আমদানি কমে স্ক্র্যাপের দাম বেড়েছে টনে ১৫ হাজার টাকা
ডলার সংকটের কারণে পণ্য আমদানিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেয়া এলসি মার্জিনের ক্ষেত্রে কঠোর হয়েছে বাণিজিক ব্যাংকগুলো। এতে অন্যান্য পণ্যের মতো গত তিন মাসে ইস্পাতের কাঁচামাল স্ক্র্যাপের আমদানিও উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে স্ক্র্যাপের বড় দরপতন হলেও দেশীয় বাজারে উল্টো বেড়ে গেছে পণ্যটির দাম। সেই প্রভাবে বেড়েছে এমএস রডের দামও।
আন্তর্জাতিক দেশীয় বাজার বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত পাঁচ মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে স্ক্র্যাপের দাম টনে প্রায় ৩১ হাজার টাকা পর্যন্ত কমেছে। অথচ দেশীয় বাজারে গত তিন সপ্তাহেই পণ্যটির দাম বেড়েছে টনে প্রায় ১৫ হাজার টাকা।
শিপ ব্রেকিং খাতের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে মার্চ থেকে এপ্রিল পর্যন্ত স্ক্র্যাপ জাহাজের বুকিং দর বেশি থাকায় আমদানি কিছুটা কম হয়েছে। মে'র শুরু থেকে বিশ্ববাজারে পণ্যটির দাম উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাওয়ায় এই সময়ে আমদানি বৃদ্ধি পাওয়ার কথা। কিন্তু তা না হয়ে উল্টো এই সময়েও পণ্যটির আমদানি কমে গেছে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমে গেলেও ডলার সংকটের কারণে কম দামের পণ্য আমদানি করতে না পারায় পণ্যটির বাজার আবারো উধর্বমুখী হয়েছে।
ইনভেস্টিং ডট কমের তথ্যমতে, আন্তর্জাতিক বাজারে মঙ্গলবার প্রতি টন স্ক্র্যাপ বিক্রি হয়েছে ৩৮৬ দশমিক ৮৫ ডলারে। গত ৭ মার্চ স্ক্র্যাপের বুকিং দর উঠেছিল ৭০০ ডলারে। সেই হিসেবে, গত পাঁচ মাসে পণ্যটির দাম কমেছে টনে ৩১৪ ডলার বা ৩১ হাজার টাকা।
শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে ইয়ার্ডে প্রতি টন স্ক্র্যাপ বিক্রি হচ্ছে ৬০ হাজার টাকা দামে। অথচ কোরবানির ঈদের আগে স্ক্র্যাপের দাম নেমে এসেছিল মাত্র ৪৫ হাজার টাকায়। সেই হিসেবে, গত তিন সপ্তাহেই পণ্যটির দাম টনে ১৫ হাজার টাকা বেড়েছে।
স্ক্র্যাপের পাশাপাশি বেড়েছে ইস্পাতের কাঁচামাল প্লেট ও বিলেটের দামও। বর্তমানে বাজারে প্রতি টন প্লেট ৭৩ হাজার টাকা ও বিলেট ৭৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। কোরবানি ঈদের আগে বাজারে প্রতি টন প্লেট ৬০ হাজার টাকা ও বিলেট ৬২ হাজার টাকায় বিক্রি হতো। সেই হিসেবে, তিন সপ্তাহের ব্যবধানে বাজারে প্রতি টন প্লেট ও বিলেটে ১৩ হাজার টাকা পর্যন্ত দাম বেড়ে গেছে।
কে আর শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডের স্বত্বাধিকারী সেকান্দার হোসেন বলেন, বিশ্ববাজারে মাসে মাসে স্ক্র্যাপের দাম কমে আসছে। এখন আমদানি বাড়াতে পারলে স্ক্র্যাপ এবং রড দুটোর দামই কমে আসতো বাজারে। কিন্তু ডলার সংকটের কারণে পণ্য আমদানি কমিয়ে দিতে হয়েছে দেশের আমদানিকারকদের। যার দীর্ঘ প্রভাব পড়বে রডের বাজার তথা নির্মাণ খাতে।
স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও খাতুনগঞ্জ শাখার হেড অব ব্রাঞ্চ সাব্বির আহমদ চৌধুরী বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া বাকি যেকোন পণ্য (বিলাস পণ্য) আমদানিতে শতভাগ মার্জিন নিয়ে ঋণপত্র খুলছে ব্যাংকগুলো। ডলার সংকটের কারণে এসব পণ্য আমদানিতে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে আমদানিকারকদের। এমনকি ৩০ লাখ ডলারের বেশি মূল্যের এলসি করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি নিতে হচ্ছে। এসব কড়াকড়ির কারণে গত তিন মাসে পণ্যটির আমদানি কমে গেছে।
জাহাজ আমদানি কমে যাওয়ার চিত্র উঠে এসেছে বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স এন্ড রিসাইক্লার্স এসোসিয়েশনের তথ্যেও। সংগঠনটির তথ্যমতে, এপ্রিলের পর থেকে ধারাবাহিকভাবে পুরোনো জাহাজ আমদানি কমে বর্তমানে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অর্ধেকে নেমে এসেছে। গত মাসে (জুলাই) ৫৬ হাজার ৮৪ টন (৮টি) স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি হয়েছে। এর আগে জুনে ৮৮ হাজার ২২৬ টন ও মে তে ৪৩ হাজার ৬৮৬ টন জাহাজ আমদানি হয়েছে। অথচ এপ্রিলে ১ লাখ ৯ হাজার ৯২০ টন, মার্চে ১ লাখ ৮২ হাজার ৯৭৫ টন, ফেব্রুয়ারিতে ১ লাখ ৩০ হাজার ৭০৫ টন এবং জানুয়ারিতে ১ লাখ ৫৭ হাজার ৬৪৭ টন স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি হয়েছে।
বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স এন্ড রিসাইক্লার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি আবু তাহের বলেন, 'আন্তর্জাতিক বাজারে গত তিন-চার মাস ধরে স্ক্র্যাপ ও পুরানো জাহাজের দাম অনেক কমেছে। কিন্তু পুরোনো জাহাজ আমদানি হয় ডেফার্ড এলসির মাধ্যমে। যার আমদানি মূল্য পরিশোধ হয় ১৬০ দিন কিংবা ১৮০ দিন পর। গত দুই মাস ধরে ডলারের দামের যে অবস্থা তাতে জাহাজ কাটা শেষে ১৬০ দিন পর আমদানি মূল্য পরিশোধে ডলারের বিপরীতে কত টাকা গুনতে হবে তা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে আমদানিকারকরা। ফলে লোকসানের ঝুঁকি এড়াতে আমদানি কমিয়ে দিতে হয়েছে। এতে ইয়ার্ডগুলোতে স্ক্র্যাপের সরবরাহ সংকট তৈরি হয়েছে।'
এদিকে আমদানি ও সরবরাহ সংকটের স্ক্র্যাপের দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে ইস্পাত শিল্পেও। অতিরিক্ত দাম বৃদ্ধিতে বিক্রি স্থবির ও আন্তর্জাতিক বাজারে স্ক্র্যাপের দাম কমে যাওয়ায় প্রায় তিন মাস কিছুটা নিম্নমুখী ছিল এমএস রডের দাম। কিন্তু গত তিন সপ্তাহে আবারো পণ্যটির দাম টনে ৪ হাজার টাকা বেড়ে গেছে।
ইস্পাত কারখানাগুলোতে খবর নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে বাজারে বিভিন্ন ব্রান্ডের মধ্যে ৭৫ গ্রেডের (৫০০ টিএমটি) এমএস রড ৮৫-৮৮ হাজার টাকা মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। যা জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়েও ৮১-৮৪ হাজার টাকার মধ্যে বিক্রি হয়েছে।
৭৫ গ্রেডের রডের মধ্যে বর্তমানে বিএসআরএম ৮৮ হাজার টাকা, কেএসআরএম ৮৪ হাজার ৫০০ টাকা, একেএস ৮৫ হাজার ৫০০ টাকা ও জিপিএইচ ৮৪ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
তিন সপ্তাহ আগে বাজারে বিএসআরএম ৮৪ হাজার টাকা, কেএসআরএম ৮২ হাজার ৫০০ টাকা, একেএস ও জিপিএইচ ৮২ হাজার টাকা দামে বিক্রি হয়েছে।
বর্তমানে অটো মিলের ৬০ গ্রেডের এম এস রডের মধ্যে গোল্ডেন ইস্পাত ৮৩ হাজার টাকা, এসএএসএম ৮২ হাজার টাকা, বায়েজিদ ৮২ হাজার টাকা, এইচএম স্টিল ৮৩ হাজার টাকা এবং কেআর ৮১ দরে বিক্রি হচ্ছে।
তিন সপ্তাহ আগে গোল্ডেন ৮০ হাজার টাকা, এসএএসএম ৭৯ হাজার ৫০০ টাকা, বায়েজিদ ৭৯ হাজার টাকা, এইচএম স্টিল ৭৮ হাজার ৫০০ টাকা এবং কেআর ৭৮ দরে বিক্রি হয়েছে।
গত তিন সপ্তাহে সেমি অটো মিলের ৬০ গ্রেডের রডের দামও ২ হাজার টাকা পর্যন্ত কমে গেছে। বর্তমানে বাজারে শীতলপুর স্টিলের সেমি অটো এম এস রড প্রতি টন ৭৯ হাজার টাকা, বিএম, আল ছাফা, রাইজিং, খলিল, বলাকা, আম্বিয়া, পেনিনসুলা ও মানতি স্টিলের রড ৭৮ হাজার টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। যা তিন সপ্তাহ আগেও ৭৫-৭৬ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে।
এর আগে ২০২০ সালের নভেম্বর থেকে প্রায় দেড় বছর টানা বেড়ে গেল মার্চে এমএস রডের দাম ঠেকে টনপ্রতি ৯২ হাজার টাকায়। যা ২০২০ সালের অক্টোবরে সর্বোচ্চ ৫৫ হাজার টাকায় বিক্রি হতো।
এইচ এম স্টিলের পরিচালক সরওয়ার আলম বলেন, 'যদিও রড বিক্রির ফ্লো আগের চেয়ে কম। কিন্তু রড তৈরির কাঁচামাল স্ক্র্যাপের দাম বেড়ে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় এমএস রডের দাম বেড়ে গেছে।'
তিনি আরো বলেন, 'স্ক্র্যাপ আমদানি কমে যাওয়ায় ডলার সাশ্রয় হলেও বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমে যাওয়ার সুফল পাচ্ছে না দেশের ভোক্তারা। বিশ্ববাজারে দরপতনের এই সময় পণ্য আমদানি ব্যাহত হলে দেশীয় বাজারে পণ্যের দাম কমার সম্ভাবনা কম।'
বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স এন্ড রিসাইক্লার্স এসোসিয়েশনের তথ্যমতে, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড এলাকায় ৮০টিরও বেশি শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে জাহাজ কাটার কাজ চলে। পুরানো স্ক্র্যাপ জাহাজ না থাকায় বর্তমানে ৫০টির বেশি শিপইয়ার্ড তাদের কার্যক্রম বন্ধ রেখেছে। স্বাভাবিক সময়ে শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডগুলোতে ১৫-১৬ লাখ মেট্রিক টন স্ক্র্যাপ মজুদ থাকে। কিন্তু বর্তমানে স্ক্র্যাপের মজুদ ২-৩ লাখ টনের নিচে চলে এসেছে।