চীনের নেতৃত্বাধীন বাণিজ্য জোটে সম্ভাবনা থাকলেও, পাশাপাশি কিছু সতর্কতারও দরকার
আড়াইশ কোটি জনসংখ্যার ভোক্তা বাজারে বাধামুক্ত প্রবেশের সুবিধা একবার কল্পনা করুন, যার আকার প্রায় ১২ লাখ ৭০ হাজার কোটি ডলার। চীনের নেতৃত্বাধীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক জোট রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ (আরসিইপি বা আরসেপ) এমন সম্ভাবনাই দেখাচ্ছে।
এত সম্ভাবনা শুনতে অবিশ্বাস্য যদি ঠেকে, তাহলে জেনে রাখুন আপাতত সেই দ্বিধার ভিত্তি আছে।
এক সমীক্ষা প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ট্রেড এন্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি) বাংলাদেশের এ বাণিজ্য জোটে যোগদানের সুপারিশ করেছে। তবে এক্ষেত্রে যেসব দিকে আলোকপাত করা হয়েছে তা এক ধরনের সতর্কবার্তা হিসেবেই উঠে এসেছে।
বিটিটিসি বলেছে, "সরকার সমস্ত সমস্যা, উদ্বেগ বিবেচনা করে এবং ইস্যুভিত্তিক স্টেকহোল্ডারদের পরামর্শকে বিবেচনায় রেখে এবং পরিস্থিতি দেখা দিলে কিছু ক্ষেত্রে দেশীয় নিয়ম ও প্রবিধান পরিবর্তনের প্রয়োজন হতে পারে তা স্বীকার করে আরসেপ- এ বাংলাদেশের যোগদানের বিষয়ে ইতিবাচক অবস্থান নিতে পারে।"
দেশীয় বিধিমালা পরিবর্তনের বিষয়টিসহ আরও কিছু বিষয় বিশ্লেষণের দাবি রাখে নিঃসন্দেহে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হলো- আরসেপ- এ যোগ দিয়ে অর্জিত প্রবৃদ্ধির সিংহভাগ হবে পোশাকখাতে, কিন্তু মুক্ত বাণিজ্যের প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে অন্যান্য খাত।
প্রভাবশালী মার্কিন দৈনিক ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল আরসেপ'কে কাগুজে বাঘ বললেও, প্রকৃতপক্ষে এই অংশীদারিত্ব তার চেয়ে অনেক বড় কিছু। শুধুমাত্র আরসেপে যোগ দিলেই বাংলাদেশের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি বাড়বে ১৭.৩৭ শতাংশ বা ৫ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। বিটিটিসির সমীক্ষায় এসব তথ্যই তুলে ধরা হয়েছে।
এর আগে ২০২০ সালের ১৫ নভেম্বর চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডসহ অ্যাসোসিয়েশন অফ সাউথইস্ট এশিয়ান নেশনস (আসিয়ান) এর ১০ সদস্য: ব্রুনাই, ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, মায়ানমার, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া এবং ফিলিপাইন– এই ১৫টি দেশ বিশ্বের বৃহত্তম মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিটি স্বাক্ষর করে। চুক্তির আওতায় রয়েছে ২২০ কোটি জনসংখ্যা এবং ২৬ লাখ ২০ হাজার কোটি ডলারের সম্মিলিত জিডিপির অর্থনীতি।
বাংলাদেশ যোগ দিলে এ বাজারে যেমন শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পাবে, তেমনি আরসেপ-ভুক্ত অন্যদেশগুলিও বাংলাদেশের বাজারে একই সুবিধা পাবে। একারণে আরসেপ- এ যোগদানের ফলে বাংলাদেশের বৈশ্বিক আমদানি বাড়বে ১৪.৪৬ শতাংশ।
আমদানি ব্যবস্থায় উদারীকরণের ফলে স্থানীয় অনেক শিল্পই প্রভাবিত হবে। কারণ তারা এখনকার মতো নীতিমালার সুরক্ষা পাবে না।
ফলে দেশের টেক্সটাইল, চামড়াজাত পণ্য, পরিবহন সরঞ্জাম, ধাতব পণ্য, কাগজ, লাইট, রাসায়নিক, উৎপাদন,ওষুধ এবং প্রস্তুতকারক খাতের পণ্যের জায়গা অনেকাংশে দখল করে নিতে পারে আমদানি পণ্য।
তাই আরসেপ- এ যোগ দিতে হলে বাধ্য হয়েই বাংলাদেশকে তার রপ্তানি পণ্যের ঝুড়িতে বৈচিত্র্য আনতে হবে। যদিও দীর্ঘদিন ধরেই এমনটি করার আহ্বান জানিয়ে আসছেন অর্থনীতিবিদেরা।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানীয় ফেলো ড. মুস্তাফিজুর রহমান স্বীকার করেন যে, এক পর্যায়ে বাংলাদেশকে অবশ্যই আরসেপ- এ যোগ দিতে হবে। এজন্য নিজস্ব স্বার্থের কথা মাথায় রেখে তার প্রস্তুতি নেওয়াও অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করেন তিনি।
"আমাদের আরসেপ বিধিমালায় উল্লেখিত মানদণ্ডগুলি অর্জন করতে হবে। আমরা যদি বেসরকারি খাতের উৎপাদনশীলতার দক্ষতা বাড়াতে না পারি, তাহলে সেই অবস্থায় এ জোটে যোগ দিলে পোশাক ছাড়া অন্যান্য খাত নেতিবাচক প্রভাবের শিকার হবে।"
তিনি আরও বলেন, " আমাদের প্রস্তুতি থাকতে হবে। সেক্ষেত্রে যেসব খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে তাদের আগেভাগে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নিতে হবে। একইসঙ্গে ব্যবসা পরিচালনা সহজ করে কমাতে হবে ব্যবসার খরচও। ব্যবসার জন্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থাও রাখতে হবে।"
"পরিবহন যোগাযোগ ও সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) মাধ্যমে বাংলাদেশকে সংযুক্ত হতে হবে। সস্তা শ্রম ও শুল্কমুক্ত রপ্তানির সুবিধা নিতে আরসেপ সদস্য দেশগুলি বাংলাদেশ বিনিয়োগ করবে। এসব দেশ যেসব পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশকে সেসব পণ্য রপ্তানি করতে হবে, এখানে এফডিআই একটি বড় ইস্যু।"
এক্ষেত্রে বিটিটিসি সমীক্ষায় দেখেছে যে, আরসেপভুক্ত দেশ থেকে বাংলাদেশে এফডিআই প্রবাহ কমেছে, একইসময় এসব দেশমুখী এফডিআই প্রবাহ বেড়েছে।
করার আছে অনেক কিছুই
বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশে উত্তরণের প্রস্তুতি নিচ্ছে, এসময়ে আরসেপ- এ যোগদানের সুপারিশ করেছে বিটিটিসি। কারণ মধ্য আয়ের দেশে উত্তরণের পর বিশ্ববাণিজ্যের অনেক অগ্রাধিকার সুবিধা হারাবে বাংলাদেশ।
১৫ সদস্যের আরসেপ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ বর্তমানে শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা পাচ্ছে অস্ট্রেলিয়া, জাপান, নিউজিল্যান্ড, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া ও থাইল্যান্ডে। ২০২৬ সালে এলডিসি গ্রাজুয়েশনের পর এই সুবিধা হারাতে হবে।
কিন্তু, আরসেপ- এ যোগ দিলে এসব বাজারে রপ্তানি সুবিধা অব্যাহত থাকবে। এ ছাড়া জনশক্তি রপ্তানি এবং রেমিট্যান্স বৃদ্ধির দিক দিয়েও লাভবান হওয়া যাবে।
আরসেপ নিয়ে আলোচনায় মূল প্রাধান্য পেয়েছে তৈরি পোশাক শিল্পের (আরএমজি) জন্য এর অগ্রণী সুবিধার দিকটি, কারণ আরসেপভুক্ত দেশে রপ্তানি করা শীর্ষ ২০টি আইটেমই আরএমজি খাতের পণ্য, যা মোট রপ্তানির প্রায় ৬৪ শতাংশ।
আরসেপ- এ যোগ দিলে জিডিপি প্রবৃদ্ধিও বাড়বে, তবে তা খুবই সামান্য বা ০.২৩ শতাংশ হবে।
বিটিটিসির প্রতিবেদন বলছে, এই প্রবৃদ্ধি বড় চালিকাশক্তিই হবে পোশাক খাত, অপরদিকে অন্যান্য শিল্পের ওপর নেতিবাচক প্রভাবের মাধ্যমে তার জন্য মূল্য দিতে হবে।
আরএমজি খাত ৫.০৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি বাড়তে পারে। টেক্সটাইল, চামড়াজাত পণ্য, মাংস এবং পশুসম্পদ, পানীয় এবং তামাক এর মতো কয়েকটি অন্যান্য খাতের রপ্তানিও কিছু ইতিবাচক প্রভাব যুক্ত করবে। তবে বেশিরভাগ খাতের ক্ষেত্রে তা ইতিবাচক হবে না।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'শিল্পের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বলা যায়- শুধুমাত্র পোশাক খাত লাভের সম্ভাবনা আছে। পোশাক ছাড়া শিল্প উৎপাদন সামগ্রিকভাবে হ্রাস পাবে 0.৪৬ শতাংশ।'
বোস্টন-ভিত্তিক একটি সংস্থার বিশ্লেষক আসিফ মুজতবা হাসান বলেন, রপ্তানি ঝুড়িতে বৈচিত্র্য আনা গেলেই লাভবান হওয়া যাবে।
"এই চুক্তি আমাদের বৈচিত্র্যকরণে উৎসাহিত করবে। আমাদের জন্য দ্বিতীয় প্রধান কোন খাতে মনোনিবেশ করতে হবে তা বুঝতে সাহায্য করবে। যেমন আরসেপ- এ যোগদানের পর যদি দেশের নীতিনির্ধারকেরা মাইক্রোচিপের ঘাটতি দেখতে পান, তাহলে সেদিকে স্থানীয় উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে পারবেন।"
নীতি সংস্কার এখন গুরুত্বপূর্ণ
বাংলাদেশের আরসেপ-এ যোগদানের পর রপ্তানি যতটুকু বাড়বে তা আমদানি বৃদ্ধির প্রভাবকে হ্রাস করবে না। দুটিই বাড়বে, কিন্তু আমদানি বাড়ার কারণে বেশিরভাগ স্থানীয় শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এতে বাংলাদেশের বিশ্ববাণিজ্যের ঘাটতি বাড়বে ২.৬৯ শতাংশ।
আমদানির দিক থেকেও আরসেপভুক্ত দেশগুলির ওপর বেশি নির্ভরশীল বাংলাদেশ। মোট আমদানির ৪৫ শতাংশই আসে এ জোটভুক্ত অঞ্চল থেকে, সে তুলনায় মোট রপ্তানিতে অবদান মাত্র ১০ শতাংশ।
আরসেপ জোট ও বাংলাদেশের পারস্পরিক ১০০ শতাংশ শুল্ক কর্তনে উভয় পক্ষের আমদানি বাড়লেও বাংলাদেশের জন্য তার পরিমাণ বেশি হতে পারে। তার ফলে বাংলাদেশের রাজস্বে ক্ষতির পরিমাণও বেশি বা ২.৫ বিলিয়ন ডলার হবে, সে তুলনায় অন্য আরসেপ দেশগুলির ক্ষেত্রে হবে ৫৪১ মিলিয়ন ডলার।
বিটিটিসি পরিচালিত এ সম্ভাব্যতা অধ্যয়নে যুক্ত ছিলেন ড. মোস্তফা আবিদ খান। তিনি মনে করেন, এ জোটে যোগদানের আগে বাংলাদেশকে অবশ্যই কিছু নীতি সংস্কার বাস্তবায়ন করতে হবে।
"যেমন ধরুন, আমাদের খুচরা বাজার নিয়ে কোনো নীতিমালা নেই। তাই বাংলাদেশের খুচরা পণ্যের বাজারে কিছু মানসম্পন্ন পণ্য এনে যেকোনো দেশ প্রভাব বিস্তার করতে পারে"- ব্যাখ্যা করেন তিনি।
"কিছু সুবিধাও থাকবে… সেজন্য নীতি সংস্কারের মাধ্যমে আমাদের বেসরকারি খাতকে শক্তিশালী করতে হবে। এ জোটে যোগদানের পর এখন আমরা যে বাজার সুবিধার পরিবেশ পাচ্ছি, তা আর থাকবে না।"
বাংলাদেশের উদ্বেগের জায়গাগুলি আরসেপ নিয়ে দর কষাকষির আলোচনায় জায়গা দিতে হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
এখান থেকে বড় প্রত্যাশা, শুল্কমুক্ত সুবিধার ফলে আমদানিকৃত কাঁচামালের দাম কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের কিছু খাত বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় আরও বেশি সক্ষম হয়ে উঠবে। এতগুলি দেশের মধ্যে পারস্পরিক সহায়তার সম্পর্ক এবং তার সাথে দক্ষতা ও প্রযুক্তি বিনিময়ের সম্ভাবনাও নতুন বাণিজ্যের সুযোগ সৃষ্টি করবে।
তবে বাণিজ্য ঘাটতি ছাড়াও, শুল্কমুক্ত সুবিধার কারণেও রাজস্ব আহরণ কম হবে।
বাংলাদেশের মোট বৈশ্বিক আমদানির প্রায় ৪৩.৯২ শতাংশ এবং মোট কর রাজস্বের ৫৫.৩৩ শতাংশ আরসেপভুক্ত দেশগুলি থেকে হয়। ২০২০-২১ অর্থবছরের মোট শুল্ক রাজস্বের ৫৮.৫৬ শতাংশ আদায় হয়েছে আরসেপভুক্ত দেশের আমদানি পণ্য থেকে।
আরসেপ-এর ১৫টি দেশের মধ্যে, চীন বাংলাদেশের আমদানি এবং রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে একক বৃহত্তম অবদান রাখে, সমস্ত আরসেপ- এর তুলনায় যা যথাক্রমে প্রায় ৪৫ ও ৪৪ শতাংশ।
সরকারি রাজস্বের এত বড় অংশ হারানোর জন্যও পরিকল্পনা থাকা দরকার। যদি রাজস্ব হারিয়ে যায় এবং দেশীয় ব্যবসাগুলি প্রতিযোগিতামূলক না হয়–তাহলে এই জোড়া হুমকি অনেক ভালো দিককেও মন্দে পরিণত করবে।
আরসেপ- এ যোগদান ওই অঞ্চলে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানিকে সুরক্ষিত করতে পারে। বাংলাদেশের মোট রেমিট্যান্সের প্রায় ১১-১৩ শতাংশ আরসেপভুক্ত দেশগুলি থেকে আসে।
এ ছাড়া পোশাক খাতে দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমের চাহিদা প্রায় ১৮ শতাংশ বাড়বে, তবে অন্যান্য খাতে শ্রমিকের চাহিদা কমতে পারে।