সার্টিফিকেট নিবন্ধনের জটিলতায় থমকে আছে সম্ভাবনাময় হালাল খাদ্য রপ্তানি
বিশ্বব্যাপী হালাল পণ্যের বাজারে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য কোনো অবস্থান তৈরি করতে না পারলেও স্থানীয় ও বহুজাতিক শতাধিক প্রতিষ্ঠান হালাল খাদ্য উৎপাদন করছে। তবে হালাল পণ্যের রপ্তানিতে গতি আনতে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) সার্টিফিকেট প্রদানের ঘোষণা দিলেও এখনো পর্যন্ত মান ও পর্যবেক্ষক কমিটিই তৈরি করতে পারেনি।
ইসলামিক ফাউন্ডেশন সূত্রে জানা গেছে, ২০০৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ১৪০টি কোম্পানি হালাল পণ্যের সনদ নিয়েছে। এর মধ্যে খাদ্য পণ্য উৎপাদন ও বিপননের সঙ্গে জড়িত কোম্পানির সংখ্যা একশোর বেশি। এসব কোম্পানির উৎপাদিত হালাল ব্র্যান্ডের পণ্য রয়েছে প্রায় ৭০০টি।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের লাইসেন্স প্রাপ্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে, স্কয়ার, প্রাণ, এসিআই, বেঙ্গল মিট, বসুন্ধরাসহ বড় বড় কোম্পানিগুলোর পাশাপাশি নেসলে বাংলাদেশের মত বহুজাতিক কোম্পানিও রয়েছে।
হালাল পণ্যের বিশ্ববাজার ধরতে এবার ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পাশাপাশি বিএসটিআইও সার্টিফিকেট প্রদানের ঘোষণা দিয়েছে। তবে প্রতিষ্ঠানটিতে সার্টিফিকেটের জন্য আবেদন পড়লেও এখনো তারা হালাল পণ্যের স্ট্যান্ডার্ড ও পর্যবেক্ষণের জন্য কমিটি গঠন করতে পারেনি।
বিএসটিআইয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, বিশ্বব্যাপী মুসলিম দেশগুলো হালাল পণ্যের যে ধরনের স্ট্যান্ডার্ড মেইনটেইন করে সেগুলোকেই বিএসটিআই মেন্ডেড হিসেবে গ্রহণ করবে। কারণ বিএসটিআই থেকে যারা সার্টিফিকেট নেবে তাদের মূল লক্ষ্য রপ্তানি বাজার। হালাল সার্টিফিকেটের মাধ্যমে বিশ্ববাজারে রপ্তানি বৃদ্ধিই এই সার্টিফিকেটের মূল উদ্যেশ্য বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, বিএসটিআইয়ের ১৩ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি রয়েছে যারা বিভিন্ন পণ্যের মান পরীক্ষা করে সার্টিফিকেট প্রদান করে থাকে। এ কমিটির সদস্যসহ টেকনিক্যাল পারসন, ইসলামিক স্কলার, ইসলামিক ইউনিভার্সিটির অভিজ্ঞ শিক্ষক নিয়ে একটি অডিট টিম গঠন করা হবে।
এই অডিট টিম স্ট্যান্ডার্ড মেনে কাঁচামাল সংগ্রহ, উৎপাদন, কারখানা পরিস্থিতি, পণ্যের মান, বিপনন পদ্ধতি সহ বিভিন্ন বিষয় মনিটরিং করবে। যা ১৩ সদস্যবিশিষ্ট কমিটিতে পর্যালোচনা করা হবে। ধাপগুলো পূরণ করতে পারে এমন কোম্পানিকেই সার্টিফিকেট প্রদান করা হবে। তবে আবেদনকারীদের মধ্যে কোনো ঘাটতি থাকলে তা সংশোধনে পরামর্শও দেওয়া করা হবে।
অডিট টিম গঠন না হলেও ইতোমধ্যে খাদ্যপণ্যের রপ্তানিকারক ২০ টিরও বেশি কোম্পানি বিএসটিআইয়ে আবেদন করেছে বলে জানা গেছে।
দেশে হালাল খাদ্যেরর বাজার নিয়ে কোনো গবেষণা না থাকায় সনদধারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে এ বিষয়ে খুব একটা ধারণা পাওয়া যাচ্ছে না। তবে হালাল পণ্যের উৎপাদনকারীরা বলছেন, দেশের চেয়ে রপ্তানিতেই বেশি কাজে লাগে হালাল সার্টিফিকেট।
'স্টেট অব দ্য গ্লোবাল ইসলামিক ইকোনমি রিপোর্ট ২০১২০/২১' থেকে হালাল খাদ্যের বৈশ্বিক বাজার নিয়ে ধারনা পাওয়া যায়। এই রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালে বিশ্বব্যাপী হালাল খাদ্যের পেছনে ১.১৭ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করেছে ভোক্তারা। যা আগের বছরের তুলনায় ৩.১ শতাংশ বেশি।
তবে ২০২০ সালে করোনার কারণে হালাল খাদ্যের বিক্রি ০.২ শতাংশ কমবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যদিও ২০২৪ সাল পর্যন্ত এই বিক্রি ৩.৫ শতাংশ হারে বেড়ে ১.৩৮ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে বলে ধারনা করছে মুসলিম দেশগুলো। তবে খাদ্য, প্রসাধনি, পোশাক, ফার্মাসিকিউটিক্যালস সহ হালাল পণ্যের বর্তমান বাজার ২.০২ ট্রিলিয়ন ডলারের বলে 'স্টেট অব দ্য গ্লোবাল ইসলামিক ইকোনমি রিপোর্ট ২০১২০/২১' থেকে জানা গেছে।
বাংলাদেশের পণ্যের বিষয়ে জানতে চাইলে স্কয়ার ফুড অ্যান্ড বেভারেজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. পারভেজ সাইফুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'মুসলিম দেশ হিসেবে আমাদের দেশে স্বভাবতই হালাল খাবারের ব্যবস্থাপনাই সর্বত্র। তবে এক্ষেত্রে স্ট্যান্ডার্ড মেনে সার্টিফিকেট ভোক্তাকে আরও বেশি নিশ্চয়তা প্রদান করে।'
তিনি বলেন, 'স্কয়ারের সবগুলো পণ্যই বিদেশে রপ্তানি হয়। বিশ্বব্যাপী খাবারের বাড়তি চাহিদা থাকায় হালাল সার্টিফিকেশন ভালো ভূমিকা রাখে।'
হালাল ফুডের প্রস্তুতকারীরা বলছেন, হালাল সার্টিফিকেটের কারণে দেশের বাজারে ব্যবসা বৃদ্ধির চেয়ে উৎপাদনকারীরা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব প্রদান করে রপ্তানি বাজারে। কারণ বিভিন্ন দেশে হালাল খাদ্যের ভালো চাহিদা রয়েছে। এ কারণে সার্টিফিকেট খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
জানতে চাইলে বেঙ্গল মিটের সিইও এ এফ এম আসিফ টিবিএসকে বলেন, 'ফুড সেফটি ও নিউট্রিশনের পূর্ণ সমন্বয় হলো হালাল ব্র্যান্ড, যেখানে শরীরের জন্য ক্ষতিকরণ কোন কিছু থাকবে না। এখানে ইসলামিক সংস্কৃতি এবং বিজ্ঞান একসঙ্গে কাজ করে।'
তিনি বলেন, 'আমাদের মূলত রপ্তানির জন্যই এই হালাল সার্টিফিকেটের প্রয়োজন পড়ে।'
দীর্ঘদিন ধরে ইসলামিক দেশগুলোর মানদন্ড মেনে সনদ দেওয়ার প্রক্রিয়া পরিচালনা করে আসছিল ইসলামিক ফাউন্ডেশন। যেখানে ইসলামিক রীতিনীতি মেনে পণ্য উৎপাদনে কাঁচামাল, উৎপাদন প্রক্রিয়া, সংরক্ষণ, পরিবহনসহ ভোক্তার কাছে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সকল প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করা হতো।
মান যাচাইয়ের প্রয়োজনে বিএসটিআই, ওষুধ প্রশাসনের লোকজনও থাকেন হালাল সার্টিফিকেট প্রদানের ক্ষেত্রে। পণ্য তৈরিতে কোনো প্রকার হারাম ও ক্ষতিকর উপদান না থাকলেই ফাউন্ডেশন এই সনদ প্রদান করে।
কেন এই হালাল পণ্য?
স্বাস্থের জন্য ক্ষতিকর কোনো পণ্য উপাদান না থাকা, ইসলামে নিষিদ্ধ এমন কোন উপাদান যুক্ত না করে মানসম্পন্ন পণ্য উৎপাদনই হালাল খাদ্যের মূল বিষয় বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মুসলিম জনগোষ্ঠীর কাছে হালাল পণ্য শারীরিক ও মানসিক স্বস্তির একটি বিষয়। এমন ধারণাও রয়েছে, হালাল উপায়ে উৎপাদিত পণ্যের স্বাদেও কিছুটা ভিন্নতা আসে।
খাদ্যপণ্যের পুষ্টি ও মান নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের সদস্য পরিচালক ড. মো. মনিরুল ইসলাম।
তিনি টিবিএসকে বলেন, 'ইসলামে হালাল পণ্য প্রস্তুত ও খাওয়ার নির্দেশনা মেনে পুষ্টিমানসম্পন্ন পণ্য প্রস্তুতই হালালের মূল ধারণা, যা দেহের ও মনের জন্য স্বস্তিদায়ক বলে মনে করা হয়। যদিও মনের বিষয়টা অনেকটাই আপেক্ষিক বিষয়।'
তিনি বলেন, 'শুধু মুসলিম দেশগুলোতেই নয়, হালাল পণ্যের চাহিদা বাড়ছে ইউরোপ আমেরিকাতেও। এই বাজার ধরতে আমাদের দ্রুত মানসম্পন্ন হালাল পণ্য উৎপাদনের বিকল্প নেই।'