কমেছে স্ক্র্যাপের দাম, অস্বাভাবিক দরপতনে স্থবির জাহাজভাঙ্গা শিল্প
ইস্পাত শিল্পের কাঁচামাল স্ক্র্যাপের দাম ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ার পরেও ভোক্তারা কম খরচে নির্মাণের সুযোগ হারাচ্ছেন।
কাঁচামালের দাম কমে যাওয়ায় ইস্পাত নির্মাতারাও দাম কমাতে পারতেন, কিন্তু চাহিদা কম থাকায় পণ্যটির উৎপাদন দুই-তৃতীয়াংশ কমিয়ে দিয়েছে তারা। ২০২০ সালের শেষ থেকে শুরু করে প্রায় ১৮ মাসে রি-রোলিং মিলগুলো প্রায় ৭০ শতাংশ মূল্য বৃদ্ধি দেখেছে।
ইস্পাতের কাঁচামাল স্ক্র্যাপের অস্বাভাবিক দরপতনে স্থবির হয়ে পড়েছে জাহাজভাঙ্গা শিল্প। গত তিন মাস ধরে টানা দরপতনে স্ক্র্যাপের দাম কমেছে টনে কমপক্ষে ২০ হাজার টাকা।
এদিকে স্ক্র্যাপের পাশাপাশি ইস্পাত পণ্য এমএস রডের দামও কমে গেছে। মাত্র তিন সপ্তাহেই বাজারে এমএস রডের দাম টনপ্রতি ২-৩ হাজার টাকা পর্যন্ত কমে গেছে। অতিরিক্ত দাম বৃদ্ধির কারণে চাহিদা কমে যাওয়ায় পণ্যটির দাম কমে গেছে বলে জানিয়েছেন রড উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ীরা।
এর আগে, ২০২০ সালের নভেম্বর থেকে প্রায় দেড় বছর টানা বেড়ে গত মার্চে এমএস রডের দাম ঠেকে টনপ্রতি ৯২ হাজার টাকায়। যা ২০২০ সালের অক্টোবরে সর্বোচ্চ ৫৫ হাজার টাকায় বিক্রি হতো।
ইস্পাত খাতের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ২০২০ সালের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত প্রায় দেড় বছর টানা উর্ধ্বমুখী ছিল রডের বাজার। এই সময় দফায় দফায় বেড়ে পণ্যটির দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। এভাবে দাম বৃদ্ধির ফলে নির্মাণ খরচ বেড়ে যাওয়ায় আবাসন ও অন্যান্য খাতের নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। এতে চাহিদা কমে যাওয়ায় পণ্যটির বিক্রি কমে গেছে। কমেছে পণ্যটির দামও।
চট্টগ্রামের কর্ণেল হাট এলাকার পাইকারি রড ব্যবসায়ী মেসার্স খাজা ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী ইব্রাহিম বিন মন্জুর বলেন, রডের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির কারণে লোকজন নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দিয়েছে।
তিনি আরো বলেন, "দেশের বিভিন্ন জেলায় বন্যার কারণেও গত দুই মাস ধরে রডের বেচাকেনা একদম কমে গেছে।"
রডের বাজারকে চাঙ্গা করতে হলে রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে পণ্যটির দাম আরো কমিয়ে দেওয়া উচিত বলে মনে করছেন এই ব্যবসায়ী।
এইচ এম স্টিলের পরিচালক সরওয়ার আলম বলেন, "আন্তর্জাতিক ও দেশীয় বাজারে স্ক্র্যাপের দাম কমে আসায় আগের চেয়ে রডের দাম টনে প্রায় ৭-৮ হাজার টাকা কমে আসে। এরপরও বাজারে রডের চাহিদা খুবই কম। চাহিদা কমে যাওয়ায় বেশিরভাগ রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে।"
উৎপাদন ক্ষমতার তুলনায় কারখানাগুলো মাত্র ৩০-৩৫ শতাংশ রড উৎপাদন করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, "আগে একটি কারখানায় তিন শিফটে কাজ চললেও এখন চলছে এক শিফটে।"
বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএসএমএ) এর তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে প্রতিবছর ৭০-৭৫ লাখ টন এমএস রডের চাহিদা রয়েছে। দেশের প্রায় ৫৫টি অটো স্টিল রি-রোলিং মিলস ও শতাধিক সেমি অটো ও ম্যানুয়াল মিলস এসব রডের যোগান দিয়ে থাকে।
ভুক্তভোগী জাহাজভাঙ্গা শিল্প
পুরোনো জাহাজের আমদানি মূল্যের চেয়ে স্ক্র্যপের দাম কমে যাওয়ায় কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে ৫০টিরও বেশি শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড। কাজ না থাকায় বেকার হয়ে পড়েছে কমপক্ষে ৭ হাজার শ্রমিক।
শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড মালিকরা জানিয়েছেন, অতিরিক্ত দাম বৃদ্ধির কারণে ইস্পাত পণ্য এমএস রডের চাহিদা ও উৎপাদন কমে কমে গেছে। বর্ষাকাল ও দেশের বিভিন্ন জেলায় বন্যার কারণেও ইস্পাতের চাহিদা কমেছে।
এতে কারখানা পর্যায়ে রডের উৎপাদন কমে যাওয়ায় রড তৈরির কাঁচামাল স্ক্র্যাপের চাহিদা কমে গেছে। ফলে গত তিন মাস ধরে জাহাজ ভাঙ্গার প্রধান উপকরণ স্ক্র্যাপ পণ্যের দাম অস্বাভাবিক কমে গেছে।
কে আর শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডের স্বত্বাধিকারী সেকান্দার হোসেন বলেন, "মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে কমতে শুরু করে স্ক্র্যাপের বাজার। প্রতি মাসে ৭-৮ হাজার টাকা করে কমে গত তিন মাসে কমপক্ষে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত কমেছে পণ্যটির দাম। অস্বাভাবিক দাম কমে যাওয়ার কারণে অনেকগুলো শিপ ইয়ার্ড জাহাজ কাটা বন্ধ রেখেছে। এতে বেকার হয়ে পড়েছে হাজার হাজার শ্রমিক।"
শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে ইয়ার্ডে প্রতিটন স্ক্র্যাপ বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৪৮ হাজার টাকায়। মার্চের শেষ দিকে এই স্ক্র্যাপের দাম ছিল ৬৭-৬৮ হাজার টাকা। সেই হিসেবে, গেল তিন মাসে প্রতিটন স্ক্র্যাপের দাম কমেছে কমপক্ষে ২০ হাজার টাকা।
স্ক্র্যাপের পাশাপাশি কমে এসেছে ইস্পাতের কাঁচামাল প্লেট ও বিলেটের দামও। বর্তমানে বাজারে প্রতিটন প্লেট ৬৫ হাজার টাকা ও বিলেট ৬৬ টাকায় বিক্রি হয়েছে। তিন মাস আগে বাজারে প্রতিটন প্লেট ৭১ হাজার টাকা ও বিলেট ৮০ হাজার টাকায় বিক্রি হতো। সেই হিসেবে, তিন মাসের ব্যবধানে বাজারে প্রতিটন প্লেটে ৬ হাজার টাকা ও বিলেটে ১৪ হাজার টাকা পর্যন্ত দাম কমে গেছে।
এদিকে গত তিন-চার মাসের ব্যবধানে আন্তর্জাতিক বাজারে স্ক্র্যাপ জাহাজের দাম টনে ১৫০ ডলারের বেশি কমেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে বর্তমানে প্রতিটন স্ক্র্যাপ বিক্রি হচ্ছে ৫০০ ডলারে। গেল ফেব্রুয়ারি-মার্চে আন্তর্জাতিক বাজারে স্ক্র্যাপে দাম ছিল ৬৫০-৬৮০ ডলারের মধ্যে।
বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স এন্ড রিসাইক্লার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি আবু তাহের বলেন, "আন্তর্জাতিক বাজারে গত তিন-চার মাস ধরে স্ক্র্যাপ ও পুরানো জাহাজের দাম কিছুটা কমেছে। তবে একই সময়ে ডলারের দাম বৃদ্ধি পাওয়াতে আমদানিকৃত জাহাজের বিপরীতে বেশি টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে।"
"এদিকে স্ক্র্যাপের চাহিদা ও দাম কমে যাওয়ায় জাহাজ আমদানিও কমে দিয়েছে ইয়ার্ড মালিকরা। বেশিরভাগ শিপ ইয়ার্ডে এখন কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। কাজ না থাকায় এসব ইয়ার্ডের শ্রমিকরাও এখন বেকার," যোগ করেন তিনি।
আবু তাহের আরো বলেন, স্বাভাবিক সময়ে শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডগুলোতে ১৫-১৬ লাখ মেট্রিক টন স্ক্র্যাপ মজুদ থাকে। কিন্তু বর্তমানে স্ক্র্যাপের মজুদ ২-৩ লাখ টনের নিচে চলে এসেছে।
বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স এন্ড রিসাইক্লার্স এসোসিয়েশনের তথ্যমতে, বঙ্গোপসাগর পাড়ে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড এলাকায় ৮০টির বেশি শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে জাহাজ কাটার কাজ চলে। কিন্তু গত তিন মাস ধরে স্ক্র্যাপের অস্বাভাবিক দরপতনে ৪০টিরও বেশি ইয়ার্ড জাহাজ কাটা বন্ধ রেখেছে। জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পে সরাসরি ২০ হাজার শ্রমিক জড়িত। এই সময়ে কমপক্ষে ৭ হাজার শ্রমিক চাকরি হারিয়েছে।
গেল অর্থবছর অর্থাৎ ২০২১-২২ সালে ইয়ার্ডগুলোতে ছোট-বড় মোট ২৩২টি জাহাজ আমদানি হয়েছে। স্ক্র্যাপ হিসেবে এসব জাহাজের ওজন ২৬ লাখ টন। এসব জাহাজ আমদানিতে খরচ হয়েছে ১৩ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা।
ইস্পাতের বাজার
ইস্পাত কারখানাগুলোতে খবর নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে বাজারে বিভিন্ন ব্রান্ডের মধ্যে ৭৫ গ্রেডের (৫০০ টিএমটি) এমএস রড ৮১-৮৪ হাজার টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। যা জুনের মাঝামাঝি সময়ে ৮৩-৮৭ হাজার টাকার মধ্যে বিক্রি হয়েছে।
৭৫ গ্রেডের রডের মধ্যে বর্তমানে বিএসআরএম ৮৪ হাজার টাকা, কেএসআরএম ৮৩ হাজার টাকা, একেএস ৮২ হাজার ৫০০ টাকা ও জিপিএইচ ৮১ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
তিন সপ্তাহ আগে বাজারে বিএসআরএম ৮৬ হাজার ৫০০ টাকা, কেএসআরএম ৮৬ হাজার টাকা, একেএস ৮৪ হাজার টাকা ও জিপিএইচ ৮৩ হাজার টাকা দামে বিক্রি হয়েছে।
বর্তমানে অটো মিলের ৬০ গ্রেডের এম এস রডের মধ্যে গোল্ডেন ইস্পাত ৮০ হাজার টাকা, এসএএসএম ৭৯ হাজার ৫০০ টাকা, বায়েজিদ ৭৯ হাজার টাকা, এইচএম স্টিল ৭৮ হাজার ৫০০ টাকা এবং কেআর ৭৮ হাজার দরে বিক্রি হচ্ছে।
তিন সপ্তাহ আগে গোল্ডেন ৮২ হাজার টাকা, এসএএসএম ৮১ হাজার টাকা, বায়েজিদ ৮২ হাজার টাকা, এইচএম স্টিল ৮৩ হাজার টাকা এবং কেআর ৮০ হাজার দরে বিক্রি হয়েছে।
গত তিন সপ্তাহে সেমি অটো মিলের ৬০ গ্রেডের রডের দামও ২ হাজার টাকা পর্যন্ত কমে গেছে। বর্তমানে বাজারে শীতলপুর স্টিলের সেমি অটো এম এস রড প্রতিটন ৭৬ হাজার টাকা, বিএম, আল ছাফা, রাইজিং, খলিল, বলাকা, আম্বিয়া, পেনিনসুলা ও মানতি স্টিলের রড ৭৫ হাজার টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে; যা তিন সপ্তাহ আগেও ৭৭-৭৮ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে।