সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ছাড়া গাড়ি, বেতনে বিপুল অর্থ অপচয়ের পর প্রকল্প বন্ধ ঘোষণা
সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ি ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে ১৫০ মেগাওয়াটে উন্নীত করতে একটি প্রকল্পের বাস্তবায়ন শুরু হয় ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে। ৫৪১ কোটি টাকার প্রকল্পটি দুই বছরে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ৮ বছরেও কোনো অগ্রগতি না থাকায় গত নভেম্বরে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন ছাড়াই সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়।
নির্মাণ কাজের জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্রে ঠিকাদাররা যে দর প্রস্তাব করে, তা মূল প্রকল্পের বরাদ্দের চেয়ে বেশি হওয়ায় শেষ পর্যন্ত ঠিকাদার নিয়োগ দেয়া সম্ভব হয়নি। প্রকৃত ব্যয়, বাস্তবায়নযোগ্যতা, বাস্তবায়নের পর আদৌ কোন সুফল আসবে কি না, এসব যাচাই না করেই প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়েছিল।
প্রকল্পের সমাপ্তি ঘোষণা হলেও এর মধ্যে গাড়ি কেনা, ভূমি উন্নয়ন এবং পরামর্শক খাতে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা ব্যয় হয়ে গেছে।
সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ছাড়া নেয়া এরকম আরো বেশ কিছু প্রকল্পের পরিণতিও সাম্প্রতিক সময়ে একই রকম হয়েছে। বাস্তবায়নে অগ্রগতি না থাকলেও গাড়ি কেনা, বেতন-ভাতা, পরামর্শকদের পেছনে বিশাল অর্থ ব্যয় করে প্রকল্পগুলো সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে।
সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প সম্পর্কিত পরিপত্র অনুযায়ী, প্রকল্প ব্যয় ২৫ কোটি টাকার বেশি হলে তার সম্ভাব্যতা সমীক্ষা বাধ্যতামূলক। তবে এ নিয়ম মানছে না বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। সমীক্ষা ছাড়া প্রকল্প নেয়ায় সেগুলো বাতিল করা ছাড়াও বারবার প্রকল্প সংশোধন করতে হয়।
সমীক্ষা ছাড়া প্রকল্প না নেয়ার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কঠোর নির্দেশনাও রয়েছে। তারপরও সমীক্ষা ছাড়াই বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবের অনুমোদনের ভিত্তিতেই প্রকল্প প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হচ্ছে। প্রভাবশালী মহলের চাপের মুখে পরিকল্পনা কমিশন এ ধরণের প্রকল্প অনুমোদন দিতে বাধ্যও হচ্ছে।
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানও স্বীকার করেন, প্রকল্প হাতে নেয়ার আগে সম্ভাব্যতা সমীক্ষার বাধ্যবাধকতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা আছে। তবে এক্ষেত্রে পরিকল্পনা কমিশনেরও কিছু সীমাদ্ধতা আছে বলে তিনি জানান।
তিনি বলেন, 'পরিকল্পনা কমিশন কোনো উন্নয়ন প্রকল্প আটকে দিতে চায় না। দ্রুত প্রকল্প বাস্তবায়নের স্বার্থে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ছাড়াই অনেক সময় প্রকল্পের অনুমোদন দিয়ে দিচ্ছে কমিশন'।
তবে এক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, 'তারা তো সরকারেই অংশ। তারা কেন সমীক্ষা ছাড়া প্রকল্প পাঠায়। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা তাদেরও মানা উচিত'।
সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প থেকে কতোটা সুফল পাওয়া যাবে, ব্যয় ও বাস্তবায়ন কৌশল কি হবে, সম্ভাব্যতা সমীক্ষা থেকেই তা থেকে ধারণা পাওয়া যায়। কিন্তু অনেক সময় যেনতেন সমীক্ষা বা সমীক্ষা ছাড়াই প্রকল্প প্রস্তাব প্রণয়ন করে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ।
বাঘাবাড়ি প্রকল্পটি নিয়ে একটি মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরি করেছে আইএমইডি। এতে বলা হয়, প্রকল্পের কাজ শুরুর পাঁচ বছর পর বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) উপলব্ধি করে মাত্র ৫০ মেগাওয়াট বাড়তি বিদ্যুতের জন্য প্রকল্পটি লাভজনক হবে না। প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রকল্পের এমনকি দরপত্র প্রক্রিয়াও শেষ হওয়ার আগেই প্রকল্প প্রস্তাবে থাকা সব গাড়ি কেনা হয়ে গেছে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সদস্য (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) মোস্তাক মোহাম্মদ অবশ্য দাবি করেছেন, প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা সমীক্ষা হয়েছিল। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী গ্যাসের সরবরাহ পাওয়া যাবে না বলে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে অগ্রগতি হয়নি।
একই পরিণতি হয়েছে রাষ্ট্রায়াত্ত্ব ঠাকুরগাঁও ও নাটোরের নর্থবেঙ্গল চিনিকল আধুনিকায়নের দুটি প্রকল্পেও। কাজের অগ্রগতি না থাকলেও বেতন-ভাতা ও গাড়ি কেনায় ২৫ কোটি টাকা খরচ করার পর প্রকল্প দুটির সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। এই দুটি প্রকল্পও যথাযথ সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ছাড়া গ্রহণ করা হয়।
ঠাকুরগাঁও চিনিকলের আধুনিকায়নে ১০১ কোটি টাকার প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন পায় ২০১৩ সালে। কাজের কোনো অগ্রগতি না থাকলেও ২০১৬ সালে প্রকল্পটি প্রথমবার সংশোধন করে ব্যয় বাড়িয়ে ধরা হয় ৪৮৬ কোটি টাকা। গত বছরের ডিসেম্বরে প্রকল্প বাস্তবায়ন সংস্থা খাদ্য ও চিনি শিল্প কর্পোরেশন ব্যয় মূল প্রকল্পের ১২ গুণ বাড়িয়ে ১২০২ কোটি টাকার দ্বিতীয় সংশোধনী প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠায়।
এ পর্যন্ত এ প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি মাত্র ৩% বা ১৫ কোটি টাকা। প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি ১৭ শতাংশ। এই পরিস্থিতিতে পরিকল্পনা কমিশন দ্বিতীয় সংশোধনী প্রস্তাব অনুমোদন না করে প্রকল্পটি সমাপ্ত সমাপ্ত ঘোষণা করে।
নর্থ বেঙ্গল চিনিকলে কো-জেনারেশন পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং সুগার রিফাইনারি স্থাপনের প্রকল্পটি অনুমোদন পায় ২০১৪ সালে। প্রকল্প ব্যয় ছিল ৭৩ কোটি টাকা।
প্রকল্পটি প্রথমবার সংশোধন করে ব্যয় বাড়িয়ে ৩২৪ কোটি টাকা করা হয়। বাস্তবায়ন কাজে কোনো অগ্রগতি না থাকলেও গত জানুয়ারিতে ব্যয় বাড়িয়ে ৯২৬ কোটি টাকা করে সংশোধনী প্রস্তাব পাঠানো হয়, যা মূল বরাদ্দের চেয়ে ১৩ গুণ বেশি।
প্রকল্পটিতে এ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৯.৭৩ কোটি টাকা, আর কাজের অগ্রগতি ৩%।
দেশে এখন চাহিদার তুলনায় বেশি চিনি উৎপাদিত হচ্ছে। দেশে উৎপাদিত চিনির ৯৫ শতাংশই সরবরাহ করছে বেসরকারি খাতের চিনিকলগুলো। এ অবস্থায় সরকারি চিনিকলে বিনিয়োগ কতোটা লাভজনক হতো, তার যথাযথ সমীক্ষা প্রকল্প নেয়ার আগে হয়নি।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিডিপি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, 'সরকারি চিনিকলের অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি বজায় রেখে শুধু আধুনিকায়ন থেকে কোনো চিনিকলকেই লাভজনক করা যাবে না'।
প্রকল্প দুটির সমাপ্তি ঘোষণা ভালো উদ্যোগ উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকারি কলের চিনির উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় প্রতিযোগিতায় এগুলো টিকতে পারবে না। তাতে প্রকল্প দুটিতে দুই হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ সরকারি অর্থের অপচয়ই বাড়াতো।
পুরান ঢাকার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় রাসায়নিক গুদামগুলো সরিয়ে নিতে মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানে কেমিক্যাল ইন্ডাষ্ট্রিয়াল পার্ক গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে বিসিক।
অন্তর্বতী সময়ে কেমিক্যাল সংরক্ষণের জন্য ৭৯.৪১ কোটি টাকা ব্যয়ে ঢাকার শ্যামপুরে উজালা ম্যাচ ফ্যাক্টরির জায়গায় অস্থায়ী গুদাম নির্মাণের প্রকল্প নেয়া হয় ২০১৯ সালের মার্চে।
যে স্থানটিতে গুদাম নির্মাণের কথা ঠিক তার পাশেই পোস্তগোলা সেনানিবাস। গোডাউনের কারণে মেরিন ওয়ার্কশপসহ সেনানিবাসের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ কারণে সেনাবাহিনী প্রকল্পটিতে আপত্তি জানিয়েছে। প্রকল্পে ইতোমধ্যেই প্রায় চার কোটি টাকা খরচ হয়ে গেছে।
আইএমইডি সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, সেনানিবাসের পাশে এই প্রকল্প নেয়ার আগে স্থান যাচাই-বাছাইয়ের কোনো কাজ করা হয়নি। ১৬ মাসে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। কাজের তেমন কোনো অগ্রগতিও নেই। মুন্সিগঞ্জে কেমিক্যাল পার্ক স্থাপনের কাজও অনেকটা এগিয়ে গেছে। এ অবস্থায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে সরকারি অর্থের অপচয়ই কেবল বাড়বে। এ কারণে প্রকল্পটি সমাপ্ত ঘোষণা করাই যৌক্তিক হবে।
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বর্তমানে এমন আরো অনেক প্রকল্প আছে, যেগুলোর সাম্ভাব্যতা সমীক্ষা হয়নি। এ ধরণের অনেক প্রকল্পের মেয়াদ এবং ব্যয়ও একাধিকবার বাড়ানো হয়েছে।
আইএমইডি সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, 'সম্ভাব্যতা ছাড়া প্রকল্প নেয়ার কারণে ব্যয় বাড়ে, অর্থের অপচয় হয়। এ ব্যপারে সতর্ক হতে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে বারবার তাগিদও দেয়া হচ্ছে। কিন্তু এখনো অনেক প্রকল্প অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী মন্ত্রণালয়গুলোর পাশাপাশি এর দায় পরিকল্পনা কমিশনকেও নিতে হবে। কমিশন অনেক সময় বিষয়টা এড়িয়ে যায়। এজন্য পরিকল্পনা কমিশনকে আরো কঠোর হতে হবে'।