স্থানীয়দের বিক্ষোভে চট্টগ্রামে বিএসআরএমের রড উৎপাদন ব্যাহত
স্থানীয়দের প্রতিবাদের মুখে ফ্যাক্টরিতে কাঁচামাল ঢুকতে না পারার কারণে বিলেট উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে দেশের শীর্ষস্থানীয় রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বিএসআরএম। মিরসরাইয়ের দুটি বিলেট উৎপাদন প্লান্টের মধ্যে বুধবার (২ জুন) সকাল থেকে কাঁচামাল সংকটে ৩ হাজার মেট্রিক টন উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন একটিতে উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। আরেকটি ১৫০০ মেট্রিক টন ক্ষমতা সম্পন্ন প্লান্টও উৎপাদন বন্ধ হওয়ার আশংকা রয়েছে।
এভাবে চলতে থাকলে কাঁচামাল সংকটে চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হবে বিএসআরএমের রড উৎপাদন। দেশের রড সরবরাহে বিপর্যয় দেখা দিতে পারে বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
গত ৩০ মে গভীর নলকূপের মাধ্যমে কারখানাটিতে পানি উত্তোলনের কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাচ্ছে এই অভিযোগ তুলে মানবন্ধন ও প্রতিবাদ করে স্থানীয়রা। ওই কর্মসূচীতে স্থানীয় সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন প্রতিষ্ঠানটিতে কোন ধরনের কাঁচামাল প্রবেশ করতে দেওয়া হবেনা বলে ঘোষণা দেন।
মিরসরাইয়ের সোনাপাহাড়স্থ বিএসআরএমের বিলেট কারখানায় প্রতিদিন প্রায় ৫ হাজার মেট্রিক টন স্ক্র্যাপ কাঁচামাল বিলেট উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন।
তাদের এই বিলেট রড উৎপাদনের অন্যান্য কারখানা ব্যবহার করে। মিরসরাইয়ের এই কারখানায় বিলেট উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় তাদের অন্যান্য রড উৎপাদন কারখানায়ও উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
এর ফলে দেশের বর্তমানে নির্মাণাধীন মেগা প্রজেক্ট পদ্মা সেতু, পদ্মা রেল লিংক, কর্ণফুলী টানেল, রূপপুর পাওয়ার প্ল্যান্টসহ বিভিন্ন প্রজেক্টে রড সরবরাহে বিপর্যয়ের আশংকা দেখা দিয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটি বলছে, এভাবে চলতে থাকলে মিরসরাইয়ের বাইরের অন্য ফ্যাক্টরিতে আগামী ২-৩ দিনের মধ্যে রড উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে।
বছরে দেশের মোট ৭০ লক্ষ টন রড উৎপাদন হয়। যার মধ্যে বিএসআরএম উৎপাদন করে ১৮ লাখ মেট্রিক টনের বেশি রড। সরকারের মেগা প্রকল্প ছাড়াও দেশের বাজারে প্রতিদিন বিএসআরএম পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার মেট্রিক টন রড সরবরাহ করে।
বিএসআরএমের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর তপন সেনগুপ্ত বলেন, "ফ্যাক্টরিতে কাঁচামাল না নিতে পারায় চট্টগ্রাম বন্দরে ৩টি জাহাজ স্ক্র্যাপ পণ্য আনলোডিংয়ের অপেক্ষায় আছে। শীঘ্রই এই পরিস্থিতির সামাধান না হলে রড উৎপাদন এবং সরবরাহে মারাত্মক বিপর্যয় নেমে আসবে। বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে প্রতিষ্ঠান"।
এদিকে বন্দরে আগত জাহাজগুলো থেকে স্ক্র্যাপ কাঁচামাল খালাস করতে না পারায় প্রতিদিন প্রতিটি জাহাজকে ডেমারেজ গুনতে হয় ১০ থেকে ১২ হাজার ডলার।
যে কারণে আন্দোলন
মিরসরাইয়ের ৮ টি ইউনিয়নে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় এলাকাবাসীরা তাদের নলকূপে পানি পচ্ছিল না। এলাকাবাসীরা অভিযোগ করেন বিএসআরএম তাদের কারখানায় থাকা নলকূপ দিয়ে পানি তোলার কারণে এই সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এর প্রতিবাদে গত ৩০ মে বারইয়ারহাট পৌরসভার মেয়র রেজাউল করিম খোকনের আয়োজনে বিএসআরএম কারখানা গেইটে মানববন্ধনে স্থানীয় সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেন, বিএসআরএমকে ২ মাসের মধ্যে ফেনী নদী থেকে পাইপ লাইনের মাধ্যমে কারখানায় পানি আনার ব্যবস্থা করতে হবে। এই দুই মাস কারখানার উৎপাদন বন্ধ থাকবে। এই সময়ে কোন স্ক্র্যাপ কারখানায় প্রবেশ করবেনা।
আগামী ১ বছরের মধ্যে মিরসরাইয়ের সোনাপাহাড় এলাকা থেকে বিএসআরএম কারখানা মিরসরাই ইকোনোমিক জোনে স্থানান্তরের নির্দেশনা দেন সংসদ সদস্য। মূলত এসব ঘোষণায় বিএসআরএম কারখানায় স্ক্র্যাপ পণ্য প্রবেশ বন্ধ রয়েছে।
কনজ্যুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ ক্যাবের সহ সভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, "এই আন্দোলন উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। শুধুমাত্র বিএসআরএমের কারণে এই সংকট তৈরী হয়নি। অন্যান্য শিল্প প্রতিষ্ঠানও এই এলাকায় গভীর নলকূপের মাধ্যমে পানি উত্তোলন করে। একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এভাবে আন্দোলন করা উচিত হয়নি"।
তপন সেনগুপ্ত বলেন, "আমরা হাজার কোটি টাকা খরচ করে কারখানা তৈরী করে মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করেছি। আমাদের ফ্যাক্টরি যাতে শতবছর টিকে থাকে এ নিয়ে আমাদের পরিকল্পনাও রয়েছে। তাই আমরা নিজেরাই ভূগর্ভস্থ পানি তুলি না। আমাদের তিন একর জায়গায় রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং প্ল্যান্ট রয়েছে। এছাড়া আমরা পানি দরকার হলে বার্জে করে ফেনী নদী থেকে পানি নিয়ে আসি। আমাদের ফ্যাক্টরিতে আমরা পানি রিসাইক্লিং করি। ফলে আমাদের বেশি পানিও প্রয়োজন পড়ে না। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার জন্য আমরা একা দায়ী নই। আমাদেরকে অযৌক্তিকভাবে দোষারোপ করা হচ্ছে"।
পানির জন্য বিএসআরএমের দীর্ঘ সংগ্রাম
বিএসআরএম তাদের প্রস্তাবিত ১৫০ মেগাওয়াট পাওয়ারপ্ল্যান্ট ও অন্যান্য শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য ফেনী নদী থেকে পানি উত্তোলনের জন্য ২০১৪ সালের ২ এপ্রিল পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। চুক্তির আওতায় তারা ফেনী নদী থেকে ঘন্টায় ১৫০০ ঘনমিটার পানি উত্তোলনের অনুমতি পায়। এই পানি উত্তোলন করতে হলে বিএসআরএমে তার কারখানা থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে ফেনী নদীর সাথে একটি পাইপ লাইন বসাতে হবে যে পাইপ লাইনটি ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইনের নিচে দিয়ে যাবে। কিন্তু ২০১৪ সালে বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে তারা আবেদন করে। কিন্তু রেল কর্তৃপক্ষ থেকে আবেদনের ৫ বছর পরে ২০১৯ সালে অনুমোদন পেলেও বর্তমানে রেল কর্তৃপক্ষ পুনরায় যাচাই করে দেখছে এই পাইপ লাইন বসানো ঠিক হবে কিনা।
অন্যদিকে ফেনী নদীর ধুমঘাট এলাকায় সরকারী জমিতে ইজারা নিয়ে পাম্প বসানোর জন্য ভূমি মন্ত্রণালয়ের কাছেও আবেদন করে। সেটি এখনো অনুমোদন পায়নি।
বাংলাদেশের ৯০ ভাগ স্টিল মিরসরাই এবং সীতাকুন্ড এলাকায় উৎপাদিত হয়। এখানে বিএসআরএম ছাড়াও দেশের শীর্ষস্থানীয় রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান আবুল খায়ের গ্রুপ, কেএসআরএম, জিপিএইচ ইস্পাত, সীমা স্টিল এছাড়াও পিএইচপি, টিকে গ্রুপ, সানস্যান গ্রুপ, এসএ গ্রুপ, কেডিএস গ্রুপ, মোস্তফা হাকিম গ্রুপ, মোস্তফা গ্রুপ, কনফিডেন্টস গ্রুপের রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, সিমেন্ট এবং শিপ বিল্ডিং ফ্যাক্টরি রয়েছে। যার বেশিরভাগই ভূগর্ভস্থ পানি, পাহাড়ি ঝর্ণা, এবং বৃষ্টির পানির উপর নির্ভরশীল। এবং কিছু ক্ষেত্রে বিএসআরএমের মতো বার্জে করে ফেনী নদী থেকে পানি সংগ্রহ করে।