নষ্ট ১ হাজারের বেশি মেশিন, চট্টগ্রামে মুখ থুবড়ে পড়েছে ইএফডির ভ্যাট আদায় কার্যক্রম
ভ্যাট সংগ্রহ বাড়াতে ২০২০ সাল থেকে চট্টগ্রামে ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) মেশিন বসায় চট্টগ্রাম কাস্টম এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট। তবে যে প্রত্যাশা নিয়ে মেশিনগুলো বসানো হয়েছিল, তা অর্জন হয়নি খুব একটা। মেশিনগুলোর মধ্যে প্রায় এক-চতুর্থাংশই নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ভ্যাট সংগ্রহে বিপাকে পড়েছে দেশের প্রধান বন্দরনগরী।
ইএফডি হলো, এক ধরনের ইলেকট্রনিক সিস্টেম— যা প্রাথমিকভাবে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে বিক্রির রিয়েল-টাইম লেনদেন লিপিবদ্ধ, নিরীক্ষণ এবং সংরক্ষণ করতে ব্যবহৃত হয়।
চট্টগ্রামের ভ্যাট কর্মকর্তারা জানান— ৪,৮৬৭টি ইএফডির মধ্যে ১,১৭৭টি বা ২৪ শতাংশই নষ্ট হয়ে গেছে। এছাড়া, যেসব মেশিন ভালো রয়েছে, সেগুলোও রক্ষণাবেক্ষণ না হওয়ায় ব্যবহার করা বন্ধ করে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এর ফলে ক্রমাগত কমছে চট্টগ্রামে ইএফডি খাতে ভ্যাট আদায়।
ভ্যাট কমিশনারেটের তথ্য অনুযায়ী, যেসব ইফডি মেশিন সচল আছে সেগুলোতেও রয়েছে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা। যেমন— চার্জার ও নেটওয়ার্ক সংক্রান্ত জটিলতা, ব্যাটারি চার্জ না হওয়া, রেস্ট্রিকটেড টিকিট সাবমিশন, চালান কাটা যায় না, ব্যাটারির চার্জ বেশি সময় থাকে না, মেশিনের চার্জার পাওয়া যায় না, চালান কাটার সময় মেশিন বন্ধ হয়ে যায়, মেশিনের বাটন ঠিকমতো কাজ করে না ইত্যাদি।
চট্টগ্রাম কাস্টম এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট এর অ্যাডিশনাল কমিশনার তাফসির উদ্দিন ভূঁইয়া টিবিএসকে জানান, এসজেডজেড-কেএমএমটি–সিনোসিস-ইএটিএল জেভি (SZZT-KMMT-Synesis-EATL JV)- এর যৌথ উদ্যোগে (জয়েন্ট ভেঞ্চার) ইএফডির প্রথম ব্যাচের মেশিনগুলো দেশে আসে।
তিনি আরও আরো বলেন, "সিনোসিস ১,৮১৭টি ইএফডি বসায়। এরমধ্যে ৮২৭টি মেশিন নষ্ট হয়ে গেছে। এগুলো ১ বছর ধরে নষ্ট। শুল্কমুক্ত সুবিধায় চীন থেকে আমদানি করা প্রতিটি মেশিনের দাম পড়েছিল ২২,০০০ টাকা।"
নষ্ট হওয়া মেশিনগুলো ঠিক করতে জয়েন্ট ভেঞ্চারকে ভ্যাট অফিস থেকে ৪ বার চিঠি দেওয়া হলেও, তারা সাড়া দেয়নি। খুব শিগগিরই এ ব্যাপারে রাজস্ব কর্তৃপক্ষ উদ্যাগ নেবে বলে জানান তাফসির উদ্দিন ভূঁইয়া।
তবে কেএমএমটি (কুন মিং মুভো টেকনোলজি) এর প্রজেক্ট ম্যানেজার ওমর খৈয়ামকে প্রশ্ন করা হলে পাওয়া যায় ভিন্ন উত্তর।
টিবিএসকে তিনি বলেন, "আমরা ইনস্টল করা নষ্ট ইএফডি মেশিনগুলো মেরামত করছি। ব্যবসায়ীরা দ্রুত সহায়তার জন্য আমাদের ঢাকার কল সেন্টারে আসতে পারেন; এছাড়া আমরা চট্টগ্রামেও সেবা দিচ্ছি। আমরা ধীরে ধীরে মেশিনগুলো ঠিক করছি।"
এ বিষয়ে সিনোসিস আইটি লিমিটেডের চিফ সলিউশন অফিসার আমিনুল বারি শুভ্র বলেন, "আমাদের দায়িত্ব মেশিনের সফটওয়্যারের ত্রুটি সারাই করা; হার্ডওয়্যারের ত্রুটি মেরামত আমাদের দায়িত্ব নয়।"
"এছাড়া, ইফডির ফেইস-১ প্রকল্পে আমরা এনবিআরকে ইএফডি মেশিন সরবরাহ করি। এখন অন্য প্রতিষ্ঠান সরবরাহ করছে," বলেন তিনি।
তাফসির উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, জেনেক্স ইনফোসিস লিমিটেডকে দ্বিতীয় পর্যায়ে ইএফডি মেশিন আমদানি, ইনস্টল ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। বিনিময়ে, প্রতি ১০০ টাকা ভ্যাট আদায়ের বিপরীতে ০.৫৩ টাকা কমিশন পায় জেনেক্স।
কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানের বসানো ইএফডি মেশিনগুলোর মান আগের কোম্পানির চেয়ে কম হওয়ায় এগুলো দ্রুত নষ্ট হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, "এ পর্যন্ত জেনেক্স ৩,০৫০টি ইএফডি ইনস্টল করেছে— যার মধ্যে ৩৫০টি ইতোমধ্যেই নষ্ট হয়ে গেছে।"
ইএফডি-তে ভ্যাট হ্রাস
চট্টগ্রাম ভ্যাট কমিশনারেটের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামে ইএফডি থেকে ভ্যাট আদায় কার্যক্রম শুরু হয় ২০২০ সালের আগস্ট মাসে; এ সময় ১১৯২টি ইনভয়েসের বিপরীতে ভ্যাট আদায় হয় ১৪ কোটি টাকা। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ইএফডি থেকে ভ্যাট রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৩৩ কোটি টাকায়।
তবে পরবর্তীতে ডিভাইসগুলো নষ্ট হতে থাকায় কমতে শুরু করে ভ্যাট সংগ্রহ।
২০২৩ সালের জানুয়ারিতে ইএফডি থেকে রাজস্ব আয় হয় ৫.৪২ কোটি টাকা। এরপর প্রতিমাসে রাজস্ব আয় কমতেই থাকে।
২০২৪ সালের জুলাইতে ইএফডি খাতে ভ্যাট রাজস্ব আদায় ১.৪৪ কোটি টাকায় এসে ঠেকে।
সবশেষ ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ইএফডি থেকে রাজস্ব আদায় হয়েছে মাত্র ১.৭৫ কোটি টাকা।
আবাসিক হোটেল, রেস্তোরাঁ, ফাস্ট ফুড, মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, বিউটি পার্লার, তৈরি পোশাকের দোকান, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, জুয়েলার্স, জিমসহ বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে বসানো হয়েছে এসব ইএফডি মেশিন।
যেসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক লেনদেন ৫০ লাখ টাকার বেশি, সেসব প্রতিষ্ঠানে মেশিনগুলো বসানো হয়েছে।
চট্টগ্রাম কাস্টম এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট এর অ্যাডিশনাল কমিশনার তাফসির উদ্দিন ভূঁইয়া জানান, "ইএফডির মাধ্যমে ভ্যাট আদায় বাড়াতে আমরা ব্যবসায়ী সংগঠনের সাথে একাধিক বৈঠক করেছি। তাদের পক্ষ থেকে উদ্যোগের আশ্বাস দেওয়া হলেও, সাড়া মেলেনি তেমন।"
অন্যায্যভাবে ইএফডি বসানো হয়েছে: দাবি ব্যবসায়ীদের
এদিকে ব্যবসায়ীরা বলছেন, ইএফডি মেশিন দিয়ে যেন দায়িত্ব শেষ করেছে ভ্যাট বিভাগ। এ সংক্রান্ত পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়নি। হয়নি তেমন প্রচারণাও। ফলে ইএফডির প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন ব্যবসায়ীরা।
ইএফডি মেশিন দেওয়া হয়েছে এমন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মালিকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, কারিগরি ত্রুটির কারণে মেশিন নষ্ট হয়ে গেলেও তা ঠিক করতে ভ্যাট বিভাগের কর্মকর্তাদের সাড়া পাওয়া যায় না। মেশিনে নেটওয়ার্ক সমস্যার কারণে সময়ক্ষেপণ হয়।
তারা বলছেন, 'ইএফডিতে একটি ইনভয়েস দিতে গেলে ৩ থেকে ৫ মিনিট সময় লাগে। গ্রাহকরা এই সময় দিতে চান না। অনেকে ভ্যাট পরিশোধ করেও ইনভয়েস নেন না।'
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি চট্টগ্রাম জেলা শাখা শাখার সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ খুরশীদ আলম বলেন, "এই এফডিতে ভ্যাট আদায় করতে শুধুমাত্র শপিং মলের দোকানদারদের বাধ্য করা হচ্ছে। ভ্যাট আদায়যোগ্য সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বসানো না হলে এর সুফল পাওয়া যাবে না।"