আশ্রয়কেন্দ্রের ব্যবস্থা নেই, লেবাননে বাস্তুচ্যুত বিদেশি শ্রমিকদের দিন কাটছে পার্কে, সমুদ্রতীরে
১১ মাস আগে যখন লাকমানির বাড়ির কাছাকাছি এলাকায় হামলা হয়, তখন তিনি ও তার মা সোনিয়া দক্ষিণ লেবাননে তাদের গ্রাম জোয়াইয়াতে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। গ্রামটি টায়ার শহর থেকে দক্ষিণে সড়কপথে ২৫ মিনিট এবং দক্ষিণ লেবাননের সীমান্ত থেকে প্রায় এক ঘণ্টার দূরত্বে অবস্থিত।
লাকমানি বলছিলেন, 'কিছু জায়গায় অভিযান চালানো হয়েছে, যে জায়গাগুলো তার বাড়ি থেকে খুব বেশি দূরে নয়।' পাশ থেকে তার ৪৫ বছর বয়সী মা সোনিয়া বললেন, মাঝে মাঝে তারা যুদ্ধবিমান উড়ে যাওয়ার প্রচণ্ড শব্দও শুনতে পেতেন।
লাকমানিকে জন্ম দেওয়ার আগে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে কাজ করতে শ্রীলঙ্কা থেকে লেবাননে পাড়ি জমান সোনিয়া। জন্মের পর থেকে লাকমানি এ দেশেই বড় হয়েছেন। তিনি একজন প্রাইভেট টিউটর হিসেবে কাজ করছেন।
২৬ বছর বয়সী লাকমানির সঙ্গে যখন আলজাজিরার কথা হয় তখন তিনি লেবাননের রাজধানী বৈরুতের একটি পার্কের বেঞ্চে বসেছিলেন। ওই বেঞ্চেই এখন রাত কাটে তার ও তার মায়ের।
লাকমানি জানান, সোমবার (২৩ সেপ্টেম্বর) যখন বোমা হামলা শুরু হয়, তখনই তারা সিদ্ধান্ত নেন যে তাদের আর এক মুহূর্তও দেরি করা উচিত নয়।
১৯৯০ সালে গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ওই দিনটিই (২৩ সেপ্টেম্বর) ছিল লেবাননের সবচেয়ে ভয়াবহ দিন। সেদিন লেবাননের দক্ষিণাঞ্চল ও পূর্বে বেকা উপত্যকায় ইসরায়েলের নির্বিচার বোমা হামলায় অন্তত সাড়ে ৫০০ মানুষ নিহত হয়।
এ অবস্থায় লাকমানি ও তার মা ঘরবাড়ি ছেড়ে টায়ার শহরে চলে যান। সঙ্গে তেমন জিনিসপত্রও আনতে পারেননি তারা। যা এনেছেন, তার বেশিরভাগই কাপড়-চোপড়।
তারা ভেবেছিলেন হয়ত টায়ার শহরে তারা নিরাপদ। কিন্তু তিন দিন পর এ শহরের আশে-পাশেও ইসরায়েলি বিমান হামলা শুরু হয়। তাই বাধ্য হয়ে তারা সেখান থেকে উত্তরে বৈরুতে চলে যান।
কিন্তু সেখানেও বিপত্তি। গত ২৭ সেপ্টেম্বর ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী বৈরুতের দক্ষিণ শহরতলীর বিশাল একটি অংশ খালি করার জন্য সেখানকার বাসিন্দাদের আদেশ দেয়।
রাত কাটানোর জন্য বৈরুতে মার্টার্স স্কয়ারের পাশে সাইফি শহরে অবস্থিত এক পার্কে অল্প একটু জায়গা খুঁজে পেয়েছেন লাকমানি ও তার মা। তাদের মতো এ দেশে অবস্থানরত বহু অভিবাসী শ্রমিকের চোখেই এখন ঘুম নেই।
জাতিসংঘের মানবিক বিষয়ক সমন্বয়ের কার্যালয়ের (ওসিএইচএ) তথ্যমতে, ইতোমধ্যে গত ১১ মাসে প্রায় এক লাখ দুই হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। এখন সংখ্যাটি প্রায় এক মিলিয়ন।
অবজ্ঞার শিকার
লেবাননের শিক্ষা মন্ত্রণালয় সারাদেশের স্কুলগুলোতে বাস্তুচ্যুতদের জন্য আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছে। তবে সেখানে কেবল লেবাননের নাগরিকদের থাকার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। আর যারা লেবাননের নাগরিক নন, তারা বৈরুতের সমুদ্রতীরে কিংবা কোনো পাবলিক প্লেসে আশ্রয় নিয়েছেন।
আন্তর্জাতিক অভিবাসী সংস্থার তথ্যমতে, লেবাননে অভিবাসীর সংখ্যা এক লাখ ৭৬ হাজার ৫০০ জন। তবে বাস্তবে সংখ্যাটি আরও বেশি বলেই ধারণা করা হয়।
সম্প্রতি ইসরায়েলের হামলার জেরে এসব অভিবাসীর বিভিন্ন সমস্যা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অভিবাসী নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞ কর্মীরা আলজাজিরাকে বলছেন, যুদ্ধ তাদের বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন করেছে।
দিয়ালা আহওয়াশ নামের এক মানবাধিকারকর্মী বলেন, হামলার কারণে বহু অভিবাসী বিশেষ করে দক্ষিণ লেবানন ও বেকা উপত্যকার অভিবাসীরা তাদের নিয়োগদাতাদের বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। তারা তাদের পাসপোর্ট কিংবা বৈধ কাগজপত্রও সঙ্গে আনার সময়টুকু পাননি। এ অবস্থাতেই এখানে-সেখানে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে চলেছেন তারা।
আবার কোনো কোনো অভিবাসী শ্রমিককে তাদের নিয়োগদাতারাই নিরাপদ এলাকায় ছেড়ে গেছেন। তারাও বাধ্য হয়ে পথে পথে ঘুরছেন, ঘুমাচ্ছেন পার্ক কিংবা সমুদ্রতীরে। কাউকে প্রথমে আশ্রয়কেন্দ্রে জায়গা দেওয়া হলেও লেবানিজ না হওয়ায় পরে তাদের সেখান থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে।
বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের কর্মী সালমা সাকর আলজাজিরাকে বলেন, এসব নারীরও (অভিবাসী) যে অধিকার রয়েছে, সেটি কেউই বুঝতে চাইছে না। বিষয়টি এমন যে যখন তাদের প্রয়োজন, তখন তাদের কাজে রাখা হচ্ছে। আর কাজ ফুরোলেই তাদের রাস্তায় ফেলে দেওয়া হচ্ছে।'
তিনি বলেন, 'অভিবাসী শ্রমিকদের বেশিরভাগই বিভিন্ন মাত্রায় অনিশ্চিত সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। সাধারণভাবে বলতে গেলে এটি একটি বিপর্যয়।'
'যুদ্ধ ছাড়া কোনো জায়গা নেই'
যুদ্ধ বাড়তে থাকায় কিছু দূতাবাস তাদের নাগরিকদের লেবানন থেকে সরিয়ে নিতে শুরু করেছে।
ফিলিপাইনের দূতাবাস তাদের নাগরিকদের কোনো ধরনের ফি ছাড়াই দেশে ফিরিয়ে নিচ্ছে। আবার কিছু কিছু দূতাবাস শ্রমিকদের কাছ থেকে দেশে পাঠানোর জন্য বিমান ভাড়া নিচ্ছে।
লেবাননে কম মজুরিতে চাকরি করেন এমন অনেক অভিবাসী রয়েছেন, যাদের বিমান ভাড়ার খরচ বহনের সামর্থ নেই। এতে তারা বেশ বিপাকে পড়েছেন।
যেখানে কিছু কিছু দেশের দূতাবাস তাদের শ্রমিকদের দেশে পাঠানোর জন্য অর্থ দিয়ে সহায়তা করছে, সেখানে এ পরিস্থিতিতে শ্রমিকদের কাছ থেকে অর্থ নেওয়ায় কিছু দেশের দূতাবাসের সমালোচনা করেছেন সালমা সাকর।
সাইফি শহরের পার্কটিতে ৩০ বছর বয়সী রোজ নামের এক ইথিওপিয়ান নাগরিকের সঙ্গে কথা হয়। তার সঙ্গে বসেছিলেন আরও দুই ইথিওপিয়ান। গত শুক্রবার পর্যন্তও তারা সবাই বৈরুতের দক্ষিণ শহরতলীতে ছিলেন। কিন্তু এখন তারা ঘর ছেড়ে পার্কে আশ্রয় নিয়েছেন।
রোজ লেবাননে এসেছেন ১২ বছর হলো। তিনি একজন ফ্রিল্যান্সার। সুদানি স্বামী ও দুই সন্তানকে নিয়ে তার সংসার। রোজের সঙ্গে আলাপ করতে গেলে তিনি বলেন, 'সবাই এখানে আমাদের ইন্টারভিউ নিতে আসে। কিন্তু এই ইন্টারভিউ থেকে আমাদের কী লাভ?'
কথাগুলো বলার সময় তার চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ ছিল স্পষ্ট। একপর্যায়ে তিনি বলেন, 'যুদ্ধ ছাড়া কোনো জায়গা স্থান নেই।'
পার্কটিতে আশ্রয় নেওয়া নারী অভিবাসীরা গোসল ও টয়লেট ব্যবহার নিয়ে সবচেয়ে বড় সমস্যায় পড়ছেন বলে জানান মোরতাদা (৩৬) নামে বাস্তুচ্যুত এক সুদানি নাগরিক। তিনিও বাস্তুচ্যুতির শিকার। তার আগে তিনি দক্ষিণ লেবাননে থাকতেন।
মানবাধিকার কর্মীদের মতে, এসব অভিবাসী লেবানন সরকারের তরফ থেকে উল্লেখজনক সহায়তা পাচ্ছেন না বললেই চলে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়, যেসব অভিবাসীর কাগজপত্রের মেয়াদ শেষ, তাদের কাছ থেকে লেবাননের সীমান্তরক্ষী বাহিনী কয়েক শো থেকে শুরু করে হাজার হাজার ডলার জরিমানা আদায় করছে। অথচ বেশিরভাগ শ্রমিকেরই মাসিক আয় সর্বোচ্চ কয়েক শো ডলার।
লেবাননে অভিবাসী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা সংস্থা মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কার্স অ্যাসোসিয়েশনের দারা ফোই'ইলে বলেন, যেহেতু লেবাননে নির্বিচার হামলা হচ্ছে, তাই এখানে দুর্বল শ্রেণির কথা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ। যেসব অনথিভুক্ত শ্রমিক দেশে ফিরে যেতে চান, তাদের জন্য সাধারণ ক্ষমা প্রয়োজন।
'যুদ্ধ শেষ না হলে ঘরে ফিরে যাবো'
বৈরুতের পার্কটিতে বসে লাকমানি বলছিলেন, পার্কটি মোটামুটি ভালো একটি আশ্রয়স্থল। তবে তারা গোসল ও টয়লেটের ভালো ব্যবস্থা রয়েছে এমন একটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জায়গা চান। তিনি বলেন, 'আমরা এখানে স্বস্তিবোধ করছি না। কিন্তু তারপরও আমাদের এটি সহ্য করতে হচ্ছে। আমরা এভাবে রাস্তায় বের হতে অভ্যস্থ নই।'
লাকমানি আরও বলেন, 'আমরা শ্রীলঙ্কায় ফিরে যেতে পারি না। ওখানে আমাদের কিছুই নেই। আমরা অপেক্ষা করতে চাই ও দেখতে চাই কী হয়। যদি এখানে কোনো সমাধান না পাই, তাহলে আমরা আমাদের গ্রামে ফিরে যাবো।'
অনুবাদ: রেদওয়ানুল হক