এলসি সেটেলমেন্টে ডলারের দাম রেকর্ড ১১০ টাকা
গত দুইদিন ধরে নতুন রেকর্ড গড়ছে ইম্পোর্ট লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) সেটেলমেন্টে ডলারের দাম। বৃহস্পতিবার সর্বোচ্চ ১১০ টাকা রেটে এলসি সেটেলমেন্ট করেছে ব্যাংকগুলো।
এমনকি আমদানি অর্থপ্রদানের জন্য ডলারের দাম এখন কার্ব মার্কেটের চেয়ে বেশি। চলমান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অভিযানের কারণে গত দুই দিন ধরে ১০৮ টাকায় স্থিতিশীল আছে এই দাম।
আগের রেকর্ড ভেঙে বুধবার ডলারের দাম ১০৯ টাকায় পৌঁছেছে।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক বেসরকারি খাতের আমদানির জন্য ডলার সরবরাহ না করায় এলসি নিস্পত্তির ক্ষেত্রে ডলারের হার বাড়তে থাকে।
এদিকে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে আন্তঃব্যাংক বিনিময় হারে শুধুমাত্র সরকারি আমদানি এবং প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির জন্য ডলার পাচ্ছে কিছু রাষ্ট্রীয় ব্যাংক। তবুও, এই সরবরাহ ব্যাংকের প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় যথেষ্ট নয়।
অগ্রণী ব্যাংক বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ১০০ মিলিয়ন ডলারের মতো চাইলেও পেয়েছে মাত্র ১৫ মিলিয়ন।
ইন্ডাস্ট্রি ইনসাইডাররা জানিয়েছেন, আমদনি এলসি সেটেলমেন্টের ক্ষেত্রে এর আগে এতো দাম দিতে হয়নি ইমপোর্টারদের।
এর আগের রেকর্ডটি ছিল গত বুধবার। ওইদিন ব্যাংকগুলো ১০৯ টাকা রেটে আমদানি এলসির পেমেন্ট করেছিল।
ব্যাংকগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঈদের বন্ধ শেষে গত ১৩ জুলাই আমদানি করা পণ্যের পেমেন্ট করতে ব্যাংকগুলো ডলারের দাম নিয়েছিল ৯৮ টাকা করে। এর ছয় কার্যদিবস পর গত ২১ জুলাই সেটেলমেন্টের এই রেট বেড়ে ১০২ টাকা হয়। অর্থাৎ, এই সময়ের মধ্যে ডলারের দাম ৪ টাকা বেড়ে যায়।
এর পরের কার্যদিবসে ডলারের দাম আরো ২ টাকা বেড়ে ১০৪ টাকা নির্ধারিত হয়। পরদিন গত ২৬ জুলাই আরো ১ টাকা বাড়ে ডলারের দাম। আগস্টের প্রথম কার্যদিবস পর্যন্ত ডলারের দাম এমনই ছিল।
তবে এর পর থেকে ডলারের দাম আবার বাড়া শুরু হয়। গত তিন কার্যদিবসে ডলারের দাম ৫ টাকা বেড়ে গতকাল বৃহস্পতিবার ১১০ টাকায় এসে থামে। সে হিসাবে সর্বশেষ ১৬ কার্যদিবসের ব্যবধানে এলসি সেটেলমেন্টে ডলারের দাম ১২ টাকা বেড়ে গেছে।
ব্যাংকগুলো জানিয়েছে, এই দাম বাড়ার পেছনে ডলার সংকটের পাশাপাশি অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে এক্সচেঞ্জ হাউজগুলোর চড়া দামে রেমিট্যান্সের ডলার বিক্রিকে। আমদানি এলসি সেটেলমেন্টের সর্বোচ্চ দাম নির্ভর করে ব্যাংকগুলো কেমন দামে এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো থেকে রেমিট্যান্সের ডলার সংগ্রহ করতে পারছে তার উপর।
গত ১৩ জুলাই এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো রেমিট্যান্সের ডলার বিক্রি করেছিল সর্বোচ্চ ১০০ টাকা করে। বৃহস্পতিবার ব্যাংকগুলোর কাছে তারা ডলারপ্রতি ১১১-১১২ টাকা চেয়েছে। তবে এই দামে কেনাবেচা হচ্ছে কম। অনেক ব্যাংকই ১০৬-১০৮ টাকা দামে হাউজগুলো থেকে কিছু ডলার সংগ্রহ করতে পেরেছে।
চাহিদা বাড়ায় এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো দাম বাড়াচ্ছে উল্লেখ করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বেসরকারি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের কর্মকর্তা জানান, "সাধারণ পরিস্থিতিতে অন্য ব্যাংক থেকে ডলার কেনাসহ ডলার সংগ্রহের বেশ কয়েকটি উৎস থাকে। তবে চলমান সংকটের কারণে সিংহভাগ ব্যাংকের কাছেই উদ্বৃত্ত ডলার নেই। ফলে ডলার পেতে এক্সচেঞ্জ হাউজগুলোর ওপরই ভরসা করতে হচ্ছে বেশি। বর্তমান অবস্থায় বেশিরভাগ ব্যাংককেই আমদানি এলসির পেমেন্টের চাপ থাকায় তারা রীতিমতো প্রতিযোগিতা করছে হাউজগুলো থেকে ডলার কিনতে।"
তবে সর্বোচ্চ দামেই যে সব এলসি সেটেলমেন্ট হচ্ছে এমন নয়। সরকারি কেনাকাটা ও খাদ্যপণ্যের মতো প্রয়োজনীয় দ্রব্যের ক্ষেত্রে বৃহস্পতিবার সরকারি ব্যাংকগুলো ৯৪.৭৫ টাকা বা তার কিছু বেশি করে নিচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে কিছু ডলার পাওয়ায় এমন দাম রাখতে পারছে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলো।
এর বাইরে বেসরকারি ব্যাংকগুলো গ্রাহক-ব্যাংক সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে ১০৬ টাকা থেকে ১১০ টাকা রেট নিয়েছে। মূলত বড় অঙ্কের এলসি পেমেন্টের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো থেকে ডলার সংগ্রহ করতে হওয়ায় ডলারের রেটও বেশি হচ্ছে।
এমন অবস্থায় রপ্তানিকারকেরাও রপ্তানি পেমেন্ট এনক্যাশ করার ক্ষেত্রে দাম বেশি চাইছেন। গত ১৩ জুলাই এক্সপোর্টাররা সর্বোচ্চ ৯৫ টাকার মতো রেট পেলেও গত দুইদিন ধরে কেউই ১০০ টাকার কমে এনক্যাশ করাতে চাইছেন না। বড় এক্সপোর্টারদের মধ্যে অনেকে ১০২ টাকা পর্যন্ত রেট পেয়েছেন।
এদিকে, বুধবার রিজার্ভ থেকে ৯৪.৭০ টাকা ইন্টারব্যাংক এক্সচেঞ্জ রেটে ২৫ মিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে এ পর্যন্ত ১.২ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিক্রি করা হয়েছে রিজার্ভ থেকে।
বৃহস্পতিবার দিনশেষে রিজার্ভ ছিল ৩৯.৬৭ বিলিয়ন ডলার।
আমদানি এলসি সেটেলমেন্টে ডলারের দাম বাড়ায় মোট আমদানি কমবে উল্লেখ করে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর টিবিএসকে বলেন, "মুদ্রানীতিকে আমরা ঠিকমতো ব্যবহার করছি না। সুদের হারকে বেঁধে রেখে সরকার সবচেয়ে বড় ভুল করছে। এটার কারণেই ডলারের দাম বাড়ছে। সুদের হার বাড়ালে টাকাটা এট্রাকটিভ হতো। তবে সুদের হার বাড়ালে আমাদের মূল্যস্ফীতিও বাড়বে।"
"এক্সচেঞ্জ রেটকে এখন বাজারের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তবে এটি ইচ্ছা করে করা হয়নি। বাজারে চাপ তৈরি হওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। নিজে থেকে বাজারের হাতে ছাড়লে আজকে এ অবস্থা (ডলারের দাম বেড়ে যাওয়া) হতো না," উল্লেখ করেন তিনি।
ডলারের দাম বাড়ার কারণে সরকারের ভর্তুকি ব্যয় ও ঋণের কিস্তিতে বেশি ব্যয় হবে বলে মন্তব্য করেন এই অর্থনীতিবিদ।
এদিকে খোলাবাজারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মনিটরিং এর কারণে আতঙ্কে আছে ব্যবসায়ীরা। অনেক ব্যবসায়ী ডলার কেনাবেচা করছেন না।
বৃহস্পতিবার কার্ব মার্কেটে ডলার ১০৭ টাকায় কিনে ১০৮ টাকায় বিক্রি করেছে মানি চেঞ্জারগুলো। বুধবারও নগদ ডলারের এমন দাম ছিল কার্ব মার্কেটে। গত ২৬ জুলাই রেকর্ড ১১২ টাকায় পৌঁছেছিল কার্ব মার্কেটের ডলারের দাম।
খোলাবাজারে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়াকে কেন্দ্র করে শুরু করা মনিটরিং অব্যাহত রেখেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বৃহস্পতিবারও বাংলাদেশ ব্যাংকের বেশ কয়েকটি প্রতিনিধি দল মানি চেঞ্জার প্রতিষ্ঠানগুলো ইন্সপেকশন করেছে।