১৬৭ বছরে চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ১৬৭ টাকাও হয়নি
চা চাষের ইতিহাস ১৬৭ বছর হলেও চা বাগানের শ্রমিকদের মজুরি এখন পর্যন্ত ১৬৭ টাকাও হয়নি। এরই মধ্যে দীর্ঘ ১১ বছর পর, ন্যূনতম মজুরি বোর্ড চা শ্রমিকদের জন্য খসড়া মজুরির সুপারিশকে চূড়ান্ত করেছে। তবে চা শ্রমিকরা এবং তাদের সংগঠনগুলো এই খসড়ার প্রতিবাদ করে বলেছেন যে, চা বাগান শ্রমিকদের জন্য মজুরি বোর্ডের দ্বারা নির্ধারিত দৈনিক মজুরি গ্রহণযোগ্য নয়। ন্যূনতম মজুরি বোর্ড চা শ্রমিকদের সুবিধাগুলো বাড়ানোর কথা বললেও এই গেজেটে তা হ্রাস করা হয়েছে।
চা-বাগান শিল্পের জন্য গঠিত নিম্নতম মজুরি হারের খসড়া সুপারিশ বাতিলের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন। তাদের দাবি, '২০১৯ সালের জানুয়ারী থেকে আমরা যেখানে ১১৭-১২০ টাকা মজুরি পাচ্ছি সেখানে সেই মজুরি পাওয়ার আড়াই বছর পর মজুরি বোর্ড আবার ১১৭-১২০ টাকা নির্ধারণ করে দিয়ে যে খসড়া প্রকাশ করেছে সেটা হাস্যকর এবং অগ্রহণযোগ্য'।
চলতি বছরের ১৩ জুন মজুরি বোর্ড চা শ্রমিকদের মজুরি ১১৭ থেকে ১২০ টাকা নির্ধারণ করে; এরপর থেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করে আসছেন চা শ্রমিকরা।
চা শ্রমিক ইউনিয়ন জানায়, ২০১৯ সালের অক্টোবরে মজুরি বোর্ড গঠন করা হয়। ৬ মাসের ভেতর এই বোর্ডের রিপোর্ট করার কথা থাকলেও করোনা বা বিভিন্ন কারণে তা করেনি তারা। বর্তমানে প্রায় আড়াই বছর পর চলতি মাসের ১৩ তারিখ মজুরি বোর্ড তাদের খসড়া প্রকাশ করেছে যেখানে চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ১১৭ থেকে ১২০ টাকা নির্ধারণ করেছে। অথচ এই খসড়া প্রকাশের আগে ২০১৯ সালের জানুয়ারী থেকে চা শ্রমিকরা ১১৭ থেকে ১২০ টাকা পাচ্ছে । তাদের দাবি ছিল ৩০০ টাকা দৈনিক মজুরি।
২০২০ সালের ১৩ অক্টোবর চা-বাগানের মালিকপক্ষের সংগঠন বাংলাদেশ চা-সংসদের (বিটিএ) সঙ্গে চা-শ্রমিক ইউনিয়নের চুক্তি সম্পাদন হয় তার প্রেক্ষিতে ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১১৭ থেকে ১২০ টাকা দৈনিক মজুরি পাচ্ছেন চা শ্রমিকরা। তবে এই চুক্তির মেয়াদও প্রায় ৬ মাস অতিক্রম করেছে। প্রতি দুই বছরের জন্য এই চুক্তি মালিকপক্ষ ও শ্রমিকপক্ষের মধ্যে হয়ে থাকে। সর্বশেষ চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর। একে তো চুক্তি মেয়াদ অতিক্রম করে ৬ মাস চলে গেছে, তার ওপর যে মজুরি বোর্ডের প্রতি তাদের প্রত্যাশা ছিল ৩০০ টাকা দৈনিক মজুরি, বছরে ২ মাসের বেতন বোনাস হিসেবে দেবে, সেই মজুরি বোর্ডের খসড়ায় বর্তমান মজুরিকেই আবার সুপারিশ করায় তারা চরম হতাশায় পড়েছেন।
এর আগে ২০১০ সালে মজুরি বোর্ড দৈনিক মজুরি ৪৮ টাকা নির্ধারণ করে। এরপর থেকে মালিকপক্ষের সাথে প্রতি দুইবছর পর পর শ্রমিকদের যে চুক্তি হয়ে থাকে তার প্রেক্ষিতে বর্তমানে মজুরি ৪৮ টাকা থেকে ১১৭-১২০ টাকা হয়েছে। ২০১০ সালের দীর্ঘ ১১ বছর পর, 'চা-বাগান' শিল্প খাতে ন্যূনতম মজুরি বোর্ড ২০২১ সালের ১৩ জুন একটি গেজেট আকারে খসড়া মজুরির সুপারিশ প্রকাশ করে তাতে বাড়েনি চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি বা অন্যান্য সুযোগ সুবিধা।
চা শ্রমিক সংঘের আহ্বায়ক রাজদেও কৈরি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, 'এই খসড়া আমরা প্রত্যাখ্যান করছি। আধুনিক রাষ্ট্রে এত কম মজুরি থাকতে পারে না। চা শিল্পের ১৬৭ বছরেও চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ১৬৭ টাকা হলো না, এটা দুঃখজনক'।
চা শ্রমিকদের অক্লান্ত পরিশ্রমের কারণে বাংলাদেশ চা উৎপাদনে বিশ্বে নবম স্থানে উঠে এসেছে। শুধু তাই নয়, করোনা মহামারির কারণে দেশের বিভিন্ন শিল্প এলাকার শ্রমিকরা ছুটিতে থাকলেও চা শিল্পের শ্রমিকরা উৎপাদনে সক্রিয় রয়েছেন।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক নারী ফোরামের সভাপতি গীতা রানী কানু বলেন, 'বিভিন্ন সেক্টরের শ্রমিকদের জন্য দেওয়া সুপারিশগুলোতে ন্যূনতম মজুরি বোর্ড বাৎসরিক হারে পাঁচ শতাংশ বৃদ্ধির সুপারিশ করলেও চা খাতে শ্রমিকদের প্রস্তাবিত ন্যূনতম মজুরি অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি'।
তিনি বলেন, চা খাতে ইনক্রিমেন্ট সিস্টেমের অভাবে একজন অভিজ্ঞ, বছরের পর বছর ধরে কাজ করা চা শ্রমিক এবং নতুন চা শ্রমিকের মজুরি সমান।
মৌলভীবাজার ইউনিটের বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রজত বিশ্বাস জানান, 'মজুরি বোর্ড কর্তৃক প্রকাশিত ৪৩টি শিল্প খাতের মধ্যে চা শ্রমিকদের মজুরি সবচেয়ে কম।
স্বল্প মজুরি প্রসঙ্গে চা বাগান মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ চা সংসদের সিলেট শাখার চেয়ারম্যান জিএম শিবলি বলেন, 'শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি কম হলেও চা বাগান মালিকরা তাদের থাকার ব্যবস্থা, চিকিৎসা, রেশন ইত্যাদির মতো অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা সরবরাহ করেন যা অর্থের দিক দিয়ে পরিমাপ করা হয় না'।
তিনি বলেন, 'এসব কারণে মজুরি কম বলে মনে হচ্ছে। সব সুযোগ সুবিধা হিসেব করলে তাদের মাসিক মজুরি প্রায় ১২ থেকে ১৪ হাজার টাকা'।
বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক রামভজন কৈরী বলেন, মজুরি বোর্ডের তিনিও সদস্য। বোর্ডের সভায় শ্রমিকদের স্বার্থ পরিপন্থী সুপারিশগুলো বাতিলের জন্য প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। কিন্তু, তা আমলে নেওয়া হয়নি। এমনকি সুপারিশের খসড়া সিদ্ধান্তে তিনি কোনো স্বাক্ষরও করেননি। ১২০ টাকা মজুরিতে শ্রমিকেরা কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। মজুরি বোর্ডের খসড়া সুপারিশে শ্রমিকদের কোনো প্রাপ্তি নেই। তাই, মানবিক বিবেচনায় নতুন করে সুপারিশ নির্ধারণ করে সরকারের কাছে তা পেশ করার দাবি জানান তিনি।
তিনি আরও বলেন, 'এই খসড়াতে বলা হয়েছে নতুন শ্রমিকরা শিক্ষানবিশ হিসেবে ১১০ টাকা পাবে। এছাড়া অন্যান্য সুযোগ সুবিধাও তারা পুরাতন শ্রমিকের মত পাবে না। এটা আমাদের বঞ্চিত করার জন্য করা হচ্ছে। কারণ, আমরা ছোট বেলা থেকে চা বাগানে বড় হই। সব কাজ আমাদের চোখের সামনে হয়, আমরা সেসব দেখে শিখতে শিখতে বড় হই। শ্রমিকেরা যা করে সেটা কোন কারিগরী কাজ নয়, তা হলে এখানে শিক্ষানবিশ বলা হচ্ছে কেন'?
ন্যূনতম মজুরি বোর্ডের সচিব রাইশা আফরোজ বলেন, 'খসড়া গেজেটে সংশোধন করার জন্য ১৪ দিন সময় রয়েছে। এই সময়ের মধ্যে কোনও দাবি, অভিযোগ, মতামত বা পরামর্শ আনুষ্ঠানিকভাবে মজুরি বোর্ডে জানানো যেতে পারে। আমি ২৭ জুনের পর পরবর্তী বোর্ড সভায় এসব উপস্থাপন করব'।
উল্লেখ্য, ব্রিটিশ আমলে সিলেটের মালনীছড়া চা বাগানে চা চাষের শুরু হয় ১৮৫৪ সালে। বর্তমানে বাংলাদেশ চা উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে, দেশে চা বাগান রয়েছে ১৬৭টি। এসব বাগানে চা শ্রমিক ইউনিয়নের তথ্যমতে নিবন্ধিত ১ লাখ ১৭ হাজার এবং অনিবন্ধিত আরও প্রায় ২৫ হাজার শ্রমিক কাজ করেন।