দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সুগন্ধি চাল রপ্তানি নিষিদ্ধ করলো সরকার
দেশের বাজারে এরোমেটিক রাইসের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে অবশেষে রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ার মতো কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে সব ধরনের সুগন্ধি চাল রপ্তানি সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ করে বুধবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে চিঠি দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, যা তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর করা হয়েছে।
এই সিদ্ধান্তের ফলে স্কয়ার, প্রাণ, এসিআই, ইস্পাহানী ও সিটি গ্রুপসহ দেশের মোট ৪১টি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের চাল রপ্তানি বন্ধ হয়ে গেলো। এই ৪১ প্রতিষ্ঠানকে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত নির্দিষ্ট পরিমাণ সুগন্ধি চাল রপ্তানির অনুমতি দিয়েছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
প্রতিষ্ঠানগুলো অনুমোদিত কোটার মধ্যে যে পরিমাণ এখনও রপ্তানি করেনি, তা আর রপ্তানি করতে পারবে না বলে বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
স্কয়ার গ্রুপ এবছর ৩ হাজার টন সুগন্ধি চাল রপ্তানির অনুমোদন পেয়েছে। কোম্পানিটি আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত যে পরিমাণ সুগন্ধি চাল রপ্তানির পরিকল্পনা করছিলো, সরকারের নতুন সিদ্ধান্তের কারণে তা আর করতে পারবে না।
চাল রপ্তানি বন্ধের সরকারি এ সিদ্ধান্তকে 'আত্মঘাতী' উল্লেখ করে রপ্তানিকারকরা বলছেন, "হঠাৎ করে রপ্তানি বন্ধ করলে আমরা বাজার ও ক্রেতা-দুটোই হারাবো।"
রপ্তানি নীতি আদেশ অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে চাল রপ্তানি নিষিদ্ধ। তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আগাম অনুমোদন নিয়ে সুগন্ধি চাল রপ্তানির সুযোগ রয়েছে।
এর প্রেক্ষিতেই বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠান ও ট্রেডাররা সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইউরোপ, আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ব্রুনাই, দক্ষিণ কোরিয়াসহ বিশ্বের প্রায় ১৩৬টি দেশে সুগন্ধি চাল রপ্তানি করছে।
২০০৯-২০১০ অর্থবছর থেকে বাংলাদেশ সুগন্ধি চাল রপ্তানি শুরু করে। ওই বছর ৬৬৩ টন সুগন্ধি চাল রপ্তানি হয়। পরের বছরগুলোতে রপ্তানির পরিমাণ বাড়তে বাড়তে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১০,৮৭৯ টনে উন্নীত হয়।
কোভিড পরিস্থিতির কারণে গত অর্থবছর রপ্তানি সামান্য কমে দাঁড়িয়েছে ৯,৫১৭ টন।
সুগন্ধি চালসহ সব ধরনের চাল রপ্তানি নিষিদ্ধ করার অনুরোধ জানিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে লেখা চিঠিতে খাদ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, কোভিড পরিস্থিতির কারণে ২০২০ সালের শুরু থেকে দেশের বাজারে চালের দাম বাড়তে থাকে। বিভিন্ন সময় তা উঠানামা করে ওই বছরের অক্টোবরে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে; যা ডিসেম্বর পর্যন্ত অপরিবর্তিত থাকে।
২০২১ সালের শুরু থেকে সব ধরনের চালের দাম আবারও বাড়তে থাকে এবং নভেম্বর-ডিসেম্বরে এসে মোটা চালের মূল্য স্থিতিশীল হয়। কিন্তু মাঝারি, সরু ও সুগন্ধি চালের মূল্য ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সুগন্ধি চালসহ সব ধরনের চাল রপ্তানি বন্ধ রাখার অনুরোধ জানিয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, "চালের বাজার মূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য খাদ্য অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাসহ স্থানীয় প্রশাসনের মনিটরিং কার্যক্রম অব্যাহত আছে। এছাড়া ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরও নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে। তারপরও সুগন্ধি ও সরু চালের বাজারদর বাড়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।"
"বিষয়টি উদ্বেগজনক, যা নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। সে কারণে সুগন্ধি চালসহ সকল প্রকার চাল রপ্তানি আপাতত বন্ধ করা আবশ্যক।"
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধের প্রেক্ষিতে যে ৪১টি প্রতিষ্ঠানকে সুগন্ধি চাল রপ্তানির অনুমোদন দিয়েছিল, তা বাতিল করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এসব কোম্পানি যাতে অনুমোদিত চাল রপ্তানি করতে না পারে, সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে ২৯ জুন চিঠি পাঠিয়েছে।
গত বছর দেশের বাজারে প্রতি কেজি চিনিগুড়া, কালিজিরা, কাটারিভোগ চালের দাম ছিল ৭০-৮০ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে এসব চালের দাম প্রায় ৭০ শতাংশ বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ১২০-১৩০ টাকা কেজি দরে।
দেশে চালের বাজারদর নিয়ন্ত্রণে দেশজুড়ে অভিযান চালিয়ে স্কয়ার, আকিজ, এসিআই, সিটি ও প্রাণ গ্রুপসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গুদামে ধানের মাত্রাতিরিক্ত মজুদ পায় সরকার। এরমধ্যে শুধু স্কয়ার গ্রুপের দিনাজপুরের একটি গুদামে ৫১৪০ টন সুগন্ধি ধানের মজুদ পাওয়ার পর তা সিলগালা করে মামলা করেছে প্রশাসন।
পরে স্কয়ার গ্রুপ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে এক আবেদনে জানায় যে, আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত তাদের ৩০০০ টন সুগন্ধি চাল বিদেশে রপ্তানির অনুমোদন রয়েছে। তাছাড়া, দেশের বাজারেও চাষী ব্রান্ডে সুগন্ধি চাল বাজারজাত করে কোম্পানিটি।
চাল রপ্তানি বন্ধ বাজার হারানোর আশঙ্কা করেন স্কয়ার ফুড এন্ড বেভারেজের শীর্ষ নির্বাহী অঞ্জন চৌধুরী।
বাংলাদেশ থেকে সুগন্ধি চাল রপ্তানি বাড়লেও এ জাতীয় ধানের উৎপাদনও বেড়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৭ লাখ ৬৬ হাজার ৩০৫ টন সুগন্ধি ধান উৎপাদন হয়, যা বেড়ে গত অর্থবছর প্রায় ১৭ লাখ ৭৫ হাজার ১৭৮ টনে উন্নীত হয়েছে।
তবে দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ায় স্থানীয়ভাবে এ চালের চাহিদাও বেড়েছে। মূলত পোলাও, ফিরনি, পিঠা-পায়েস, খিচুরিসহ বিভিন্ন ধরনের ফাস্টফুড আইটেম তৈরিতেও সুগন্ধি চালের ব্যবহার বাড়ছে।
দেশে সুগন্ধি চালের দাম বাড়ার কারণ হিসেবে করপোরেটগুলোকে দায়ী করেছেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। তিনি বলেন, "কোম্পানিগুলো বাজার থেকে সব ধান কিনে মজুদ করার পর খোলাবাজারে এসব চালের সংকট তৈরি হয়। এই সুযোগে কোম্পানিগুলো চাল প্যাকেটজাত করে উচ্চদামে বিক্রি করে।"
সরকারের এ সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে বাংলাদেশ চাল রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি মো. শাহ আলম টিবিএসকে বলেন, "অ্যারোমেটিক রাইসের রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত আত্নঘাতি। কারণ, এটা দেশের কেউ প্রধান খাদ্য হিসেবে খায় না। আর আমরা যখন ধারবাহিকভাবে বিভিন্ন দেশের মার্কেটে ঢুকতে শুরু করেছি, তখন রপ্তানি বন্ধের এই সিদ্ধান্ত আমাদেরকে আবার পিছিয়ে দিবে।"
বাংলাদেশ রাইস এক্সপোর্টারস অ্যাসোসিয়েশন এর ফাউন্ডার প্রেসিডেন্ট, মো. ফরিদুল হাসান চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, "আমাদের উৎপাদন চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি, রপ্তানির কারণে কৃষকও ভালো দাম পায়। সুতরাং এটা বন্ধ করার সিদ্ধান্তটা খুব একটা যৌক্তিক বলে মনে হচ্ছে না।"
এক কেজি অ্যারোমেটিক রাইস রপ্তানি করে যে মূল্য পাওয়া যায়, তা দিয়ে তিন কেজি সাধারণ চাল আমদানি করা সম্ভব বলে জানান তিনি।
"ইউরোপের মার্কেটে পাকিস্তান যেখানে একচেটিয়া ব্যবসা করছে সেখান বাংলাদেশ একটা জায়গা তৈরি করছিল। কিন্তু দীর্ঘ সময় এটা বন্ধ থাকলে তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ ক্রেতারা বিকল্প বাজার খুঁজে বের করে সেখান থেকেই আমদানি শুরু করবে। একবার ক্রেতা হাতছাড়া হলে তাদের ফেরত আনা খুবই কঠিন," জানান তিনি।
প্রাণ আরএফএল গ্রুপের পরিচালক মো. কামরুজ্জামান কামাল টিবিএসকে বলেন, "আমাদের একটা নির্দিষ্ট ক্রেতা আছে, বাজার আছে। হঠাৎ করে রপ্তানি বন্ধ করলে এই বাজারটা আমরা হারাবো।"
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সরকার চলতি আমন মৌসুমে ধান-চাল সংগ্রহের যে লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করেছে, তাও পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এ মৌসুমে সরকার ৩ লাখ টন ধান ও ৫ লাখ টন চাল সংগ্রহের লক্ষমাত্রার বিপরীতে মাত্র ৬৩ হাজার ৮০০ টন ধান এবং ৫ লাখ ৮৪ হাজার টন চাল সংগ্রহ করা হয়।
অন্যদিকে বোরো মৌসুমে ধান-চাল মিলে প্রায় ১৭ লাখ টন সংগ্রহে নেওয়া হয়েছে। তবে চালের দাম চড়া থাকার কারণে সরকার চলতি বোরো মৌসুমেও ধান-চালের সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
সম্প্রতি খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার খাদ্য মন্ত্রণালয়ের এক সভায় সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ার শঙ্কার কথা তুলে ধরেন। এরপরই সরকার প্রাথমিকভাবে ১০ লাখ টন চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। চাল আমদানির শুল্কও কমিয়েছে সরকার।
পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে সরকার চাল আমদানির অনুমতি প্রদানের প্রক্রিয়া শুরু করেছে।