ব্যবসায় পুনরুদ্ধার সত্ত্বেও ২০২১-২২ অর্থবছরে বড় করদাতাদের থেকে ভ্যাট আদায় কম হয়েছে
দেশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো মহামারির অভিঘাত অনেকটা কাটিয়ে উঠে স্বাভাবিক ব্যবসায় ফিরলেও বিগত ২০২১-২২ অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ভ্যাট (মূসক) আদায় কম হয়েছে ১২ হাজার কোটি টাকা।
এর পেছনে- শীর্ষ কিছু ভ্যাটদাতাকে ছাড় দেওয়া, ভ্যাট ফাঁকি এবং তা আরোপে অসম নীতিসহ আদায়ের সক্ষমতা ঘাটতির মতো নানান কারণকে দায়ী করছে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র। এসব মিলিয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে লার্জ ট্যাক্সপেয়ারর্স ইউনিট (বৃহৎ করদাতা ইউনিট- এলটিইউ) থেকে ভ্যাট আদায়ের প্রবৃদ্ধি হোঁচট খেয়েছে বলে মনে করছেন তারা।
মোট ভ্যাটের ৫০ শতাংশ আসে এলটিইউ হিসেবে নিবন্ধিত কোম্পানিগুলোর থেকে,কিন্তু তারা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রদানে ১২ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি করেছে। এনবিআর তাদের থেকে মোট ৬৪ হাজার কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছিল।
২০২১-২২ অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের রাজস্ব আদায়ে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ১৪ শতাংশের বেশি হলেও, বৃহৎ করদাতা ইউনিটভুক্ত ৩৪টি ভ্যাট প্রদানকারী খাত থেকে আদায় আগের অর্থবছরের থেকে হয়েছে মাত্র ৬ শতাংশের বেশি। এসব তথ্য জানা গেছে, এনবিআরের লার্জ ট্যাক্সপেয়ারর্স ইউনিট-ভ্যাট (এলটিইউ) অফিসের হিসাব অনুযায়ী।
১৩টি খাত থেকে ভ্যাট আদায় আগের অর্থবছরের তুলনায় ১-৯০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। আবার মোবাইল ফোন, ব্যাংক, প্রসাধনী খাতের কোম্পানির ভ্যাট আদায়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১ শতাংশেরও কম।
অন্যদিকে, সিমেন্ট, সাবান ও বীমার মতো ভ্যাট-প্রদানে শীর্ষ অবদান রাখা খাত থেকে আদায়ে হয়েছে ঋণত্মক প্রবৃদ্ধি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে, এলটিইউ-ভ্যাট বিভাগের একজন কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'বৃহৎ করদাতাদের থেকে প্রত্যাশার চেয়ে কম ভ্যাট আদায়ের কারণ আমরা পর্যালোচনা করছি'।
অন্যান্য কিছু খাতের ভ্যাট আদায় কম হওয়ার পেছনে যৌক্তিক কারণ থাকলেও, সিমেন্টসহ অন্যান্য খাতের ক্ষেত্রে তারা কোনো যুক্তি খুঁজে পাচ্ছেন না বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
তিনি বলেন, এখন আমরা কম ভ্যাট দাতাদের অডিটের তথ্য ও অন্যান্য কিছু নথি সংগ্রহ করে তা পর্যালোচনা করছি'।
২০২১-২২ অর্থবছরে এনবিআর এক লাখ কোটি টাকার বেশি ভ্যাট আদায় করেছে, যার মধ্যে বৃহৎ করদাতা ইউনিট থেকে এসেছে ৫২ হাজার ৪৩৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ-(বিএটি)সহ তিনটি তামাক কোম্পানির কাছ থেকে আদায় হয়েছে প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা, প্রবৃদ্ধি ৩ শতাংশের কিছু বেশি বলে জানাচ্ছে এলটিইউ-ভ্যাট অফিস।
তামাক শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন,তামাকজাত পণ্যের মূল্য নির্ধারণে ভারসাম্যপূর্ণ ভূমিকা না রাখাই এ খাত থেকে দুর্বল ভ্যাট আদায়ের পেছনে দায়ী।
বিএটি বাংলাদেশের হেড অব এক্সটার্নাল অ্যাফেয়ার্স শেখ শাবাব আহমেদ টিবিএসকে বলেন, সিগারেটের বাজার (কমদামের সিগারেট) লোয়ার সেগমেন্টের দখলে প্রায় ৭৫ শতাংশ, যার দাম গত তিন বছরে বাড়েনি। চলতি অর্থবছর তা মাত্র এক টাকা বাড়ানো হয়েছে। সেখানে দাম না বাড়ায় ভ্যাট প্রত্যাশিত হারে বাড়ছে না। চলতি বছরও একই অবস্থা হবে বলে মনে করেন তিনি।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. আবদুল মজিদ টিবিএসকে বলেন, বড় কোম্পানিগুলো হয়তো বিভিন্ন উপায়ে ভ্যাট এড়াতে করতে পারে, যা সক্ষমতার অভাবে এনবিআর ধরতে পারছে না।
যদিও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, গত অর্থবছরও অনেক ব্যবসা খাত মহামারিজনিত ক্ষতি থেকে প্রকৃত অর্থে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি, যার কারণে বড় কোম্পানিগুলো থেকে প্রত্যাশিত ভ্যাট আদায় হয়নি।
ব্যাংকিং খাতের ভ্যাট আদায় প্রত্যাশিত হারে না বাড়ার কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ব্যাংকিং খাতের অবস্থা ভালো নয়। মুনাফাও অনেক কমে গেছে।
২০২১-২২ অর্থবছর টেলিকম অপারেটরদের থেকে ভ্যাট আদায়ে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১ শতাংশেরও কম।
রবি আজিয়াটা লিমিটেডের চিফ কর্পোরেট অ্যান্ড রেগুলিটরি অফিসার শাহেদ আলম বলেন, বর্তমানে ইউনিক মোবাইল সংযোগ বিস্তার ৫৫ শতাংশে রয়েছে, বিগত কয়েক বছর ধরেই যা স্থির অবস্থানে। প্রান্তিক মানুষের স্মার্টফোন কেনার নিম্ন সক্ষমতা এর পেছনে বড় ভূমিকা রাখছে, যা এখনও ৫০ শতাংশের নিচে।
এ ছাড়া গত তিন বছর ধরে এ শিল্পে সংযোগ প্রতি গড় রাজস্ব একটা সমতল অবস্থানে রয়েছে। শিল্পটি থেকে সরকারের ভ্যাট ও ট্যাক্স আদায়ের চিত্রে তার স্পষ্ট প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে।
তবে তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের সহায়ক পরিবর্তনের সাহায্যে, নতুন প্রযুক্তি সংযোজনের মাধ্যমে এবং সংযোগহীন জনগোষ্ঠীকে মুঠোফোন নেটওয়ার্কে যুক্ত করার মাধ্যমে এ খাত থেকে নিকট ভবিষ্যতে রাজস্ব আদায়ে একটি ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখা যেতে পারে।
দেশে ভোজ্যতেলের দুটি বৃহৎ কোম্পানি– টিকে গ্রুপের শবনম ভেজিটেবল অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড এবং বাংলাদেশ এডিবল অয়েল লিমিটেড থেকে ভ্যাট আদায় নাটকীয় হারে বা ৯০ শতাংশ কম হয়েছে। ভোজ্যতেলের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়া ঠেকাতে সরকার উৎপাদন ও সরবরাহ পর্যায়ে ভ্যাট প্রত্যাহার করা যার প্রধান কারণ।
অন্যদিকে, বৃহৎ ৯টি সিমেন্ট খাতের কোম্পানি কোম্পানির কাছ থেকে সম্মিলিতিভাবে ভ্যাট আদায় হয়েছে ৩৮৬ কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ৮ শতাংশ কম।
বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রথম সহ-সভাপতি মো. শহীদুল্লাহ বলেন বলেন, সিমেন্টের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিক্রি ব্যাপকভাবে কমেছে। এ জন্য গত অর্থবছরে এ খাত থেকে ভ্যাট আদায়েও ঘাটতি দেখা গেছে।