সরবরাহ সংকটে চার দিনে বস্তাপ্রতি চালের দাম বেড়েছে ২০০ টাকা
শুল্ক কমিয়ে বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি শুরুর পর কিছুটা চাপ কমে এসেছিল চালের বাজারে। কাঙ্খিত দাম না কমায় চালের শুল্ক আরও কমিয়ে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। তবে পর্যাপ্ত আমদানি না হওয়া, বৈশ্বিক বাজারে চালের দাম বৃদ্ধির কারণে আশানুরূপ কমেনি চালের দাম। এমনকি সম্প্রতি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধিতে দেশব্যাপী লকডাউন এবং সর্বশেষ আজ (১৪ এপ্রিল) থেকে সর্বাত্মক সাধারণ ছুটির ঘোষণায় অস্থির হয়ে উঠেছে চালের বাজার। এরমধ্যে চার দিনের ব্যবধানে চালের পাইকারি ও খুচরায় দাম বেড়েছে বস্তাপ্রতি প্রায় ২০০ টাকা। মূলত অল্প সময়ে স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি চাহিদা, পর্যাপ্ত মজুদের অভাব, সরবরাহ চেইনে ঘাটতির কারণে পণ্যটির দাম বেড়েছে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
দেশে ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জের বিভিন্ন আড়তে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সর্বশেষ ৫ এপ্রিল থেকে এক সপ্তাহের লকডাউন ঘোষণা করে সরকার। এরপর থেকে সারাদেশের পাইকারি ও খুচরা বাজারের চালের সরবরাহ চেইন ভেঙে পড়ে। মূলত ব্যবসায়িকভাবে পাইকারিতে চাল-সহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম নির্ধারিত হয় সরবরাহ ব্যবস্থাপনা, বাকিতে পণ্য বিক্রি কিংবা চেকের বিপরীতে সরবরাহ চুক্তির মাধ্যমে। স্বাভাবিক সময়ে চালের বড় মোকামগুলোতে একটি বা দুটি লেনদেন বাকিতেই পরিচালিত হয়। পণ্য ক্রয়ের পর সেটি মোকামে আসলে বিক্রি সাপেক্ষে কিস্তিতে চেক নগদায়নের মাধ্যমে লেনদেন এগিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু লকডাউন ঘোষণার পর মোকাম থেকেই বাকিতে পণ্য বিক্রি কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে। তাছাড়া হঠাৎ করেই বাড়তি চাহিদা ছাড়াও ব্যাংকিং লেনদেনের সময়সীমা কমে যাওয়ায় দেশের ভোগ্যপণ্য বাজারে নগদ অর্থের সাময়িক সংকট দেখা দিয়েছে। যার কারণে মিল পর্যায় থেকে পাইকারি বাজার এমনকি খুচরা বাজারেও বাকিতে নিত্য পণ্য বিক্রির পরিমাণ কমে গেছে। যার প্রভাবে চালের বাজার ঊর্ধ্বমুখী বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।
খাতুনগঞ্জ এলাকার পাইকারি চাল ব্যবসায়ী ওমর আজম বলেন, ১৪ এপ্রিল থেকে সর্বাত্মক লকডাউনের আগে প্রায় প্রতি বস্তা চালের দাম বেড়েছে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। নতুন আমদানিকৃত চালের পাশাপাশি আমন মৌসুমের উৎপাদিত নতুন চালের দামও বর্ধিত দামে বিক্রি হচ্ছে পাইকারি বাজারে। পাইকারি বাজারে বেড়ে যাওয়ায় খুচরা বাজারে পাইকারির বর্ধিত দামের চেয়েও বেশি দামে চাল বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। যার প্রভাবে লকডাউনের আগে চাল ক্রয়ে বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে সাধারণ ভোক্তাদের।
এর মধ্যে গত কয়েক দিনের ব্যবধানে জিরা সিদ্ধ চালের দাম বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) ১৫০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ১৫০ টাকায়, পারি সিদ্ধ (নতুন) ৫০ টাকা বেড়ে ২ হাজার ৩৫০ টাকায়, পারি সিদ্ধ (পুরাতন) ৫০ থেকে ৭০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৪৭০ টাকায়, স্বর্ণা সিদ্ধ প্রায় ২০০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছেন ২ হাজার ২৯০ টাকায়, মিনিকেট সিদ্ধ ১৬০ টাকা বেড়ে ২ হাজার ৫৬০ টাকায়, কাটারি সিদ্ধ (২৫ কেজির বস্তা) ২০০ টাকা বেড়ে ১ হাজার ৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
অপর দিকে আতপ চালের মধ্যে বেতি আতপ (পুরাতন) বস্তাপ্রতি ২০০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৭০০ টাকায়, নতুন বেতি আতপ বিক্রি হচ্ছে মানভেদে ২ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ৬০০ টাকায়, মিনিকেট আতপ ১৫০ টাকা বেড়ে ৩ হাজার ১০০ টাকায়, ইরি আতপ ১৬০ টাকা বেড়ে ২ হাজার ১৫০ টাকায়। তাছাড়া ভারত থেকে আমদানি হওয়া বেতির কস্টিং মূল্য কম হলেও বর্তমানে পাইকারি বাজারে এই মানের চাল বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৩০০ থেকে ২ হাজার ৩৫০ টাকায়। অন্যদিকে ভারত থেকে আমদানি হওয়া নাজির সিদ্ধ চালের ২৫ কেজির বস্তা বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৪৭০ থেকে ১ হাজার ৪৮০ টাকায়। কয়েকদিন আগেও ভারতীয় এই চালটির ২৫ কেজির বস্তা বিক্রি হয়েছিল মাত্র ১ হাজার ৩৫০ টাকা দরে। মূলত লকডাউন শুরু হলে দেশের উত্তরাঞ্চল থেকে চাল সরবরাহ কমে যাওয়ার প্রেক্ষিতে সারাদেশের পাইকারি বাজারগুলোতে প্রতিদিনই চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে ব্যবসায়ীরা। পূর্বের কম দামে ক্রয় করা চাল বিক্রির পর বেশি দামে সংগ্রহ করতে হবে এই চিন্তা থেকেই পাইকারি ব্যবাসায়ীরা চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
খাদ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালের ৭ নভেম্বর থেকে আমন সংগ্রহ কার্যক্রম শুরু হয়। চলতি বছরের ১৫ মার্চ পর্যন্ত ৭০ হাজার ১৩৬ টন আমন সিদ্ধ চাল, ৪ হাজার ৮৬৩ টন আতপ চাল এবং ১২ হাজার ৩৪২ টন আমন ধান সংগ্রহ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে সরকারি পর্যায়ে চাল সংগ্রহ হয়েছে মাত্র ৮৩ হাজার ২০২ টন। সরকারি পর্যায়ে গত কয়েক মৌসুম ধরে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী চাল সংগ্রহ করতে পারেনি। ২০২০ সালের বোরো মৌসুমে সরকার ১৮ লাখ টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। কিন্তু সরকার ১০ লাখ টনের বেশি চাল সংগ্রহ করতে পারেনি। এর মধ্যে সরকারি চালের মজুদ ৫ লাখ টনের নিচে নেমে আসলে বেসরকারি ভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে চাল আমদানির সুযোগ দেয় সরকার। এর মধ্যে কয়েক দফায় চাল আমদানির শুল্ক কমানো হলেও বৈশ্বিক দাম বৃদ্ধি ছাড়াও আমদানি প্রক্রিয়ার জটিলতার কারণে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী চাল আমদানি হয়নি।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, চলতি মাসের ১১ এপ্রিল পর্যন্ত ৪ দশমিক ৮২ খাদ্য শস্য মজুদ রয়েছে। যেখানে ৩ দশমিক ৭২ লাখ টন ধান ও বাকিগুলো গম।
চট্টগ্রামের চকবাজার এলাকার বাসিন্দা নুসরাত জাহান জানান, 'গত ছয় মাস আগে শঙ্খ মার্কা বাসমতি চাল কিনেছি (৫০ কেজি বস্তা) ২২০০ টাকায়। ছয়মাসের ব্যবধানে একই চাল এখন ৩১৮০ টাকা। যা দুই মাস আগেও ২৮০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। অর্থাৎ ছয়মাসের ব্যবধানে প্রতিবস্তা চালের দাম ১০০০ টাকা বেড়ে গেছে'।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, সরকার চাল আমদানির শুল্ক ১০ শতাংশে নামিয়ে আনলেও জটিলতার কারণে আমদানি প্রক্রিয়া প্রতিযোগিতামূলক হয়নি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদনের প্রেক্ষিতে সরকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে চাল আমদানির অনুমতি প্রদান করছে। ফলে সরকারি অনুমোদনের দীর্ঘসূত্রিতা, সব ধরনের ব্যবসায়ীদের আমদানিতে অনীহার কারণে চালের আমদানিমূল্যও প্রকৃত মূল্যের চেয়ে বেড়ে যায়। এ কারণে সরকার বেসরকারি খাতে নিত্যপণ্য হিসাবে চালের আমদানি সুবিধা দিলেও সেটি কার্যকর হয়নি। তাছাড়া সর্বশেষ চলতি সপ্তাহে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যও চালের দাম বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে বলে অভিযোগ সাধারণ ব্যবসায়ীদের।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম রাইস মিল মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি ও পাইকারি চাল ব্যবসায়ী শান্ত দাশগুপ্ত বলেন, লকডাউনের ঘোষণার পর থেকে পাইকারি বাজারে চালের দাম বেড়েছে। আমদানি প্রক্রিয়া উন্মুক্ত না করে নির্দিষ্ট করে দেয়ায় প্রকৃত ব্যবসায়ীরা চাল আমদানি করতে পারেনি। এমনকি চাল আমদানির পরও বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে সরকারি সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো। একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীর ব্যবসায়ীর কাছে চালের বাজার দখল হয়ে যাওয়ায় সংকটকালীন সময়ে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখা মুশকিল বলে মনে করছেন তিনি।