বাগডাসা লেনের লোহার বাজার
তখনো দেশ স্বাধীন হয়নি। সিরাজ মিয়া লোহার কারবার শুরু করলেন। সেটাই এই ব্যবসার শুরুর কাল। নয়াবাজারের নবাব ইউসুফ মার্কেট থেকে শুরু হয়ে বাগডাসা লেনে ছড়িয়ে পড়ে লোহার দোকানগুলো। সিরাজ মিয়ার দোকান ছিল শ্রমজীবী হাসপাতাল (মহানগর জেনারেল হাসপাতাল) নামে পরিচিত হলুদ ভবনটিতে।
তখন রমরমা ব্যবসা ছিল তার। দেশে লোহার প্রধান বাজার ছিল এটি। সারা দেশ থেকে মাল আসত, ছড়িয়ে যেত দেশের বিভিন্ন জায়গায়। সিরাজ মিয়ার ছেলে মনোয়ার মিয়া বলছিলেন, 'আমাদের দোকান থেকে কমপক্ষে ৫০টি ট্রাক যাতায়াত করত দেশের নানা প্রান্তে।'
'পরে যখন ভবনটিকে হাসপাতাল করে ফেলা হয়, তখন বাবার মন ভেঙে যায়। তিনি আর আগের ব্যবসা দাঁড় করাতে পারেননি। সঞ্চয় ভেঙে সংসার চালিয়েছেন। আমাদের জন্য বাবা কিছু রেখে যেতে পারেননি। শুধু বলে গিয়েছেন, সততার সঙ্গে কাজ করবা, জীবনে কষ্ট পাইবা না।'
বাগডাসা লেনে ঢোকার মুখেই মনোয়ার মিয়ার অ্যাঙ্গেল ও পাইপের দোকান। নিজে ব্যবসায় এসেছেন ৪০ বছর হয়। জানালেন, হাজারখানেক দোকান আছে বাগডাসা লেন। লোহার দরজা, জানালা, মেইন গেইট, কাঁচি গেইট ইত্যাদি তৈরি ও বিক্রি করে এখানকার দোকানদারেরা।
এ কাজে পরিশ্রমের চেয়ে মজুরি কম। তবে লোহার ব্যবহার দিনে দিনে বাড়ছে বলে কেউ বসে নেই। তিনি বললেন, 'পাকিস্তান আমলে রিরোলিং মিলস ছিল গোটা দশেক, এখন আছে কয়েক হাজার।'
জাহাজ ভেঙে লোহা
দেশে লোহা প্রাপ্তির বড় উৎস জাহাজভাঙা শিল্প। স্বাধীনতা যুদ্ধকালে বেশ কিছু জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরের কাছে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণেও চট্টগ্রাম বন্দর ও নিকটবর্তী জলভাগে অনেক ডুবন্ত জাহাজ জমা হয়েছিল। তাই যুদ্ধের পরেই নিরাপদ নোঙর ও চলাচলের স্বার্থে বন্দর পরিস্কার করা দরকার হয়ে যায়।
১৯৭৪ সালে চট্টগ্রামে ভাটিয়ারির সমুদ্রোপকূলে আল আব্বাস নামের পাকিস্তানি নৌ-বাহিনীর একটি জাহাজ ভাঙা হয়। এটি স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কর্নফুলি নদীতে ডুবে গিয়েছিল। তবে বিদেশ থেকে পরিত্যক্ত জাহাজ কিনে এনে বাণিজ্যিকভাবে ভাঙার প্রক্রিয়া শুরু হয় ১৯৮০-এর দশকে।
জাহাজ ভেঙে পাওয়া লোহার বড় অংশ যায় রিরোলিং মিলে। সেখান থেকে বিভিন্ন মাপ ও গড়নের লোহা পাওয়া যায়। বাগডাসা লেনের কারবারিদের সুবিধা হলো তারা নতুন ও পুরাতন দুই ধরনের লোহার কাজই করেন। লোহার সে অর্থে নতুন-পুরাতন নেই। দামের ফারাক কেজিতে ৮-১০ টাকার বেশি নয়।
বাচ্চু আয়রন স্টোরের মো. ইসমাইলের বয়স সত্তর ছুঁই-ছুঁই। শুরু করেছিলেন বালক বয়সে, যখন কেজি দরে জিনিসপত্র বিক্রি হতো না। ছিল সেরের দর। চাকরি করতেন তখন। এখন ছেলেদের নিয়ে নিজের দোকান দিয়েছেন। পুরাতন লোহার সিঁড়ি কেনা-বেচা ও মেরামত করেন।
পুরাতন লোহার সিঁড়িতে জং বা মরিচা ধরার সমস্যাটাই বড়। কোথাও কোথাও জয়েন্ট আলগা থাকে। সিরিশ কাগজ দিয়ে পুরানো লোহা থেকে মরিচা ছাড়ানো একটি প্রচলিত পদ্ধতি। নয়াবাজারে রয়েছে কয়েকটি কাগজের দোকান আছে, যেগুলো বিভিন্ন গুণমানের সিরিশ কাগজ বিক্রি করে থাকে।
সিরিশ কাগজের গ্রেড নির্ধারিত হয় খনিজ বালুর মাত্রার ওপর। এর শুরু ৪০ থেকে, শেষ হয় ২ হাজারে গিয়ে। খনিজ বালু ছাড়া এর অন্য দুটি কাঁচামাল হলো আঠা ও বিশেষ রকমের কাগজ। জার্মানির দুটি প্রতিষ্ঠান বোস ও ক্লিংস্পো সিরিশ কাগজের প্রধান বাজার নিয়ন্ত্রক। আমাদের দেশে চীন থেকেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সিরিশ কাগজ আমদানি করা হয়।
সিঁড়ির দোকান বা আড়ত
ইসমাইলের দোকানের পাশেই শাহাদাত মিয়া বিক্রি করেন সব নতুন লোহার সিঁড়ি। এতগুলো সিঁড়ি একসঙ্গে দেখার সুযোগ এর আগে হয়নি বলে অনেকক্ষণ তাকিয়ে দেখলাম। এসব সিঁড়ির কিছু অংশ হয় এসএস (স্টেইনলেস স্টিল) দিয়ে কিছু হয় এমএস (মাইল্ড স্টিল) দিয়ে।
সিঁড়ি সর্বোচ্চ ১৬ ফুট উঁচু হয়। দাম নির্ভর করে উচ্চতা, প্রশস্ততা, পাদানির প্রস্থ ও বার্নিশের ওপর। সিঁড়ির দুটি ধরন হয়- মই ও ধাপ। একই দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের নতুন সিঁড়ির দাম পুরানোগুলোর তুলনায় দুই বা আড়াই হাজার টাকা বেশি।
সাধারণত সিঁড়ির দাম ১৫ হাজার টাকার আশপাশে থাকে। আবার ১১ ফুট বাই ২ ফুটের একটি পুরানো লোহার সিঁড়ি কেনা যাবে ৬০০০ টাকায়ও। বসতবাড়ি, দোকান বা রেস্তোরায় এসব সিঁড়ির ব্যবহার দেখা যায়। অল্প জায়গায় দোতলা ঘর যেখানে সেখানে এমন সিঁড়ির ব্যবহার বেশি।
অর্ডার বা ফরমায়েশ দিলে গোল বা প্যাচানো সিঁড়িও তৈরি কওে দেন শাহাদাত মিয়া ও তার সঙ্গী কারিগররা।
এরপর মোহাম্মদ আলী আয়রন স্টোর ঘুরে দেখা যেতে পারে। এটি লোহার গেইট তৈরির বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান। বিভিন্ন নকশা ও আকৃতির অনেক রকম গেইট এখানে পাওয়া যায়। ৬ ফুট বাই ৭ ফুট, ৭ ফুট বাই ৭ ফুট ইত্যাদি নানান মাপের গেইট পাবেন।
গেইটগুলোতে পকেট গেইট থাকে লোকের চলাচলের জন্য আর গাড়ি ঢোকানোর জন্য পাল্লা খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা থাকে। স্লাইডিং পাল্লাও পাওয়া যায়, এক্ষেত্রে পাল্লা বসানোর যে রেল দরকার হয় তাও তৈরি করে দেন দোকানের কর্মীরা।
গেইটগুলোর দাম নির্ভর করে লোহা, এসএস ও এমএসের পরিমাণের ওপর। কিছু গেইট তৈরি হয় বার ও অ্যাংগেল দিয়ে, কিছু তৈরি হয় রঙিন পাত দিয়ে। গেইটগুলোর নকশায় খিলানের প্রাধান্য দেখা গেল। দাম হয়ে থাকে ২০ থেকে ৩২ হাজার টাকা।
লতাপাতার নকশা করা একটি লোহার চৌকাঠের গেইট দেখলাম যা দূর থেকে দেখলে কাঠের বলেও মনে হয়। ৩ ফুট বাই ৭ ফুটের এ দরজার দাম দোকানী বললেন সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা।
এই দোকানে জানালার গ্রিলও পাওয়া যায়। বর্গাকার গ্রিলগুলো বিভিন্ন সাইজের হয়ে থাকে। তিন ফুট বাই দুই ফুটের একটি গ্রিলের দাম ১,৯০০ থেকে ২,২০০ টাকা।
শাহ আলম রবিনের গল্প
এবার বলি শাহ আলম রবিনের গল্প। ১৯৯১ সালে জন্মগ্রহণ করেন। পড়াশোনা করেছেন ক্লাস সিক্স পর্যন্ত। তার দোকানের নাম রাইয়ান আয়রন স্টোর।
মাত্র বারো বছর বয়সে রবিন ফুপাতো ভাইয়ের দোকানে কাজ শুরু করেন। সেখানেই তার বেচাকেনার হাতেখড়ি। পরে ওয়েল্ডিং, ড্রিল ও গ্রাইন্ডিংয়ের কাজ শিখে নেন। প্রথম দিকে তার সাপ্তাহিক মজুরি ছিল মাত্র ৫০ টাকা। সাত বছর এভাবে কাজ করার পর রবিন নিজেদের বাড়ির নিচতলায় একটি ছোট দোকান দেন। তার সঙ্গে ছোট ভাই শিপনও কাজ শুরু করেন।
তাদের দোকানে লোহা দিয়ে তৈরি হয় নানা ধরনের জিনিস। কাঁচি গেইট, পাল্লা, শাটার, জানালা, মেইন গেট কিংবা সিঁড়ি—সবই তারা বানান। ইদানিং ফুড কার্টও তৈরি করছেন। রবিন এবং শিপন মূলত মিস্ত্রি। মোহাম্মদ আলী বা শাহাদত মিয়ার মতো তারা দোকানদার নন। নকশা নিয়ে গেলে সেভাবেই জিনিস তৈরি করে দেন।
সাভারের একটি চীনা প্রকল্পের জন্য তারা একটি স্লাইডিং কনভেয়ার তৈরি করেছিলেন। ২০১৪ সালে ঢাকার শহীদবাগে সৌখিন এক ব্যক্তির জন্য একটি লোহার ঘর তৈরি করেন। এই কাজের জন্য তাদের ৮০ হাজার টাকা মজুরি দেওয়া হয়েছিল। বছর দুই আগে শাটার তৈরি করতে পুরো কর্মীবাহিনী নিয়ে সিলেট গিয়েছিলেন, সেখানেও ভালো উপার্জন হয়েছিল।
বিয়ে বাড়ি বা কর্পোরেট ইভেন্টে মঞ্চ সাজানোর কাজেও তারা যুক্ত হয়েছেন। বিভিন্ন কাঠামো বানিয়ে ফুল বা কাপড়ে ঢেকে দেন। এ ধরনের কাজ অল্প পরিশ্রমে বেশি উপার্জন এনে দেয়।
প্রতিদিন সকাল হলেই রবিন নবাবপুর ও বংশাল এলাকায় যান। প্রয়োজন অনুযায়ী আয়রন শীট, অ্যাঙ্গেল বা পাইপ সংগ্রহ করেন। এগুলো দিয়ে গেট, সিঁড়ি কিংবা ফুড কার্ট তৈরি করেন।
চায়ের দোকানের কাঠামো তৈরি করতে করতে ফুড কার্ট তৈরি করা তাদের জন্য সহজ হয়ে গেছে। তবে ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী ফুড কার্টে ডিসপ্লে র্যাক, বার্নার গ্যাপ, সিংক, কফি বা জুস বার ইত্যাদি যোগ করতে হয়। একটি ফুড কার্ট তৈরি করতে ২৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা খরচ হয়।
রবিন ও শিপন মিলে এখন পাঁচজন কর্মী নিয়ে কাজ করেন। প্রতিদিন তাদের দোকান খোলা রাখতে হয়। কারণ, একদিন দোকান বন্ধ রাখা মানেই প্রায় ২,০০০ টাকা লোকসান।
রবিন বলছিলেন, 'আমাদের কাজে ঝুঁকি অনেক বেশি। তবে ঝুঁকি বেশি বলেই মজুরিও বেশি। একজন কর্মীর দৈনিক মজুরি ৮০০ টাকা।'
দিন যত যাচ্ছে, লোহার ব্যবহার ততই বাড়ছে। বাড়ি থেকে ব্রিজ, বাস থেকে ট্রেন—সবখানেই লোহার চাহিদা বেড়েছে। বড় প্রকল্প মানেই বেশি লোহা।
তবে লোহা ব্যবসার মূল কেন্দ্র আর নয়াবাজারে সীমাবদ্ধ নেই। এখন বিভিন্ন জায়গায় লোহার বাজার গড়ে উঠেছে। তবে নয়াবাজারের মতো খ্যাতি এখনো অন্য কোনো বাজার অর্জন করতে পারেনি।
ফেরার আগে লেনের নাম বাগডাসা লেন হলো কেন, তা জানতে চেয়েছিলাম সিরাজ মিয়ার ছেলে মনোয়ার মিয়ার কাছে। তিনি বললেন, 'এই এলাকার মানুষের বাঘের মতো সাহস। সম্ভবত এ কারণেই এই নাম রাখা হয়েছে।'
ছবি: সালেহ শফিক/টিবিএস