অভিবাসী শ্রমিকরা যেভাবে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া উভয় দেশের জন্যই আশীর্বাদ
বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যে পারস্পারিক বন্ধুত্ব ও আস্থার সম্পর্কের এক নতুন যাত্রার সূচনা করলেন ৫৩ জন বাংলাদেশি রেমিট্যান্স যোদ্ধা।
প্রায় চার বছর বিরতির পর দেশটির শ্রমবাজার আবারও বাংলাদেশি শ্রমিকদের কাছ থেকে আবেদন নিতে শুরু করে। দীর্ঘ বিরতির পর গত ৯ আগস্ট প্রথমবারের মতো অফ হোয়াইট টি-শার্ট ও হ্যাট পরিহিত অভিবাসী শ্রমিকদের দলটি মালয়শিয়ায় পৌঁছে।
মালয়েশিয়া সকল অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য পাঁচ বছরের কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এছাড়াও দেশটির সরকার বাংলাদেশিদের নির্মাণ খাতসহ খনি, গার্হস্থ্য পরিষেবা, উত্পাদন ও প্ল্যান্টেশনসহ বিভিন্ন শিল্প সংশ্লিষ্ট খাতে চাকরির আবেদনের অনুমোদন দিয়েছে।
মালয়েশিয়া সরকারের প্রতিষ্ঠিত নতুন মজুরি ব্যবস্থা অনুযায়ী শ্রমিকরা প্রতি মাসে কমপক্ষে দেড় হাজার মালয়শিয়ান রিংগিট (প্রায় ৩৭ হাজার টাকা) বেতন পাবেন। এছাড়াও তারা মালয়েশিয়ার আইন অনুসারে ওভারটাইম বেতন, বিনামূল্যে আবাসন, স্বাস্থ্য বীমা এবং কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনাজনিত বীমাসহ সমস্ত সুবিধা লাভের যোগ্য হিসেবেও বিবেচিত হবেন।
১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানো শুরু করে। ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটিতে ১০ লাখ ৬০ হাজার বিশেষ দক্ষতা সম্পন্ন ও সাধারণ শ্রমিক পাঠিয়েছে।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি)-র মতে, আগামী চার মাসে বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় আরও ৬০ থেকে ৮০ হাজার অভিবাসী শ্রমিক পাঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
আগামী তিন বছরে মালয়েশিয়ায় আরও ৫ লাখ অতিরিক্ত বাংলাদেশি শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হবে বলেও জানা গেছে, যা থেকে বাংলাদেশ আগামী পাঁচ বছরে ৪৫ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স লাভ করবে। এর আগে গত বছর মালয়েশিয়া থেকে বাংলাদেশিরা ১.০৯ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স পাঠায়।
করোনা ভাইরাসের পর শ্রমিক ঘাটতির কারণে মালয়েশিয়া সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে জনশক্তি আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়।
করোনা মহামারির সময় মালয়েশিয়ার পাম তেল প্ল্যান্টেশন থেকে শুরু করে সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদনকারীরাও ১০ লাখের বেশি শ্রমিক ঘাটতির কারণে ক্রয়াদেশ ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হন। এরই সঙ্গে দেশটির কয়েক বিলিয়ন ডলারের আয় হ্রাস পায় যা অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের পথে বাধা সৃষ্টি করে।
মালয়েশিয়ার কারখানা, প্ল্যান্টেশন ও শ্রমবাজারগুলোতে কয়েক লাখ বিদেশি অভিবাসী কাজ করে থাকেন। রপ্তানিনির্ভর দেশটি বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মালয়েশিয়ার সমস্ত শিল্প ও সেবাদান খাতে বর্তমানে অন্তত ১২ লাখ কর্মীর ঘাটতি রয়েছে। মহামারি কেটে যাওয়ার পর চাহিদা বাড়তে থাকায় দেশটির রপ্তানি আদেশ বাড়ছে। একই সঙ্গে শ্রমিক সংকটও ঘনীভূত হচ্ছে।
ফেডারেশন অব মালয়েশিয়ান ম্যানুফ্যাকচারার্স, মালয়েশিয়া সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন ও মালয়েশিয়ার অন্যান্য সংস্থাগুলোর দাবি অনুযায়ী মালয়েশিয়ার জরুরিভাবে পণ্য উৎপাদনে ছয় লাখ কর্মী, নির্মাণ খাতে সাড়ে ৫ লাখ কর্মী, পাম তেল শিল্পে এক লাখ ২০ হাজার কর্মী, চিপ তৈরির কারখানায় ১৫ হাজার কর্মী ও মেডিক্যাল গ্লাভস কারখানায় ১২ হাজার কর্মী প্রয়োজন।
ফল না তুললে পচন ধরে বলে চলতি বছর প্রায় ৩ মিলিয়ন টন পাম ফলন নষ্ট হওয়ার শঙ্কা করছে দেশটির পাম তেল শিল্প সংশ্লিষ্টরা যা থেকে ৪ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি ক্ষতি হতে পারে। মালয়েশিয়ার জিডিপির ৫ শতাংশই আসে পাম তেলের খাত থেকে। শ্রমিক ঘাটতি চলতে থাকলে রাবার গ্লাভস কারখানায় চলতি বছর ৭০০ মিলিয়ন ডলার ক্ষতির শঙ্কা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া ২০২১ সালের ডিসেম্বরে বাজার সম্প্রসারণের লক্ষ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে। তবে নিয়োগকারী এজেন্টদের নিয়ে কিছু বিতর্ক ও সমালোচনা ছিল। বাংলাদেশ একটি স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় কাজ করতে চায় বলে সব এজেন্টদের তালিকা সরবরাহ করলেও এর আগে মালয়েশিয়া সরকার শ্রমিক নিয়োগের জন্য শুধু ২৫টি সংস্থাকে নির্বাচিত করে।
২০০৯ সাল পর্যন্ত সব সংস্থাই কোনো বাধ্যবাধকতা ছাড়াই মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠাতে পারত। কর্মী পাঠানোর সর্বোচ্চ সুবিধা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি (বায়রা), বিএমইটি এবং বাংলাদেশ-মালয়েশিয়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (বিএমসিসিআই) থেকেও ফেডারেশন অব মালয়কে অনুরোধ করা হয়েছে।
এর আগে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর সিন্ডিকেট গঠন নিয়ে সমস্যা হয়। বাংলাদেশে এক হাজারেরও বেশি রিক্রুটিং এজেন্সি রয়েছে। তাদের নিয়োগের অনুমতি দেওয়া হলে সারা দেশে আরও দক্ষ লোক খুঁজে পাওয়া সহজ হবে। বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা আইন ২০১২ ও বিদেশি শ্রম নিয়োগ সংক্রান্ত আইএলও চার্টারগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে মালয়েশিয়া এখন সকল বৈধ রিক্রুটমেন্ট সংস্থাকে অনুমতি দিবে।
স্বচ্ছ নিয়োগকারী সংস্থাগুলোর মাধ্যমে মানব পাচার ও জোরপূর্বক শ্রমের মতো বিষয়গুলোরও অবদান ঘটবে। উভয় দেশের মানবাধিকার সংস্থাই বিষয়গুলো নিয়ে নিয়মিত অভিযোগ করে থাকে। মালয়েশিয়ার স্থানীয় কিছু মানবাধিকার সংস্থা সেখানে জোরপূর্বক শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করানোর অভিযোগ করে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব স্টেট ২০২২ সালের ট্রাফিকিং ইন পারসনস প্রতিবেদন প্রকাশ করে জানায় যে বাংলাদেশ মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে তদন্ত, বিচার ও মামলা নিষ্পত্তির মাধ্যমে পাচার প্রতিরোধে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে।
কিন্তু তারপরও মালয়েশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের মানব পাচার প্রতিবেদনের সবচেয়ে নিম্নস্তরের কাতারে রয়েছে। দেশটির সরকার পাচার প্রতিরোধে পাচার বিরোধী আইন ও কর্মসংস্থান আইন সংশোধনের মতো পদক্ষেপ নিলেও তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর সার্বিক সহযোগিতা প্রয়োজন।
অপর যে সমস্যাটি প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছিল তার মধ্যে আছে অবৈধ অভিবাসী সংক্রান্ত জটিলতা। প্রায় দুই লাখ বাংলাদেশি যথাযথ কাগজপত্র ছাড়াই মালয়েশিয়ায় বাস করছেন। অবৈধ শ্রমিকদের ধরতে মালয়েশিয়া অভিযান অব্যাহত রেখেছে। অবৈধ শ্রমিকদের ওয়ার্ক পারমিট নবায়ন করারও প্রস্তাব রেখে মালয়েশিয়া সরকার। নতুন চুক্তি অনুযায়ী দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে কাজ করে আসা অভিবাসীরাও বৈধভাবে কাজের সুযোগ পেতে আইনি সহায়তা পাবেন। এরফলে অভিজ্ঞ ও দক্ষ কর্মীরা নিজ খাতেই কাজ করার সুযোগ পাবেন।
বৈশ্বিক সংকটের মধ্যে নতুন এই উদ্যোগের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া উভয় দেশই জনশক্তি রপ্তানি ও আমদানির মাধ্যমে উপকৃত হবে। যেহেতু বাংলাদেশ মালয়েশিয়ার অভিবাসী জনশক্তির অন্যতম প্রধান উৎস, তাই উভয় দেশই এখন বৈদেশিক মুদ্রা আয়কারীদের নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করে অভিবাসী কর্মীদের নিয়োগ ত্বরান্বিত করার মাধ্যমে নিজেদের রপ্তানি আয় বৃদ্ধিতে সক্ষম হবে।
- সূত্র: মডার্ন ডিপ্লোমেসি