২০২০-২১ অর্থবছরে পাট রপ্তানি রেকর্ড ৩১% বৃদ্ধি
আশানুরূপ দাম না পাওয়ায় চাষিদের অনাগ্রহে উৎপাদন কমে দেশে কাঁচা পাটের সংকটের শঙ্কার মধ্যে রপ্তানিতে আশা জাগিয়েছে গোল্ডেন ফাইবার।
এরইমধ্যে, বিগত এক যুগের রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ ১১৬.১৪ কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেছে দেশের পাট ও পাটজাত পণ্য।
বাংলাদেশ থেকে এখন কাঁচা পাটের পাশাপাশি পাটের সুতা, দড়ি, ব্যাগ ও থলে এবং হাতে বাছাই করা আঁশ রপ্তানি করা হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয় পাটের সুতা ও দড়ি পণ্য। পাট দিয়ে তৈরি বৈচিত্র্যময় পণ্য রপ্তানিও বেড়েছে।
পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের অধীন জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টার গত বছর ২৮২টি বহুমুখী পাটপণ্যের তালিকা প্রণয়ন করে। এসব পণ্যের তালিকায় রয়েছে সব ধরনের ব্যাগ, বাস্কেট, নারী-পুরুষের জুতা-সেন্ডেল, ম্যাটস, জুয়েলারি, স্যুটস, সোয়েটার, খেলনা, বিয়ের সামগ্রী, শাড়ি, জুট ডেনিম, শার্ট, পাঞ্জাবি, কোটি, পাট থেকে উৎপাদিত গার্মেন্ট সামগ্রী ইত্যাদি।
বাংলাদেশ জুট গুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেজিইএ) চেয়ারম্যান মো. শফিকুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'দেশে যে পরিমাণ পাট উৎপাদন হয়, তা পর্যাপ্ত; কিন্তু কিছু ব্যবসায়ী পাট কিনে স্টক করার কারণে সংকট তৈরি হয়। গত বছর সংকট হয়নি, একদম কাটায় কাটায় হয়েছে; মানে যা চাহিদা ছিল, সে পরিমাণই যোগান এসেছে। তবে কেউ বেশি পরিমাণ পাট স্টক করলে সংকট দেখা দেবে।'
তিনি আরও বলেন, 'বিদেশে বিগ ভলিউমে পাট রপ্তানি হয় কমার্শিয়াল আইটেম, যা হচ্ছে জুট ইয়ার্ন ও জুট ব্যাগ ইত্যাদি। দেশের বাজারেও এই পণ্যের ব্যবহার বেশি। মেজর এই খাতের সঙ্গে এখন পাটের বাই-প্রডাক্টও রপ্তানি হচ্ছে। এই ডাইভারসিফাইড বা ভ্যালু অ্যাডেড পণ্যও রপ্তানি বাড়াতে ভূমিকা রাখছে।'
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিগত কয়েক বছর পাট চাষে খরচের তুলনায় দাম পাননি চাষিরা, যাতে পাটচাষ কমেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিরূপ আবহাওয়াও এর অন্যতম কারণ। তবে চাহিদা বেশি থাকায় এবার পাটের ভালো দাম পাচ্ছেন চাষিরা।
পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি চিত্র
বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের প্রায় ১৩৫টি দেশে ২৮২টি পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি হয়। বিগত বছরের তুলনায় ২০২০-২০২১ অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি বেড়েছে ৩১%। যদিও তা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ০.৪৭% কম।
২০২০-২০২১ অর্থবছরে পাট রপ্তানি হয়েছে ১১৬.১৪ লাখ ডলার, যা টাকার অংকে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। ২০১৮ সালের পর এবারই পাট ও পাটজাত পণ্য থেকে এক বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় হয়েছে।
ইপিবির তথ্যানুযায়ী, বিগত ১২ বছরে ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে চারবার। প্রথমবার ২০১০-২০১১ অর্থবছরে ১১১.৪৯ কোটি ডলার রপ্তানি আয় হয়। দ্বিতীয়বার ২০১২-২০১৩ অর্থবছরে ১০৩.০৬ কোটি ডলার, তৃতীয়বার ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে ১০২.৫৫ কোটি ডলার ও সর্বশেষ ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ১১৬.১৪ কোটি ডলার।
কাঁচা পাট রপ্তানি হয়েছে ১৩.৮১ কোটি ডলার, যা আগের বছরের চেয়ে ৬% বেশি। জুট ইয়ার্ন এবং টোয়াইন আগের বছরও রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি রপ্তানি হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৭৫ কোটি ডলার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে রপ্তানি হয়েছে ৭৯.৯০ কোটি ডলার, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ৪২ শতাংশ বেশি আর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৬.৫৪ শতাংশ বেশি।
পাটের ব্যাগ ও থলে রপ্তানি বেড়েছে ৩০ শতাংশ, অন্যান্য পণ্য ৫% এবং হাতে বাছাই করা পাটের আঁশ ও স্ট্যাপল ফাইবার রপ্তানি বেড়েছে ১০ শতাংশ।
পাট সংকটের শঙ্কা
বাংলাদেশের গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলে পাট উৎপন্ন হতো প্রায় তিন হাজার বছর আগে। স্বাধীনতার পর দেশের প্রধান অর্থকরী ফসল ছিল পাট। রপ্তানি আয়ের অন্যতম খাত এটি। তবে সোনালী আশেঁর দেশেই সংকটের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। কাঁচাপাট রপ্তানি, কালোবাজারীদের কাচাঁপাট পাচার বন্ধ ও ফড়িয়াদের কারণে পাটের সংকট হবে বলে মনে করছেন পাটকল মালিকরা।
বিগত কয়েক বছর ধরে পাট উৎপাদন কমছে, সাম্প্রতিক সময়ে বাড়তি দামের কারণে লাভ হওয়ার পরও পাট চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন চাষি। এর পেছনে অন্যতম কারণ পাটের দাম অস্বাভাবিকভাবে ওঠা-নামা, বন্যা, শিলাবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড় ও পাট পঁচানোর জন্য প্রয়োজনীয় পানির অভাব।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৮২ লাখ ৮৩ হাজার টন পাট উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। যেখান থেকে ৭৪ লাখ টন পাট পাওয়া গেছে। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮৫ লাখ ৭৬ হাজার টন পাট উৎপাদন হয়েছিল। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৮০ লাখ টন পাট উৎপাদিত হয়। ২০২১-২২ অর্থ বছরে ৮৬ লাখ টন কাঁচা পাট উৎপাদন হবে বলে আশা করছেন কৃষি অধিদপ্তর।
মোনামী জুট মিলের প্রধান নির্বাহী সৈয়দ আলী আলফি সানী আকাশ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "সরকার যদি আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত কাঁচা পাট বিদেশে রপ্তানি বন্ধ না করে এবং কালোবাজারিদের কাঁচা পাট পাচার রোধ ও ফড়িয়াদের নিয়ন্ত্রণ না করে তাহলে এবারও চাহিদার তুলনায় ৫-১০ লাখ বেল পাটের সংকটে পড়বে। এছাড়াও বন্ধ হয়ে যাওয়া সরকারি ১৭টি পাটকল যদি পিপিপি'র মাধ্যমে এ বছর নতুন করে চালু হলে ওই পাটকলগুলোরও অনেক পাটের প্রয়োজন হবে। তাই আমরা সরকারের কাছে আবেদন করেছি দেশীয় পাটকলগুলোর চাহিদা আগে নিশ্চিত করতে, ডিসেম্বর পর্যন্ত কাঁচা পাট বিদেশে রপ্তানি বন্ধ রাখতে।"
তুলিকার প্রধান নির্বাহী ইশরাত জাহান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "কাঁচা পাট পাচার, সিন্ডিকেট ও ফড়িয়াদের কারণে গত বছর তিনগুণ বেশি দামে ফেব্রিক্স কিনতে হয়েছে, ফলে বেশি দামে পণ্য রপ্তানি করায় আমাদের রপ্তানি ভলিউম কমেছে অনেক। রপ্তানি আয় বাড়লেও তাতে আমাদের লাভ হচ্ছে না।'
বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিউটের তথ্যমতে, ১৯৯০-এর দশকে দেশে পাট হতো ১২ লাখ হেক্টর জমিতে। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৭ লাখ ২৬ হাজার হেক্টর জমিতে চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও চাষ হয়েছে মাত্র ৬ লাখ ৮২ হাজার হেক্টর জমিতে। ফরিদপুর, যশোর, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, টাঙ্গাইল, জামালপুর এবং ঢাকা জেলায় পাট সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হয়।
ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা উপজেলারর পাটচাষি আব্দুস সালাম আহমেদে টিবিএসকে বলেন, '২০১০ সালে আমি প্রায় ২৫ একর জমিতে পাট চাষ করেছিলাম, কিন্তু পাটের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় চাষের জমি কমিয়ে দিই, এ বছর আমি মাত্র ১০ একর জমিতে পাট চাষ করছি।'
চাষি আসাদ মোল্লা টিবিএসকে বলেন, 'গত ১৫-২০ বছর ধরে পাট পচানোর পানি সংকট বেড়েই চলেছে। শুকনো মৌসুমে নদীর পানি অনেক কমে যায়। এতে ডোবায়ও (জলাশয়) পানি থাকে না। তখন পাট পচানোর জন্য সমস্যায় পড়তে হয়। গত ১০ বছরে আমার পাট চাষের জমির পরিমাণ অর্ধেকে কমিয়ে এনেছি।'
কৃষির অ্যাডিশনাল ডেপুটি ডিরেক্টর (কন্ট্রোল রুম) খন্দকার এম. রাশেদ ইফতেখার টিবিএসকে বলেন, 'এই বছর ৭ লাখ ৪৫ হাজার ৯০০ হেক্টর জমিতে দেশে পাটের পর্যাপ্ত ফলন হয়েছে। কৃষক পর্যায়েও কোনো ধরনের অভিযোগ পাইনি। আশা করি গত বছরের তুলনায় এবার ফলন বেশি হবে, পাটের কোনো সংকট হবে না।'
বীজ আমদানি
বাংলাদেশের পাট বীজের প্রায় ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ প্রতি বছর ভারত থেকে আমদানির মাধ্যমে পূরণ করতে হয়। পাট মৌসুম এলেই তাদের বীজ নিয়ে শঙ্কায় থাকতে হয়। ভারত থেকে সময়মতো বীজ পাওয়া যায় না। এছাড়া বীজের মান নিয়েও দুশ্চিন্তা রয়েছে।
এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (বীজ ও অন্যান্য উপকরণ) ড. সুরজিত সাহা রায় বলেন, 'আগামী ৫ বছরেই পাটবীজে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে বাংলাদেশ। প্রতি বছর ভারত থেকে সাড়ে ৪ হাজার টন বীজ আমদানি করা হয়। আগামী ২০২১-২২ থেকে ২০২৫-২৬ এই ৫ অর্থবছরের মধ্যে দেশে ৪ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন পাটবীজ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর ফলে দেশে আর কোনো পাটবীজ সংকট হবে না; আমদানি নির্ভরতাও থাকবে না।'
পাট খাত ও পাটকলের অবস্থা
বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএসএ) তথ্যমতে, সারা দেশে ২৯১টি জুট মিল রয়েছে, যার মধ্যে ৫৪টি বন্ধ। এসব মিলে গড়ে ৭৮ লাখ বেল জুট উৎপাদন হয়। দেশে অভ্যন্তরীণ চাহিদা ৬৫ লাখ বেল আর বিদেশে রপ্তানি হয় ১৪ লাখ বেল।
সংগঠনটির হিসাবমতে, বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশনের আওতায় রয়েছে ৯৪টি পাটকল, যার মধ্যে ১২টি বন্ধ। বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএমএ) আওতায় রয়েছে ১৬৫টি মিল, যার মধ্যে ৪২টি বন্ধ। আর বাংলাদেশ জুট মিলস কর্পোরেশনের (বিজেএমসি) আওতায় রয়েছে ৩২টি।
পাটকলগুলোতে কর্মসংস্থান প্রায় দুই লাখ। বিজেএসএ -এর তথ্যমতে, তাদের আওতায় থাকা মিলগুলোর কর্মসংস্থার প্রায় ৭৫ হাজার, বিজিএমএ-এর আওতায় থাকা মিলে ৬০ হাজার আর বিজেএমসির মিলগুলোতে কর্মসংস্থান প্রায় ২৭ হাজার মানু্ষের।
সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, পাট শিল্প খাতে বেসরকারি উদ্যোক্তারা ভালো ব্যবসা করলেও লোকসান গুনছে সরকারি পাটকল। লোকসান বৃত্ত থেকে বের হতে সরকারি পাট কলকে বেসরকারি খাতে লিজ দিচ্ছে সরকার।
ইতোমধ্যে সরকার টেন্ডার আহ্বান করার পর দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তারা লিজ পেতে আবেদন জানিয়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকে গঠিত কমিটি যাচাই-বাছাই করে চূড়ান্ত করবে।
১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ রাষ্ট্রপতির এক আদেশে ব্যক্তিমালিকানাধীন, পরিত্যক্ত ও সাবেক ইস্ট পাকিস্তান ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনের ৭৮টি পাটকল তদারকি, নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনায় বিজেএমসি গঠিত হয়। ১৯৮১ সালে মিলের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৮২।
১৯৮২ সালের পর ৩৫টি পাটকল বিরাষ্ট্রীয়করণ, ৮টি মিলের পুঁজি প্রত্যাহার ও ১টি পাটকল একীভূত করা হয়। ১৯৯৩ সাল থেকে বিশ্বব্যাংকের পাটখাত সংস্কার কর্মসূচির আওতায় বিভিন্ন সময়ে ১১টি কল বন্ধ, বিক্রি ও একীভূত করা হয়। ২০০২ সালে আদমজী জুট মিলস বন্ধ করা হয়। বিজেএমসি'র নিয়ন্ত্রণাধীনে বর্তমানে পাটকল আছে ৩২টি। সর্বশেষ তিনটি নন-জুট মিলসহ সচল ছিল ২৫টি।