টি-টোকেন: চা-বাগানের বিশেষ মুদ্রা!
পুরো সিলেট বিভাগের চা-বাগানগুলোতে কত শতবার গিয়েছি, হিসাব রাখিনি। কখনো ভ্রমণে, কখনো কাজে। কাজ বলতে তথ্যচিত্র নির্মাণ, যেটি ছিল চা-বাগানকেন্দ্রিক। ২০২০ সালে শুরু করি তথ্যচিত্র 'Tombs: Tea Planters Cemeteries in Sylhet'। কাজ শেষ হয় ২০২২ সালে। করোনা অতিমারি উপেক্ষা করে তথ্যচিত্রের কাজ চলেছে। ব্রিটিশ বণিক, চা-বাগান গড়ে ওঠার ইতিহাস, টি-টোকেন, চা-শ্রমিক ও তাদের চা-শ্রমিক হয়ে ওঠার করুণ ইতিহাস, ব্রিটিশ বণিকদের সমাধিক্ষেত্র—এসব বিষয়ে একটি সম্যক ধারণা পাই সেই দুই বছরে। লুপ্ত বিষয়ের প্রতি মানুষের আগ্রহ বেশি থাকে। তাই চা-বাগানের বিলুপ্ত মুদ্রা টি-টোকেন নিয়ে পরবর্তী সময়ে জানার প্রয়াস পাই অবশ্যই পঠন-পাঠনে ও টি-টোকেন সংগ্রাহকদের সাথে আলাপচারিতায়। ইতিহাস আলোচনার জন্য প্রয়োজন ইতিহাস-মনস্কতা, সব সময় প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি জরুরি নয় বলেই আমি মনে করি। তাই নিজেকে একজন ইতিহাস অনুরাগী ভাবতে আমার ভালো লাগে।
সেই অনুরাগের জায়গা থেকেই টি-টোকেন ছুঁয়ে দেখা, টি-টোকেন সম্পর্কে অবগত হওয়ার অভিজ্ঞতা মিলিয়ে আজকের ছোট্ট রচনা।
টি-টোকেন!! ব্রিটিশ সময়ে চা-বাগানের শ্রমিকদের বিশেষ মুদ্রা। চা-শ্রমিকদের মজুরি মেটানোর জন্য ভিন্ন ধরনের মুদ্রার প্রচলন করেছিল ব্রিটিশ বণিকেরা, যা প্রচলিত মুদ্রার বাজার থেকে ছিল একেবারেই আলাদা। ভারতবর্ষে চায়ের বাণিজ্যিকীকরণের পদে পদে ছিল নানা বাধা ও প্রতিকূলতা। উন্নত যোগাযোগব্যবস্থা না থাকার কারণে সরকারি টাকায় মজুরি পরিশোধ করা ছিল বাগানমালিকদের জন্য কষ্টকর কিংবা অন্যভাবে বলতে গেলে অলাভজনক। মূলত সে কারণেই বাগানে ভিন্ন রীতির মুদ্রার প্রচলন শুরু হয়। মজুরি হিসেবে চা-শ্রমিকদের এই মুদ্রা দেওয়া হতো। যাকে আমরা টি-টোকেন বলছি।
এই ধাতুর মুদ্রাগুলো ঊনবিংশ শতাব্দীতে সভ্য জগতের বাইরে, জঙ্গলাকীর্ণ, যোগাযোগবিচ্ছিন্ন চা-বাগানের শ্রমিকদের জীবনের এক জলন্ত দলিল। একসময় এই মুদ্রাগুলো ছিল দরিদ্র শ্রমিকদের আশা-আনন্দের সাক্ষী। এই ধাতুর টুকরো চা-বাগানের কুলিদের নানাভাবে ঠকাতেও সাহায্য করেছিল। সে কথা জানলেও শিরদাঁড়ায় শিহরণ খেলে।
বাংলাদেশের চা পৃথিবীব্যাপী 'সিলেট টি' নামে খ্যাত। বাংলাদেশ বর্তমান বিশ্বের দশম চা উৎপাদনকারী দেশ আর রপ্তানিতে নবম। এই অঞ্চলে যখন চা চাষ শুরু হয়, তখন চা-বাগানের সিংহভাগ দখলে ছিল ব্রিটিশ বণিকদের। মাইলের পর মাইল বিশাল এই বাগানগুলোতে কাজ করার জন্য দরকার ছিল বিপুল শ্রমিকের। বিহার, ওডিশা, উত্তর প্রদেশসহ ভারতের বিভিন্ন এলাকা থেকে নিম্ন বর্ণের হিন্দু ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকজনকে নিয়ে আসা হয়। বংশপরম্পরায় তারা বাস করছে এই ভুখণ্ডে। বৃহত্তর সিলেট এলাকায় প্রায় শতাধিক চা-বাগানে কর্মরত আছে এক লাখ আঠারো হাজার চা-শ্রমিক। মোট শ্রমিকের প্রায় ৬৪ শতাংশ নারী।
টি-টোকেন নিয়ে কথা বলতে হলে আসলে ভারতবর্ষে চা-গাছ আবিস্কার, চা-বাগানের প্রসার, তখনকার যোগাযোগব্যবস্থা, চা-শ্রমিকদের আগমনের কারণ, ব্রিটিশ মুদ্রাব্যবস্থা নিয়ে অল্প করে আলোকপাত করতেই হবে। নয়তো এ রচনা অসম্পূর্ণ ঠেকবে।
খ্রিষ্টপূর্ব পাঁচ হাজার বছর আগে সম্রাট শেন নাং চায়ের আবিষ্কার করেন। 'দি হারবাল ক্যানন অব শেন নাং' গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়, চায়ের নির্যাসে ৭২ রকম বিষকে দমন করার ক্ষমতা রয়েছে। ১৬০০ শতকে চা ডাচদের হাত ধরে ইউরোপে যায়। ১৭০০ শতাব্দীতে চা ইংল্যান্ডে পৌঁছায়। লন্ডনে ১৬৫৯ সালে প্রথম চায়ের দোকান খোলা হয়। ১৬৬৭ সালে ব্রিটিশরা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চীন থেকে চা রপ্তানি করতে থাকে। তখন পুরো বিশ্ব চায়ের জন্য চীনের ওপর নির্ভরশীল ছিল। চীনের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে ১৭৮০ সালে পরীক্ষামূলকভাবে চায়ের গাছ তৈরি হয় কিড সাহেবের বাগানে। সেই বাগান এখন কলকাতার বোটানিক্যাল গার্ডেন। কিড সাহেব কোম্পানিকে জানান, শিবপুর চায়ের জন্য উপযুক্ত নয়।
ভারতীয় উপমহাদেশে চা চাষের ইতিহাসে যার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে, তিনি মি. চার্লস আলেকজান্ডার ব্রুস, সংক্ষেপে সি এ ব্রুস। তার নিকট ভারতের চা-শিল্প অনেকটাই ঋণী। মি. ব্রুস আসামে দিনের পর দিন থেকেছেন এখানকার জলবায়ু ও স্থানীয় জনসাধারণের চরিত্র সম্পর্কে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য। আসামের পার্বত্য অঞ্চলে ১৮২৩ সালে মি. ব্রুস প্রথম প্রাকৃতিক চায়ের সাক্ষাৎ পান। আসামের সিদ্ধিয়াতে তিনি ১৮২৫ সালে একটি চায়ের প্রকল্প শুরু করেন। তারপর রবার্ট ব্রুস ১৮৩৪ সালে আসামের উঁচু অঞ্চলে চা-গাছের সন্ধান পান। ১৮৩৬ সালে সেখানে তিনি ভারতীয় চায়ের একটি নার্সারি স্থাপন করেন। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ১৮৩৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি প্রথম ব্যক্তিগত টি কোম্পানি হিসেবে 'The Assam Tea Company' প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি ছিল চীন দেশের বাইরে চা-শিল্পের সামগ্রিক বিকাশের সূচনা। ১৮৪৫ সালে আসাম টি কোম্পানি রাজকীয় সনদ লাভ করে। ৬০টি বাগানে ১২ হাজার হেক্টর জমিতে চা চাষ প্রতিষ্ঠা পায়। দ্রুত চায়ের বিস্তার ঘটতে থাকে। একই সময়ে সুরমা ভ্যালি চা হিসেবে বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলেও চা চাষ শুরু হয়। ১৮৫৫ সালে সিলেটের চাঁদখানি টিলায় চা-গাছের সন্ধান পাওয়া যায়। সিলেটে ১৮৪৭ সালে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে চা উৎপাদন শুরু হয়।
যদিও চা-বাগানের সংখ্যা ধাপে ধাপে বাড়ছিল, কিন্তু আসাম ও সিলেটের চা উৎপাদক অঞ্চলসমূহ প্রায় যোগাযোগবিচ্ছিন্ন ছিল। চা-বাগানের মালিকেরা ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলেন, যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি না হলে কুলি আমদানি অতিরিক্ত খরচসাপেক্ষ এবং এর ফলে লাভের মাত্রাও কম হচ্ছে। স্টিমার ও রেলপথে সরাসরি সেই বাগানগুলোতে যাওয়া সম্ভব ছিল না। ইউরোপীয় মূলধনের লভ্যাংশ দ্রুত মূলধন নিয়োগকারীদের কাছে পৌঁছে দিতে হলে শ্রমিক আমদানির খরচ নিচুতেই রাখতে হবে। সে কারণে চিন্তাভাবনা করেই অশিক্ষিত, হতদরিদ্র, পিছিয়ে পড়া উপজাতি ভারতবাসীদেরই চা-বাগান মালিকপক্ষ প্রথম পছন্দের তালিকায় রেখেছিল। নিজেদের জন্মস্থান থেকে বহু দূরে আসা এই শ্রমিকেরা কোনো দাবি নিয়ে সহজে প্রতিবাদ করতে পারবে না।
অন্য স্থল থেকে শ্রমিক আমদানি করার আরও একটি কারণ হলো, বিহার ও ওডিশার আদিবাসী মানুষদের জঙ্গলের ওপর নিজেদের পরম্পরা ও অধিকার বজায় রাখার জন্য ১৮৩২ সালে চুয়াড় বিদ্রোহ, ১৮৩৩ সালে মানভূম বিদ্রোহ, কোল বিদ্রোহ, ১৮৫৬ সালে সিধু-কানু, সাঁওতাল বিদ্রোহ ইংরেজদের শঙ্কায় ফেলেছিল। ফলে চা-শ্রমিকদের কাজের জন্য যদি প্রচুর লোক অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, তবে নতুন করে বিদ্রোহ দানা বাঁধবে না। সে সময় পত্রপত্রিকায় চা শ্রমিকদের নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়। সোমপ্রকাশ, ঢাকা প্রকাশ নিয়মিতভাবে সিরিজ লেখা শুরু করে। কিন্তু মালিকদের চোখরাঙানিতে সংবাদদাতা লেখা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন।
শ্রমিক বাহিনীকে প্রলোভিত করে ধাপে ধাপে আসাম ও সিলেটের চা-অঞ্চলগুলোতে নিয়ে আসা হতো। এ জন্য যে পদ্ধতি ব্যবহার করা হতো, তা যে কোনো সভ্য মানুষের কাছে বর্বরতার শামিল। শ্রমিক সংগ্রহের জন্য তারা নিয়োগ করেছিল আড়কাঠি (মজুর সংগ্রহকারী), ব্যক্তিগত কমিশন দিয়ে। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে চা-বাগান পর্যন্ত জীবিত অবস্থায় পৌঁছাতে পারলে কমিশন দেওয়া হতো। শ্রমিকেরা চা-বাগানে পৌঁছানোর পর টিপসই দিয়ে চুক্তিবদ্ধ করা হতো ৫ বছরের জন্য। একই বাগানে ৫ বছর কাজ করার জন্য সে বাধ্য থাকত। একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ১৮৬৩ থেকে ১৮৬৬ পর্যন্ত ৮৫ হাজার শ্রমিক আমদানি করা হয়েছিল আসাম ও সিলেটের চা-বাগানগুলোতে।
শ্রমিকদের জন্য কোনো চিকিৎসাব্যবস্থা ছিল না। এমনকি বাসস্থানের জমি নির্বাচনেও যথেষ্ট বৈষম্য ছিল। সব থেকে উঁচু জমিতে তৈরি করা হতো সাহেবদের বাংলো। মাঝারি উঁচু জমিতে তৈরি হতো বাবুদের বাংলো। সবচেয়ে নিচু জমি, যেখানে চা-গাছ লাগানোর জন্য উপযুক্ত নয়, এমন স্থানে তৈরি হতো কুলি লাইন।
এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে শ্রমিকদের পারিশ্রমিক নিয়ে। সেই প্রসঙ্গে এলে জানতে হবে সমকালীন মুদ্রাব্যবস্থা কেমন ছিল আসাম ও সিলেট অঞ্চলে। ১৮২৪ সালে বর্মি বাহিনীকে তাড়িয়ে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি উত্তর-পূর্ব ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তার করে। বঙ্গদেশ তথা সিলেট অঞ্চল অনেক আগেই ১৭৬৫ সালে কোম্পানির করায়ত্ত হয়।
আসামের মুদ্রাব্যবস্থা অনেক জটিল ও মুদ্রা দুষ্পাপ্য ছিল। শ্রীহট্ট কিংবা শ্রীভূমি অঞ্চলে ভালো যোগাযোগব্যবস্থা না থাকায় ক্ষুদ্র মুদ্রা যেমন পাই পয়সা, এক পয়সা ইত্যাদির খুব অভাব ছিল। শ্রীহট্টে দীর্ঘদিন ধাতুনির্মিত পয়সার বদলে কড়ি দিয়ে দৈনন্দিন কেনাবেচা অব্যাহত ছিল। জমির খাজনাও তখন কড়ি দিয়ে প্রদান করার রীতি ছিল।
কড়ি প্রথা উঠিয়ে দিলে শ্রীহট্টে সাধারণ মানুষের কেনাবেচায় সাংঘাতিক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল। শ্রীহট্টে সে সময় প্রচুর বাগান প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় সেখানে বিপুলসংখ্যক শ্রমিকের পারিশ্রমিক দানে প্রচুর খুচরো পয়সার প্রয়োজন ছিল। শ্রীহট্ট ও আসামে স্বল্পমূল্য পয়সার তীব্র আকাল হওয়ায় চা-বাগানের মালিকেরা এক বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়।
চা-বাগানে শ্রমিকদের পারিশ্রমিক পদ্ধতি অন্য শিল্প বা কৃষিক্ষেত্র থেকে আলাদা ছিল। কাজের পারিশ্রমিক হিসেবে নগদ পয়সা এবং বাকি অংশ চাল দেওয়া হতো। এ জন্য প্রচুর পরিমাণে চাল আমদানি করতে হতো। পারিশ্রমিকের আরও একটি পদ্ধতি ছিল দিনহাজিরা। টিক্কা অর্থাৎ অতিরিক্ত কাজ, যা হাজিরার পর শেষ করতে হতো। এ ক্ষেত্রে সামান্য বর্ধিত হারে পয়সা দেওয়া হতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কিছু আগে হাজিরার বদলে ইউনিট প্রথা চালু হয়। এক ইউনিট কাজের জন্য এক আনা দেওয়া হতো। ১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে চালের আকাল হয়। ফলে নগদ পয়সা দিতে হয় পারিশ্রমিক হিসেবে।
১৮৩৫ থেকে ১৮৫৮ পর্যন্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এক পাই, আধা পয়সা, এক পয়সা, দুই পয়সা, দুই আনা মূল্যের মুদ্রা তৈরি করেছিল। মুদ্রাগুলোর সরবরাহ খুব কম ছিল। ফলে একটি সমান্তরাল মুদ্রা আসাম, সিলেট, ভারতের উত্তরবঙ্গের চা-বাগানে চালু হয়। এইসব মুদ্রার সরকারি স্বীকৃতি ছিল না বলে এগুলোকে টোকেন বা কুপন বলা হয়।
দুর্গম অঞ্চলে যোগাযোগব্যবস্থার বিচ্ছিন্নতার কথা আগেই বলেছি। কিন্তু কলকাতা থেকে এই টোকেনগুলো বাগান অবধি পৌঁছানো সহজ ছিল না। স্টিমার চলত কলকাতা থেকে গোয়াহাটি পর্যন্ত। সেখান থেকে আসাম ও সিলেটের বাগানে দেশীয় নৌকাযোগে নিয়ে যাওয়া হতো। মুদ্রাগুলো অনেক ছোট ছোট থলেতে রেখে, প্রতিটি থলে ভাসমান বাঁশের ভেলায় বেঁধে রাখা হতো। যদি নৌকা দুর্ঘটনাগ্রস্ত হয়, তবে ভেলায় বেঁধে রাখা থলেগুলো ভেসে থাকবে ও উদ্ধার করা যাবে।
চা-বাগানের নিজস্ব মুদ্রা চালু হওয়াতে দুর্গম অঞ্চলে লেনদেনে গভীর প্রভাব ফেলে। এই মুদ্রার ব্যবহার চা-বাগানের মাঝে সীমিত থাকার কারণে শ্রমিকেরা নির্দিষ্ট মহাজনদের কাছ থেকেই নির্ধারিত মূল্যে দৈনন্দিন জিনিসপত্র কিনতে বাধ্য হতো।
এসব তথাকথিত মুদ্রা তৈরি হতো মিশ্র ধাতু দিয়ে। কাঁসা, তামা, জিঙ্ক, টিন ও কার্ডবোর্ড দিয়ে তৈরি রেলওয়ে টিকিটের মতো দেখতে টোকেনও চালু ছিল। মুদ্রাগুলো ভিন্ন ভিন্ন আকৃতির ছিল, কারণ নিরক্ষর চা-শ্রমিকেরা যাতে সহজেই নিজের বাগানের টোকেন চিনতে পারে।
আরও আশ্চর্যের বিষয়–পাশাপাশি দুই বাগানের দুই রকম মুদ্রার প্রচলন ছিল।
এই টোকেনগুলো সাধারণত কুড়ি থেকে একত্রিশ মিলিমিটার পর্যন্ত চওড়া ছিল। অধিকাংশ টোকেনেই ইংরেজি ভাষা ব্যবহার হতো। টোকেনগুলোতে প্রধানত ইংরেজিতে চা-বাগানের নাম, মূল্য ও নির্মাণ সন উল্লেখ থাকত।
সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, টোকেনগুলো তৈরি হতো কোথায়। ধাতুর টোকেনগুলো তৈরি হয়েছিল ইংল্যান্ডের বার্মিংহামে এক ব্যক্তিগত মালিকানার টাকশালে। প্রথমে এই প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল 'আর হিটন অ্যান্ড সন্স'; পরে নাম হয় মিন্ট বার্মিংহাম লিমিটেড। জানা যায়, সামান্য কিছু টোকেন কলকাতার সরকারি টাকশালেও তৈরি হয়েছিল।
তবে কলকাতা কিংবা বাংলাদেশে এই সম্পর্কে কোনো নথিপত্র পাওয়া যায়নি। কিন্তু বার্মিংহামের 'আর হিটন অ্যান্ড সন্স' এখনো এ বিষয়ে তাদের নথিপত্র ও নমুনা তাদের সংগ্রহশালায় রেখে দিয়েছে।
সত্য কথা, আধুনিক মন থেকে চা-বাগানের এই বিনিময় মুদ্রার নাম মুছে গেছে। অথচ ভুলে যাওয়া এই মুদ্রাব্যবস্থা আসাম ও বঙ্গদেশে প্রায় ১০০ বছর চালু ছিল। আজ অবধি শত শত চা-বাগানের মধ্যে মাত্র ৮৫টি বাগানের কয়েক শ টোকেনের কথা জানা গেছে। অজানা অংশের পাল্লা এখনো বেজায় ভারী। তবে একটি সুখকর দিক অবশ্যই রয়েছে, সেটি হলো নতুন গবেষণার দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে।
ইতিহাসের পাতা ঘুরে এবার আসি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার গল্পে। মানে প্রথম কবে টি-টোকেন দেখলাম, সেগুলো নিয়ে আগ্রহ তৈরি হলো, তার সামান্য জানবার প্রয়াস তুলে ধরছি।
প্রথম যেদিন টি-টোকেন দেখেছি!
চা-শ্রমিকদের মজুরি মেটানোর জন্য ভিন্ন ধরনের মুদ্রার প্রচলন করেছিল ব্রিটিশ বণিকেরা, যা প্রচলিত মুদ্রার বাজার থেকে ছিল একেবারেই আলাদা, এ কথা জেনেছি চা-বাগানের ইতিহাস পড়তে গিয়ে।
এই মুদ্রার কথা একেবারেই ভুলে গিয়েছিলাম। সত্যি কথা বলতে, এই মুদ্রা বিলুপ্ত ভেবে এটি দেখবার আগ্রহ ও চিন্তা কোনোটিই মাথায় আসেনি। ট্রাভেল ডকুমেন্টারি 'Tombs: Tea Planters Cemeteries in Sylhet'-এর কাজ করতে গিয়ে দেখা হলো, কথা হলো আশরাফ আহমেদের সাথে। তার ব্যক্তিগত সংগ্রহে রয়েছে বাগানের কিছু বিলুপ্ত টি-টোকেন।
আশরাফ আহমেদের একটি ভিডিও ইন্টারভিউ নেওয়ার জন্য তার বাসায় যাই। চা-বাগানের সাথে আশরাফ আহমেদের সম্পর্ক দীর্ঘ ৫০ বছরের। তিনি ১৯৭৪ সালে চা-বাগানে তার কর্মজীবন শুরু করেন। বাংলাদেশে তিনি একজন সুপরিচিত চা-বিশেষজ্ঞ। পেশাগত এই বৈশিষ্ট্য ছাড়াও তিনি দারুণ একজন ডাকটিকিট, টি-টোকেন সংগ্রাহক ও ইতিহাস অনুরাগী। পাকিস্তান বেতারেও কাজ করেছেন তিনি ১৯৬৮ থেকে ১৯৭২ সাল অবধি। একজন চা-বিশেষজ্ঞ ও ইতিহাস অনুরাগী হিসেবে সংগত কারণেই আমার নির্মিত তথ্যচিত্রে আশরাফ আহমেদের মন্তব্য ভীষণ মূল্যবান ছিল। সে কারণেই আশরাফ আহমেদের সাথে দেখা, একই কারণে টি-টোকেন দেখা ও জানা।
আশরাফ আহমেদের ব্যক্তিগত সংগ্রহে ১৫টি টি-টোকেন রয়েছে। নিজের আগ্রহ থেকে কয়েনগুলো নিয়ে একটু জানতে আগ্রহ হলো। ১৫টির মাঝে ১৩টি কয়েন সম্পর্কে কিছুটা অবগত হলাম আশরাফ আহমেদের উপহার দেওয়া শংকর কুমার বসুর একটি বই থেকে। তৎকালীন প্রতিটি কয়েনেই বাগানের নাম লেখা থাকত। সেই জন্যই শনাক্ত করা সহজ হয়েছে। তবে কয়েনের দুই দিকেই নানা ইনফরমেশন দেওয়া আছে। কিন্তু স্যারের সংগৃহীত বক্সের কয়েনগুলো শুধু একদিকে পড়া যায়। সেগুলো বক্সের সাথে ফিক্সড করে রাখা হয়েছে।
আমরাইল সেন্টার: এই বাগানের মালিকানায় ছিল দ্য সাউথ সিলেট টি কোম্পানি লিমিটেড। বর্তমানে এই বাগান জেমস ফিনলের অধীনে। ডিম্বাকৃতির এই কয়েন বক্সে রয়েছে দুটি।
আলীনগর বাগান: এই বাগানের মালিকানায় ছিলেন টি ম্যাকমিকিন এবং ডাবলিউ রবার্টসন। এটি বর্তমানে শমশেরনগরের কাছে। গোলাকার ২৮ মিমি ব্যাসের এই মুদ্রা তৈরি করা হয়েছিল ৭৬০০টি। কয়েনের মাঝের ছিদ্র চার মাথা তারার মতো। বক্সে রয়েছে ১টি।
কাজুরীছড়া: এই বাগানটিও দ্য সাউথ সিলেট লিমিটেডের অধীনে ছিল। টোকেনের ওপরে একটি ও নিচে দুটি ছিদ্র আছে। বক্সে এই কয়েন রয়েছে ৪টি।
লংলা চা বাগান: ১৮৭৮ সালে এম ফক্স ছিলেন এই বাগানের মালিক। এই বাগানের তিন ধরনের টোকেন পাওয়া যায়। পুরুষ, মহিলা ও শিশুশ্রমিকদের আলাদা আলাদা টোকেন ছিল। বক্সে ২৮ মিমি ব্যাসের, মাঝে একটি ছিদ্রসহ ২টি মুদ্রা রয়েছে।
লংলা চা বাগান: আকারে ছোট ২৫ মিমি ব্যাসের এই টোকেন সম্ভবত শিশু ও মহিলা চা-শ্রমিকদের জন্য ব্যবহৃত হতো।
সাতগাঁ বাগান:১৮৮৩ সালে এটি তৈরি করা হয়েছিল বলে শংকর কুমারের বইতে লেখা রয়েছে। SATGHAS বানানটি এ রকম। ব্রিটিশরা যেভাবে বাংলা উচ্চারণ করত, সেভাবেই লেখা হয়েছে সাতগাঁ। বক্সে এই টোকেন আছে ১টি।
শংকর কুমার বোসের বইতে কিছু অশনাক্ত টোকেনের ছবি রয়েছে। আশরাফ আহমেদের বক্সে সেই অশনাক্ত টোকেনের একটি রয়েছে। পিতলের ৩০ মিমি ব্যাসের টোকেনটিতে ওপরের দিকে একটি ছিদ্র, মাঝে ব্রিটিশ ক্রাউনের ছবি এবং নিচে লেখা রয়েছে CTC।
ধামাই চা-বাগান: ১৮৮৭ সালে প্রতিষ্ঠা হয়। অবিভক্ত সিলেটের করিমগঞ্জে ছিল এই বাগান। ২০.৫ মিমি ব্যাসের মুদ্রা এটি। মুদ্রার যে পিঠ দেখা যাচ্ছে, তাতে লেখা রয়েছে O.S. & CO.। বর্তমানে এটি মৌলভীবাজার জেলার অন্তর্গত।
আগেই বলেছি, আমি মুদ্রার একটি পিঠ ধরেই বইয়ের সাথে বর্ণনা মিলিয়েছি। টোকেনের ভিন্ন পাশেও অনেক ইনফরমেশন রয়েছে। যেহেতু এক পিঠই দেখার সুযোগ আমি পেয়েছি, তাই একেবারে নির্ভুল না-ও হতে পারে।
ব্রিটিশদের অনেক বিষয়, কর্মপদ্ধতি আমার পছন্দ নয়, কিন্তু ডকুমেন্টেশনে তাদের ওপরে বিশ্বে আর কোনো জাতি রয়েছে বলে আমি মনে করি না। যে টোকেনগুলোর বাজারমূল্য ছিল না, সরকারিভাবে তৎকালীন সময়ে গ্রহণযোগ্যতাও ছিল না। সেই মুদ্রার দুই পিঠব্যাপী গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংযোজনপদ্ধতি অনুকরণীয় বটে। মুদ্রা তৈরির সাল, চা-বাগানের নাম, লোগো সমস্ত তথ্য রয়েছে মুদ্রাতে। এমন নয় যে পরবর্তীতে এই তথ্যগুলো সংরক্ষণ করা হয়নি। সেটিও হয়েছে। কোন মুদ্রা কতগুলো তৈরি করা হয়েছিল, সে তথ্যও উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।
এটি আসলে বিস্ময়ের কিছু নয় যে ব্রিটিশরা একসময় পুরো বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ শাসন করেছে।
সমকালীন সময়ে চা-বাগানের টোকেনগুলোকে ভাগ করা হয়েছিল—আসাম-ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার টোকেন, আসাম-বরাক উপত্যকার টোকেন, আসাম-সুরমা উপত্যকার টোকেন। সুরমা উপত্যকার কথা এলেই সিলেটের প্রায় সব বাগান অন্তর্ভুক্ত হবে, বলাই বাহুল্য।
টি-টোকেনের প্রতি আগ্রহের কারণে চা-বিশেষজ্ঞ আশরাফ তার ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে বিলুপ্ত একটি মুদ্রা আমাকে উপহার দিয়েছেন।
সহায়িকা:
ব্রিটিশ মুদ্রা ব্যবস্থায় চা বাগানের পয়সা: শংকর কুমার বসু
চা ইতিকথা: ড. মাইনউদ্দিন আহমেদ
A Quarter, Tea Garden Tokens: Robert Puddester