সুতাকল মালিকরা লোকসানে, চোরাচালান ও চাহিদা কমাকেই দায়ী করছেন
বিশ্ব অর্থনীতির মন্দাভাবের মধ্যে তৈরি পোশাকের চাহিদা কমায় – তার প্রভাব পড়েছে সুতার বাজারেও। ফলে বিপুল লোকসান দিতে হচ্ছে দেশের সুতাকল মালিকদের।
এ খাতের অভ্যন্তরীণরা জানান, বিক্রি কমায় প্রায় প্রতিটি সুতাকলে সুতার অতিরিক্ত মজুদ জমা হয়েছে। ফলে মুনাফা তো নয়ই, প্রতি কেজিতে গড়ে ০.৭০ ডলার করে লোকসান হচ্ছে।
এছাড়া প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে চোরাইপথে সুতাসহ বস্ত্রসামগ্রী অবৈধভাবে আমদানির অভিযোগ উঠেছে। আবার তাঁত সমিতির নামে শুল্কমুক্ত সুবিধায় বিপুল পরিমাণ সুতা আমদানি হচ্ছে, যা তাঁতিদের না দিয়ে খোলাবাজারে বিক্রি করে দেওয়াও স্থানীয় টেক্সটাইল মিলগুলোর সংকট বাড়িয়েছে বলেও মনে করা হচ্ছে।
এর মধ্যে নতুন করে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি গ্যাসভিত্তিক এ শিল্পের উদ্যোক্তাদের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করেছে।
টেক্সটাইল মিলগুলোর মধ্যে পুঁজিবাজারে রয়েছে, এমন কিছু প্রতিষ্ঠানের আয় কমে যাওয়ার খবরও পাওয়া গেছে।
এমন পরিস্থিতিতে গত সপ্তাহে জরুরি সভা করেছে এ খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ)।
বৈঠকে উপস্থিত একাধিক নেতা সুতার অবৈধ আমদানি ও স্টকপাইল নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। এছাড়া সংগঠনটি অতিরিক্ত মজুদের তথ্যও সংগ্রহ করছে মিল মালিকদের থেকে।
বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'তথ্য সংগ্রহের পর বিষয়টি নিয়ে আমরা সংবাদ সম্মেলন করবো'।
'বাজারে বিদেশ থেকে আসা প্রচুর সুতা আছে, অথচ এত আমদানি হয়নি' – জানিয়ে তিনি বলেন, 'বিষয়টি নিয়ে আমরা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) বন্ড কমিশনারেট অফিসের সঙ্গে বৈঠক করবো'।
এছাড়া চাহিদা কমে যাওয়ায় সুতার দাম কমে গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'তুলা থেকে প্রতি কেজি সুতা প্রসেসিংয়ে যে খরচ হচ্ছে, তার পুরোটাই লস হচ্ছে। এখন কটন আর ইয়ার্নের দাম প্রায় সমান'।
ইশরাক স্পিনিং মিলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুল হক বলেন, '৫০ থেকে ৬০ শতাংশ সক্ষমতায় কারখানা চালানোর পরও প্রচুর ইয়ার্ন স্টক হয়ে গেছে। অর্ডার কমেছে প্রায় ৩৫ শতাংশ'।
তিনি বলেন, চাহিদা কমায় ক্রমাগত কমছে সুতার দাম। প্রতি কেজি সুতায় (৩০ কাউন্ট) গড়ে ০.৭০ ডলার করে লোকসান গুণতে হচ্ছে।
সুখবর নেই আগামী মাসগুলোতেও
স্পিনিং মিল মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অর্ডার খরার এ অবস্থা সহসা ভালো হওয়ার লক্ষণও দেখছেন না তারা।
বিটিএমএ সভাপতি বলেন, 'আগামী জুন পর্যন্ত সুতার বাজার ভালো হওয়ার সম্ভাবনা নেই।'
পোশাক খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তাদের হাতে পর্যাপ্ত ক্রয়াদেশ নেই। এজন্য তারা সুতা কিংবা কাপড় ক্রয় কমিয়ে দিয়েছেন।
নারায়ণগঞ্জ-ভিত্তিক নিট পোশাক প্রস্তুতকারক প্লামি ফ্যাশনস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুল হক টিবিএসকে বলেন, 'আগামী তিন-চার মাসে অর্ডার পরিস্থিতি ভালো হওয়ার লক্ষণ নেই'।
'আমাদের রপ্তানি কম হলে স্বাভাবিকভাবেই সুতা বিক্রি কমবে এবং বর্তমানে তাই হচ্ছে' – যোগ করেন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) এর সাবেক এই প্রেসিডেন্ট।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো'র (ইপিবি) হিসাব অনুযায়ী, গত মার্চের পর এপ্রিলেও তৈরি পোশাকের রপ্তানি কমেছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৭ শতাংশ। পোশাক রপ্তানিকারকরা বলছেন, আগামী তিন থেকে চার মাসেও রপ্তানি পতনের এ ধারা অব্যাহত থাকতে পারে।
পোশাক রপ্তানির পরবর্তী দুই থেকে চার মাসের গতিধারা বোঝার উপায় হলো- কাঁচামাল ব্যবহারের ঘোষণা যা ইউটিলিটি ডিক্লারেশন বা ইউডি হিসেবে পরিচিত। ইইডি এখন ২৫ শতাংশ কম বলে টিবিএস'কে জানিয়েছেন বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ)-র সহ-সভাপতি মো. শহিদুল্লাহ আজিম।
তুলার দাম কমছে, তবুও কেন লোকসান
আইস ফিউচার্স এর তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরের তুলনায় তুলার দাম কমেছে প্রায় ২৬ শতাংশ। এছাড়া গত ছয় মাসের হিসাবে দাম প্রায় স্থিতিশীল ছিল। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার প্রতি পাউন্ড তুলার দাম ছিল শূন্য দশমিক ৮২ ডলার।
দাম কমে আসা সত্ত্বেও কেন লোকসান হচ্ছে, এর ব্যাখ্যায় লিটল স্টার স্পিনিং মিলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান খোরশেদ আলম টিবিএস'কে বলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তুলার বুকিং দিতে হয় তিন মাস থেকে ১ বছর আগে। যারা আগে বুকিং দিয়েছেন, তারা এখন বেশি লোকসান গুনছেন।
তিনি জানান, "বর্তমান দরে কটন বুকিং দিলে প্রতি পাউন্ডের সিএন্ডএফ প্রাইস (চট্টগ্রাম বন্দরে আসা পর্যন্ত দাম) পড়বে ১ ডলারের সামান্য বেশি। কিন্তু, গত ছয় মাস বা তারও কিছু আগে যে বুকিং দিয়েছি, তার প্রতি পাউন্ড কটনে দাম পড়েছে ১.৪২ ডলার।"
রাইজিং স্পিনিং মিলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদ হাসান খান বাবু জানান, ৭৫ শতাংশ তুলাই বুকিং বা ইনডেক্স এর দর অনুযায়ী কেনা হয়। বাদবাকী খোলাবাজারে কেনা হয়।
তিনি হিসাব করে জানান, বর্তমানে প্রতি কেজি সুতা বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ৩.১৫ ডলারে। কিন্তু, উৎপাদন খরচ ৪ ডলারের কাছাকাছি। প্রতি কেজিতে লোকসান হচ্ছে কমবেশি ০.৭০ ডলার।
সাম্প্রতিক গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধিও উদ্যোক্তাদের লোকসান বাড়িয়ে দিয়েছে বলে জানান সুতাকল মালিকরা।
এনভয় টেক্সটাইলস লিমিটেডের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, 'আগে প্রতিষ্ঠানের মাসে গ্যাস বিল ছিল ৪ কোটি টাকা। এখন একই পরিমাণ গ্যাস ব্যবহারে দিতে হবে ৮.৫ কোটি টাকা'।
অবশ্য গত বছরে যখন মহামারির প্রকোপ হ্রাস পেতে থাকে, তখন পোশাকের চাহিদা বাড়ায় তুলার দামও বিপুল হারে ঊর্ধ্বমুখী হয়, এসময়ে স্পিনিং মিল মালিকরা ভালো মুনাফা করেছেন।