ছে না কিংবা জাল সনদ দিয়েছে। এ তালিকায় রয়েছে- এগ্রোটেক ইন্ডাস্ট্রিজ প্রাইভেট লিমিটেড, গুজরাট কটন কর্পোরেশন, অ্যাক্সিয়েটা কটন লিমিটেড, গ্লোসি ইমপেক্স প্রাইভেট লিমিটেড, ঘমশ্যাম এগ্রো রিসোর্সেস, বাসিল কোমোডিটিজ প্রাইভেট লিমিটেড, ক্রাটো ইমপেক্স লিমিটেড, শ্রী সালাসার বালাজি এগ্রো টেক এবং নরেন্দ্র ওভারসিজ।
এদিকে যে পরিমাণ অর্গানিক কটনের সনদ দেওয়া হচ্ছে, প্রকৃত পক্ষে সেই পরিমাণ উৎপাদন হচ্ছে কি না, এ নিয়ে প্রশ্ন ছিল অনেকদিন ধরেই। এমন পরিস্থিতিতে গত বছরের শেষ দিকে এ বিষয়ে তদন্ত চালায় গ্লোবাল অর্গানিক টেক্সটাইল স্ট্যান্ডার্ডস (জিওটিএস)। এতে দেখা যায়, ভারতের সরবরাহ করা ২০ হাজার মেট্রিকটন কটনের সার্টিফিকেশন সঠিক ছিল না।
বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান টিবিএস'কে বলেন, "সার্টিফিকেশন সমস্যা ছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববাজারে অর্গানিক তুলার দাম বেড়েছে। এজন্য আমাদের সদস্যদের অর্গানিক কটনের পোশাকের অর্ডার নেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা নিরুৎসাহিত করছি।"
"বিশ্বব্যাপী ক্রেতাদের মধ্যে অর্গানিক তুলা থেকে উৎপাদিত পোশাকের চাহিদা বাড়ায় ব্র্যান্ডগুলো অর্গানিক তুলায় তৈরি পোশাকের অর্ডার দিচ্ছে। এ কটনের দামও সাধারণ মানের তুলার চেয়ে বেশি। তুলা উৎপাদনে প্রচুর সার ও কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়, যা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক। কিন্তু অর্গানিক কটনে কোন ধরনের ক্ষতিকর সার ও কীটনাশক ব্যবহার করা হয় না। এজন্য এ তুলায় উৎপাদিত পোশাকে দিন দিন ক্রেতাদের আগ্রহ বাড়ছে। এ তুলার দাম সাধারণ মানের তুলার চাইতে বর্তমানে প্রায় ৪০ শতংশ বেশি।"