সুবিধাজনক অবস্থানে থেকেও কুমিল্লায় বাড়েনি রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠান
কুমিল্লা নগরীর বিসিক শিল্প এলাকায় অবস্থিত রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো কুমিল্লার শাখা অফিস। কুমিল্লায় এর প্রতিষ্ঠাকাল ১৯৭৯। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটিতে গিয়ে দেখা যায় অ্যাকাউন্ট্যান্ট চেয়ারে বসে আছেন। পাশে দুই এমএলএস। একটি কক্ষ সহকারী পরিচালকের জন্য বরাদ্দকৃত। প্রতিষ্ঠানটির বয়স ৪৩ হলেও এর কলেবর বৃদ্ধি করা হয়নি। কুমিল্লাসহ দেশের আরও কয়েকটি জেলার রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানসমূহের লাইসেন্স নবায়নের দায়িত্ব পালন করে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো অফিসটি। কিন্তু জেলায় রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কম হওয়ায় এ প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের সময় কাটে অলসতায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পোশাক শিল্পের বাইরে এ বছর মাত্র ১৭টি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান কুমিল্লা রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো অফিসে তাদের লাইসেন্স নবায়ন করেছে। যাদের আবার বেশিরভাগ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার প্রতিষ্ঠান। এই ১৭টি প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশই উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান নয়। তারা অন্যদের থেকে পণ্য কিনে রপ্তানি করে।
কুমিল্লা রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর শাখা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, রপ্তানি বাড়াতে তারা নানাভাবে আমদানিকারক ও রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ করে থাকেন। বছরে দুইবার সেমিনারের আয়োজন করেন। ওয়েবসাইটে রপ্তানিযোগ্য পণ্যের বিষয়ে তথ্য দিয়ে থাকেন, যাতে বায়াররা সহজে তথ্য পান। এছাড়া সর্বোচ্চ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানকে ট্রফি দেন তারা। কিন্তু কুমিল্লা কেন্দ্রিক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান কম থাকায় কার্যত রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো কুমিল্লা শাখার কার্যক্রম একেবারেই কম।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো কুমিল্লা শাখার সহকারী পরিচালক এ এইচ এম এরশাদুর রহমান জানান, কুমিল্লার কিছু কিছু রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ঢাকা থেকে তাদের লাইসেন্স নবায়ন করে। তাছাড়া অনেকে 'সেলফ ডিক্লারেশনে' চলে গেছেন। তাই এ শাখার কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে।
সূত্র জানায়, কুমিল্লা ইপিজেড ব্যতীত মাত্র চারটি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের তালিকা আছে কলকারখানা উন্নয়ন কেন্দ্রে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো আর্মি শার্ট, ডেনিম ফ্যাশন, লালমাই ফুটওয়্যার ও জেএম ফুটওয়্যার। এসব প্রতিষ্ঠানে প্রায় ২৫ হাজার লোক কর্মরত আছে। কুমিল্লা ইপিজেডে কর্মরত আছে আরও ৫০ হাজার। সবমিলিয়ে কুমিল্লার রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন প্রায় ৮০ হাজার মানুষ। যাদের মধ্যে ৭০ হাজার আবার স্থানীয়। রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ানো গেলে কুমিল্লায় বিপুল মানুষের কর্মসংস্থান হতো। কমতো বেকারত্বও।
কুমিল্লায় প্রায় এক কোটি জনসংখ্যা। শিক্ষিত ও দক্ষ জনসংখ্যার কমতি নেই এই জেলায়। তবু স্বাধীনতার ৫২ বছরেও বলার মতো রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান গড়ে না ওঠায় হতাশ এখানকার মানুষ। যে কারণে স্থানীয়ভাবে কর্মসংস্থান অতটা গড়ে ওঠেনি। দেশের সুবিধাজনক জায়গা ও ভারত সীমান্তঘেঁষা জেলা হয়েও কুমিল্লায় বেশিসংখ্যক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান গড়ে না ওঠাকে উদ্বেগজনক মনে করছেন কুমিল্লার সুশীল সমাজ ও ব্যবসায়ীরা। সেই সাথে বিনিয়োগকারীদের কুমিল্লার প্রতি আরও আন্তরিক হওয়া এবং সরকারকে কুমিল্লার ভৌগলিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে কাজ করার অনুরোধ করেছেন তারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কুমিল্লার একাধিক বাসিন্দা জানান, কুমিল্লা রাজনৈতিক কারণে অনেক পিছিয়ে আছে। টাঙ্গাইল, নরসিংদী বা মিরসরাইয়ের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে যদি চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে পণ্য রপ্তানি হয়, তাহলে কুমিল্লা থেকে তো আরও সহজে পণ্য রপ্তানি হওয়ার কথা।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) কুমিল্লার সভাপতি আলী আকবর মাসুম বলেন, 'কুমিল্লায় আগেও অনেক ইন্ডাস্ট্রি ছিল। কিন্তু রপ্তানির দিক থেকে তারা কখনো সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল বলে মনে হয় না। এর একটা কারণ হতে পারে অঞ্চলভিত্তিক বিনিয়োগ। অঞ্চলভিত্তিক বিনিয়োগের কারণে কুমিল্লা পিছিয়ে পড়েছে। কুমিল্লার ভৌগলিক অবস্থান বিবেচনায় নিয়ে সরকার ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বিনিয়োগ বাড়াতে পারেন। এতে সরকারের যেমন রাজস্ব আয় বাড়বে, তৈরি হবে নতুন নতুন কর্মসংস্থান।'
কুমিল্লা সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি জামাল আহমেদ বলেন, 'ঢাকা ও চট্টগ্রাম কেন্দ্রিক বিনিয়োগের কারণে কুমিল্লার এমন দুরবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। অথচ কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রাম বন্দর খুবই কাছে।'
কুমিল্লায় রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কম হওয়ার বিষয়ে জামাল আহমেদ জানান, এ সংখ্যা আরও বেশি। কিছু প্রতিষ্ঠান ঢাকা ও চট্টগ্রাম রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোতে নিবন্ধন করেছে।
কুমিল্লা চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মাসুদ পারভেজ খান ইমরান বলেন, 'কুমিল্লায় কেউ বিনিয়োগ করতে চান না, এর পেছনে কয়েকটি কারণ আছে। প্রথম কারণ হলো কুমিল্লার বিমানবন্দরটিকে সচল করা হয়নি। যার কারণে বিদেশিরা ঝামেলা মাথায় নিয়ে কুমিল্লায় আসতে চান না। দ্বিতীয় কারণ হলো ইপিজেডের সাথে সরাসরি রেললাইন চালু না থাকা। পূর্বে ময়নামতি স্টেশন থেকে ইপিজেড এলাকায় রেল সংযোগ ছিল। মাত্র দুই কিলোমিটার এলাকায় রেলসংযোগ বাড়ানো গেলে মালামাল চট্টগ্রামে ডেলিভারি দেওয়া সহজ যেতো। ইন্ডাস্ট্রির জন্য ব্যবহার্য মেশিনপত্র ট্রেনে আনা-নেওয়া করা যেতো। এ জায়গাগুলোয় পরিবর্তন আসলে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়ে যেতো।'
কুমিল্লা কলকারখানা উন্নয়ন কেন্দ্রের উপ-পরিচালক এ কে এম মামুনুর জানান, রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়াতে হলে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। কুমিল্লায় বিনিয়োগ বাড়ানোর পরিকল্পনা না থাকায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
তিনি বলেন, 'আমাদের তথ্যানুযায়ী ইপিজেড বাদে কুমিল্লায় ছোট-বড় ইন্ডাস্ট্রির সংখ্যা প্রায় আটশ। অথচ রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠান মাত্র চারটি।'