হালকা প্রকৌশল শিল্প গড়তে উদ্যোক্তাদের জন্য বড় বাধা জমির দাম
ইলেকট্রিক গুডস ও লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পগুলোকে মুন্সিগঞ্জে সরিয়ে নেওয়ার প্রকল্প প্রায় শেষ হতে চললেও জমির দামের কারণে প্লট বরাদ্দ নিতে আগ্রহী হচ্ছেন না শিল্প উদ্যোক্তারা।
তাদের মতে, জমি অধিগ্রহণের পর ভৌত কাজ সম্পন্নসহ যে দাম নির্ধারণ করেছে, তা প্রচলিত দামের চেয়ে অনেক বেশি। মৌজা রেট অনুযায়ী 'যৌক্তিক' মূল্যে প্লট না পেলে শিল্প স্থাপন করা সম্ভব হবেই না।
অনাগ্রহের বিষয়টি প্রতিফলিত হয়েছে, বাংলাদেশে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) থেকে আবেদন চাওয়া হলেও সাড়া দেননি উদ্যোক্তারা।
এখন পর্যন্ত একটি প্রতিষ্ঠানও প্লট বরাদ্দ পেতে আবেদন করেনি। প্লটের জমির দাম কমানোর বিষয়ে সরকারের সঙ্গে উদ্যোক্তারা দেন-দরবার করছেন।
চলতি বছরের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রকল্পটির অগ্রগতি ৮৩%। এই শিল্পপার্কে মোট প্লটের সংখ্যা ৩৬২টি। এখানে তিন শতাধিক শিল্প কারখানা স্থাপন করা সম্ভব হবে।
প্রকল্পটির মেয়াদ আছে আর এক বছর। নির্দিষ্ট সময়ের আগেই কাজ শেষ হওয়ার কথা জানালেন প্রকল্পটির পরিচালক আবদুল জলিল।
প্রকল্পের মোট ব্যয়ের হিসাবে শিল্পপার্কের জমির দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। জমি অধিগ্রহণ ও ভৌত অবকাঠামো ব্যয় হিসাব করে প্রতি শতাংশ জমির দাম পড়বে ১১.৯৫ লাখ টাকা।
এদিকে, মুন্সিগঞ্জের ইলেকট্রিক গুডস ও লাইটি ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পপার্ক এলাকার জমির মৌজা রেট প্রতি শতাংশ প্রায় দেড় লাখ টাকা। তবে এই মৌজা রেটের চেয়ে তিনগুণ বেশি দামে জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে।
এরপর জমিতে মাটি ভরাট, বিদ্যুত, রাস্তাঘাট ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা এবং অন্যান্য ভৌত কাজের ব্যয় মিলিয়ে শতাংশ প্রতি দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে শতাংশ প্রতি জমির দাম বেড়ে গেছে।
বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প মালিক সমিতির প্রেসিডেন্ট আবদুর রাজ্জাক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'মুন্সিগঞ্জের যেখানে এই শিল্পপার্ক গড়ে তোলা হচ্ছে, সেখানে প্রতি কাঠা জমির মূল্য বর্তমানে তিন থেকে চার লাখ টাকা। উদ্যোক্তারা নিজেরাই জমি কিনে মাটি ভরাট করলেও বিসিক নির্ধারিত দামের চেয়ে কম হতো। গ্যাস, বিদ্যুৎ ও অন্যান্য সুবিধাও ঠিকমতো গড়ে উঠেনি।'
রাজধানী ঢাকা ও সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বৈদ্যুতিক পণ্য উৎপাদন ও হালকা প্রকৌশল শিল্পগুলো এক ছাতার নিচে আনতে প্রকল্পের কাজ শুরু করে বিসিক।
এই শিল্পপার্কের ৫০ একর জায়গায় বৈদ্যুতিক পণ্য উৎপাদন শিল্পের জন্য ২৫ একর ও হালকা প্রকৌশল শিল্পের জন্য ২৫ একর নির্ধারণ করা হয়।
প্রকল্পটির প্রাথমিক মেয়াদ ছিল ২০১৬ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত। ব্যয় ধরা হয় ২৮০.৫৭ কোটি টাকা। আর এক হাজার ৬৫০ জন লোকের কর্মসংস্থানের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়।
জমি অধিগ্রহণ জটিলতা ও নানাবিধ কারণে প্রকল্পটির মেয়াদ ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। একইসঙ্গে প্রকল্পে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৩১৫.৮০ কোটি টাকা।
প্রকল্প পরিচালক আবদুল জলিল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'প্লট প্রস্তুত ও অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ চলছে পুরোদমে। প্লট বরাদ্দের আবেদন চেয়ে এক দফা বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে; কিন্তু আশানুরুপ সাড়া নেই।'
চলতি বছরের মার্চে বিসিক বৈদ্যুতিক পণ্য উৎপাদন ও হালকা প্রকৌশল শিল্পনগরীতে প্লট বরাদ্দ নিতে আবেদন চায় বিসিক।
এতে বলা হয়, মুন্সিগঞ্জের বরাদ্দযোগ্য খালি প্লট আগ্রহী শিল্পোদ্যাক্তাদের বরাদ্দ দেওয়া হবে। আবেদনকারীদেরকে স্ব স্ব সমিতির মাধ্যমে ৪৫ দিনের মধ্যে আবেদন করতে হবে।
প্লটের মূল্য এককালীন বা ৫ বছরে ১০ কিস্তিতে পরিশোধ করতে হবে। আবেদনপত্রে চাহিত জমির মোট মূল্যের ২০% পে-অর্ডারের মাধ্যমে পরিশোধ করতে হবে।
আবেদন নেওয়া শেষ হওয়ার পর চলতি জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে বিসিকের মুন্সিগঞ্জ জেলা কার্যালয়ে যোগাযোগ করা হলে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবদুল্লাহ টিবিএসকে বলেন, 'বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পরই মহামারি শুরু হয়। ১৫-২০টা আবেদনপত্র বিক্রি হয়েছে। তবে এখনো কেউ জমা দেয়নি।'
প্লটের জমির দাম নিয়ে বৈপরীত্য
ইলেকট্রিক পণ্য উৎপাদন ও হালকা প্রকৌশল শিল্পপার্কে জমির দাম নির্ধারণ নিয়ে বিরোধী মত শিল্প উদ্যোক্তাদের।
বিসিকের কর্মকর্তারা বলছেন, জমির দাম ঠিকই ধরা হয়েছে। তবে উদ্যোক্তারা আপত্তি তোলায় কিছুটা কমানোর বিষয়ে ভাবা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বিসিক তথা সরকারকে লোকসান গুণতে হবে।
সানরাইজ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সত্ত্বাধিকারী আবদুর রাজ্জাক বলেন, 'এই শিল্পনগরী নিয়ে উদ্যোক্তারা খুব আশায় ছিলেন। দ্রুত সেখানে যাওয়ার জন্যও ছিল আগ্রহ। কিন্তু প্লটের দাম বেশি ধরার কারণে সে আসা ফিকে হচ্ছে।'
বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প মালিক সমিতির এই সভাপতি আরও বলেন, 'প্লট বরাদ্দ নিতে আবেদন চাওয়া হলেও অগ্রগতি শূন্য। এত বেশি দামের জমিতে কেউ যেতে চাচ্ছে না। বিসিকের দাম অনুযায়ী প্রতি কাঠা জমির দাম পড়বে প্রায় ২০ লাখ টাকা। কেউ ১০ কাঠা জমি নিতে চাইলে ব্যয় হবে ২ কোটি টাকা। এই দামে জমি নেওয়া সম্ভব না।'
'আমরাই রাজধানী থেকে সরে মুন্সিগঞ্জে যেতে চেয়েছিলাম। সরকারও জায়গা তৈরি করে দিয়েছে। জমির দামটাই এখন বড় বাধা। প্লট বরাদ্দ দিতে সরকারের নীতিমালায় পরিবর্তন আনতে হবে। নয়তো কারও পক্ষেই এই জমি নিয়ে শিল্প গড়ে তোলা সম্ভব হবে না। সরকার সাভার ট্যানারি পল্লীর প্লট বরাদ্দে বড় ভুর্তকি দিয়েছে।' এই শিল্পনগরীতেও ভর্তুকি দেওয়া ছাড়া প্লট নেওয়া সম্ভব হবে না বলে উল্লেখ করেন তিনি।
বিসিকের মুন্সীগঞ্জের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ বলেন, 'উদ্যোক্তাদের আপত্তির প্রেক্ষিতে সরকার প্লটের জমির দাম কমানোর কথা ভাবছে। এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে দাম কমানো হলে সরকারের কয়েকশ কোটি টাকা লোকসান হবে। তারপরও একটা শিল্পকে সমন্বিত রূপ দিতে করা হবে। মহামারি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে নতুন করে আবারও বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হবে।'
শিল্পনগরীতে জায়গা হবে অল্প প্রতিষ্ঠানের, বাইরে থাকবে বৃহৎ অংশই
মুন্সিগঞ্জের এই শিল্পপার্কে প্লট সাড়ে তিনশ'র বেশি। উদ্যোক্তাদের চাহিদার প্রেক্ষিতে কেউ একটা প্লটে, আবার কেউ একাধিক প্লটে কারখানা গড়বেন। সেই হিসাবে তিন শতাধিক শিল্প ইউনিট স্থাপন সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প সমিতির তথ্যমতে, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং খাতে সারাদেশে ৫০ হাজারের বেশি শিল্প-প্রতিষ্ঠান আছে। যার বড় অংশ বৃহৎ পরিসরে পণ্য উৎপাদন করে না। রাজধানীর বাইরের প্রতিষ্ঠানগুলো অ্যাগ্রোবেজড। ১০ শতাংশ বা পাঁচ হাজারের মতো প্রতিষ্ঠান বৃহৎ পরিসরে সরাসরি পণ্য উৎপাদনে জড়িত।
এই শিল্পনগরীতে লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পখাতের দুইশ বা তার কিছু বেশি শিল্প ইউনিট স্থাপন করা সম্ভব। তবে বড় অংশই শিল্পনগরীর বাইরে থেকে যাবে।
বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প সমিতির সভাপতি আবদুর রাজ্জাক বলেন, 'এই প্রকল্প নিয়ে আলোচনা ২০০৬ সাল থেকে শুরু হলেও ২০১২ সালে একটা রূপ পায়। পরবর্তীকালে ধীর গতির কারণেও যথাসময়ে শেষ হয়নি। সময় বাড়ানো হয়েছে। এখন আবার নতুন করে জমির দাম নিয়ে জটিলতা দেখা দিয়েছে। শিল্প মন্ত্রণালয় চাইলে বিদ্যমান জমির দাম ২৫% কমাতে পারে; কিন্তু তাতেও উদ্যোক্তাদের কাজে আসবে না। সরকারের পক্ষ থেকে বড় ভর্তুকি প্রয়োজন।'