‘মেড ইন বাংলাদেশ’ প্রচার করবে সিএনএন
তৈরি পোশাক শিল্পের কমপ্ল্যায়েন্সসহ বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় রপ্তানি খাতের ইতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশের ইতিবাচক প্রচার বা ব্র্যান্ডিং করবে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বৈশ্বিক সংবাদমাধ্যম ক্যাবল নিউজ নেটওয়ার্ক (সিএনএন)।
আগামী সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাস থেকে প্রায় এক বছরব্যাপী সিএনএন-এ বাংলাদেশ ব্র্যান্ডিং চলবে। এতে তৈরি পোশাক, কৃষি এবং পাট, চামড়া ও চামড়াজাত সামগ্রী, প্রকৌশল এবং দ্বি-চক্রযান, ইলেক্ট্রনিক্স এবং ডিজিটাল ডিভাইস, আইসিটি, ই-বাণিজ্য ও ডিজিটাল পরিষেবা, চিকিৎসা সরঞ্জাম ও ফার্মাসিউটিক্যালস- এ ৭টি খাতকে গুরুত্ব দেয়া হবে।
এতে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের যে সুনাম তৈরি হবে তার ফলে বিদেশি ক্রেতা ও ব্র্যান্ডগুলোর কাছে বাংলাদেশি পণ্যের চাহিদা বাড়বে। এছাড়া, বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগও বাড়বে বলে আশা করছে সরকার।
বৈশ্বিকভাবে 'মেড ইন বাংলাদেশ' এর সুনাম তুলে ধরতে বুধবার এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ ফরেন ট্রেড ইনস্টিটিউট (বিএফটিআই) ও সিএনএন ইন্টারন্যাশনাল কমার্শিয়াল-এর মাঝে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতার মডেলে বেসরকারিখাতের অর্থায়নে এই প্রচারণা চলবে।
এই প্রচারণায় কি পরিমাণ অর্থ ব্যয় হবে তা জানাতে পারেননি বিএফটিআই এর ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ওবায়দুল আজম কিংবা সিএনএন ইন্টারন্যাশনাল কমার্শিয়ালের পক্ষে চুক্তি করা সিএনএনের স্থানীয় প্রতিনিধি স্পেলবাউন্ড এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাদেকুল আরেফীন।
তবে কয়েক মাস আগে ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ এর এক অনুষ্ঠানে এই প্রচারণায় প্রায় ৪৫০ মিলিয়ন ডলার খরচ হবে বলে ধারণা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান।
সংশ্লিষ্টরা জানান, তৈরি পোশাকখাতে গ্রিন ইন্ডাস্ট্রি স্থাপনে বাংলাদেশ বিশ্বে নেতৃত্ব দিচ্ছে। ওষুধখাতসহ অন্যান্য রপ্তানিমুখী খাতেও বিশ্বমানের অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এসব অগ্রগতি নিয়ে খুব বেশি প্রচার হয় না। বরং বাংলাদেশের নেতিবাচক দিকগুলো গুরুত্ব পায়। এজন্য বিদেশি ভোক্তা ও ব্র্যান্ডগুলোর কাছে বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের ইতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
দেশে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে বিভিন্ন দেশে রোড শো আয়োজন হলেও রপ্তানি বাড়াতে এ ধরণের প্রচারণার উদ্যোগ এটাই প্রথম। তবে ২০১৩ সালে লন্ডনের 'দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট' পত্রিকায় আওয়ামী লীগ সরকারের ওই মেয়াদের প্রথম চার বছরের সাফল্য প্রচারে ৬ পৃষ্টার ক্রোড়পত্র প্রচার করে অর্থ মন্ত্রণালয়।
১.৯০ লাখ ডলার ব্যয়ে ওই প্রচারণার ব্যয় যোগান দিতে বেসরকারি ব্যাংকগুলো থেকে ৭০ লাখ টাকা এবং রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ৪০ লাখ টাকা চেয়ে নেয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, সিএনএন ইন্টারন্যাশনালে 'মেড ইন বাংলাদেশ' ব্র্যান্ডিং বাস্তবায়নে বাণিজ্যমন্ত্রীকে প্রধান উপদেষ্টা করে ১১ সদস্যের একটি স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করেছে সরকার। এছাড়া, বিএফটিআই এর সিইওকে সভাপতি করে একটি 'অর্থ-সংস্থান উপকমিটি' গঠন করা হয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, বিশ্ব অর্থনীতি কোভিড-১৯ মহামারির প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশ অদম্য মনোভাব দেখিয়েছে এবং সফলভাবে দেশের অর্থনীতিকে সঠিক দিকে এগিয়ে নিয়েছে। বাংলাদেশের সাফল্যের গল্পগুলো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রচার করা দরকার এবং 'মেড ইন বাংলাদেশ' ক্যাম্পেইন সিএনএন-এর মাধ্যমে বিশ্ব দর্শকদের কাছে পৌঁছাতে সহায়ক হবে।
'মেড ইন বাংলাদেশ' ক্যাম্পেইনে সিএনএন টিভি বিজ্ঞাপন, বিস্পোক সম্পাদকীয়, প্রোমো অডিও ভিজ্যুয়াল, ভিগনেটস এবং একটি 'মেড ইন বাংলাদেশ' থিম উইক তৈরি ও সম্পাদনা করবে। পাশাপাশি সম্ভাব্য ৭টি রপ্তানি খাত এবং ১০টি শীর্ষস্থানীয় রপ্তানিমুখী সংগঠনের প্রচারেও সিএনএন ভূমিকা রাখবে।
মেইড ইন বাংলাদেশ ব্র্যান্ডিংয়ের এই উদ্যোগের প্রশংসা করেছেন ফেডারেশন অফ বাংলাদেশ চেম্বারস অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সাবেক সহ-সভাপতি ও বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন, "গ্রিন ফ্যাক্টরি, কমপ্ল্যায়েন্সের দিক থেকে আমাদের অনেক সফলতা থাকলেও আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় সেভাবে প্রচার হয় না। তাই এ ধরণের উদ্যোগ নেওয়ার প্রয়োজন ছিল"।
লেদার গুডস এন্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স এন্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এলএফএমইএবি) এর সভাপতি মোঃ সাইফুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "বাংলাদেশের ট্যানারি শিল্প হাজারীবাগ থেকে যে সাভারে অনুকূল পরিবেশে স্থানান্তর হয়েছে, তা আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ইতিবাচকভাবে প্রচার হওয়া প্রয়োজন। একইসঙ্গে সেন্ট্রাল ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপন ও লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের সার্টিফিকেট পাওয়া গেলে এ খাতের রপ্তানি বাড়ার সুযোগ তৈরি হবে। বিদেশে ইতিবাচক ব্র্যান্ডিং হলে বাংলাদেশের দর মধ্যস্ততার সক্ষমতাও বাড়বে"।
স্পেলবাউন্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাদেকুল আরেফীন টিবিএসকে বলেন, "সিএনএন তাদের ওয়েবসাইটে বাংলাদেশের একটা কনটেন্ট হাব পোস্ট করবে, যেখানে বাংলাদেশের অগ্রগামী খাতগুলোর প্রচার হবে। বাংলাদেশের সফলতার গল্পগুলো এই কনটেন্ট হাব ও অন্য মাধ্যমে তুলে ধরবে সিএনএন"।
মোহাম্মদ সাদেকুল আরেফীন বলেন, "সিএনএন এর পক্ষে যারা কাজ করতে বাংলাদেশে আসবে তাদের আমরা সহায়তা দিবো। ইতোমধ্যেই বেসরকারি খাতের অনেক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমাদের আলোচনা হয়েছে"।
এই প্রচারণায় বাংলাদেশের খরচ কেমন হবে, এমন প্রশ্নে আরেফীন বলেন, খাতগুলো কতক্ষণ ধরে এবং কোন ধরণের প্রচারণা চালাবে, তার ওপর এটি নির্ভর করবে।
মোহাম্মদ সাদেকুল আরেফীন বলেন, সেপ্টেম্বর –অক্টোবর থেকে সিএনএনে প্রচারণা শুরু হবে। সে লক্ষ্যে কাজ চলছে।
বিএফটিআই-এর ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ওবায়দুল আজম বলেন, `আমরা বিশ্বাস করি, সিএনএন যে ধরনের মানসম্মত কনটেন্ট তৈরি করে, সেগুলো বিশ্বব্যাপী প্রচারের মাধ্যমে আমাদের বিভিন্ন শিল্পের রপ্তানি কৌশল নিশ্চিত করা সহ আন্তজার্তিক বাজারে বাংলাদেশের বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও দীর্ঘমেয়াদে দেশের সামষ্টিক অর্জনে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।'
টিবিএসকে ওবায়দুল আজম বলেন, "বেসরকারি খাতগুলো তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী প্রচারণা চালাবে। আমরা এখানে সংযোগ স্থাপন করে দিব। বেসরকারি অ্যাসোসিয়েশন, সংগঠন, চেম্বার এবং কোম্পানি এই উদ্যোগের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত হয়ে নিজেদের ব্র্যান্ডকে বিশ্বব্যাপী প্রচারের সুযোগ পাবে। যে অর্থ খরচ হবে সেটা তারাই দিবে"।
"মূলত বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের সাফল্যের প্রামাণ্য চিত্র প্রদর্শন করবে সিএনএন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের একটি ভিডিও ও তুলে ধরবে সিএনএন"- জানান তিনি।