গ্যাস অপচয় কমাতে ২৪ লাখ প্রিপেইড মিটার স্থাপনের পরিকল্পনা
৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে গ্যাস সংযোগের ২৪ লাখ প্রিপেইড মিটার স্থাপন করতে চায় সরকার।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)-এর সূত্রগুলি জানিয়েছে, প্রকল্প অর্থায়নের জন্য তারা এপর্যন্ত তিনটি বিদেশি ঋণদাতা সংস্থার সাথে যোগাযোগ করেছে। এরমধ্যে ইআরডির পক্ষ থেকে দেওয়া প্রস্তাবে প্রাথমিক সম্মতি দিয়েছে বিশ্বব্যাংক এবং পরবর্তী আলোচনা বেগবান করতে একটি 'প্রজেক্ট ইনফরমেশন ডকুমেন্ট' ইস্যু করেছে।
বিশ্বব্যাংকের নথিটিতে বলা হয়েছে, মিটার স্থাপনের ফলে গ্যাসের অপচয় ও লোকসান দূর হবে এবং ভোক্তার ওপর চাপ কমবে।
এ লক্ষ্যে তিনটি প্রকল্প বাস্তবায়নে বিশ্বব্যাংকের কাছে ৩ হাজার কোটি, জাপান ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন (জেবিআইসি)'র কাছে ১ হাজার ২৮১ কোটি এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)'র কাছে ৯৪২ কোটি টাকা চেয়েছে ইআরডি।
এরমধ্যে ৫ লাখ ৪৯ হাজার মিটার স্থাপনে এডিবির কাছে অর্থায়ন চাওয়া হয়েছে ১ হাজার ৮৭ কোটি টাকা। আরও সাত লাখ মিটার স্থাপনে জেবিআইসি'র কাছে ১ হাজার ৪৭৩ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে।
'গ্যাস খাতের কার্যকারিতা বৃদ্ধি এবং ডিকার্বনাইজেশন প্রকল্পে'র জন্য বিশ্বব্যাংকের কাছে চাওয়া হয়েছে ৩০ কোটি ডলার। এই ঋণের মধ্যে ২৭ কোটি ডলারে ১১ লাখ ৮৬ হাজার মিটার স্থাপনের একটি সাব-কম্পোনেন্ট রয়েছে।
তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (টিজিটিডিসিএল)- এর পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের জেনারেল ম্যানেজার ইঞ্জিনিয়ার মো. শফিকুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন যে, দাতাদের কাছ থেকে সহায়তা পাওয়া নিশ্চিত হলে এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হবে।
তিনি বলেন, ২০১৫ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) কর্তৃক অনুমোদিত একটি চলমান প্রকল্পের মাধ্যমে তিতাস ইতোমধ্যে প্রায় ৩ লাখ ২০ হাজার প্রিপেইড মিটার স্থাপন করছে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের মধ্যে প্রকল্পটি সম্পন্ন হওয়ার কথা থাকলেও, পরবর্তীতে তা বাড়িয়ে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়েছে। একইসাথে এর আওতায় আরও এক লাখ মিটার স্থাপনের লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে।
সাম্প্রতিক প্রকল্পগুলি অনুমোদন পেলে বেশিরভাগ বা ২৩.৫ লাখ মিটার পাবে তিতাস গ্যাস। এর মাধ্যমে গৃহস্থালি পর্যায়ের প্রায় ৯৩.৪৪ শতাংশ গ্রাহককে মিটার কাভারেজের আওতায় আনতে পারবে দেশের বৃহত্তম গ্যাস বিতরণকারী কোম্পানিটি।
বাকি ৮৬ হাজার মিটার পাবে পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (পিজিসিএল), তাদের গৃহস্থালি পর্যায়ের গ্রাহক রয়েছে প্রায় এক লাখ।
বিশ্বব্যাংকের প্রজেক্ট ইনফরমেশন নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, যে পরিমাণ গ্যাসই ব্যবহার হোক না কেন বাংলাদেশের আবাসিক খাতের গ্রাহকরা নির্দিষ্ট একটি মাসিক বিল পরিশোধ করেন। এতে মূল্যবান সম্পদটির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত হয় না।
এই অবস্থার পরিবর্তন আনবে প্রিপেইড মিটার।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর পেট্রোলিয়াম ও খনিজ সম্পদ প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তামিম টিবিএসকে বলেন, প্রিপেইড মিটার মূল্য নির্ধারণের অসামঞ্জস্য দূর করবে।
কেউ ২৪ ঘন্টা ব্যবহার করে ১,০০০ টাকা বিল দিচ্ছে, আবার অনেকেই দুই ঘন্টা ব্যবহার করে একই পরিমাণে বিল দিচ্ছে। এ হিসাবে, গ্যাস খাতে নায্যতা প্রতিষ্ঠায় মিটার ব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব দেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, মিটারের ব্যবস্থা করা গেলে গ্যাসের ব্যবহার ও অপচয় অনেকটাই কমে আসবে। তাছাড়া, মানুষের মধ্যে সচেতনতা বেড়ে যাওয়ায় এখন সারা রাত চুলা জালিয়ে রাখার প্রবণতা কমেছে। তবে আরও অপচয় বন্ধে উৎসাহিত করবে প্রিপেইড মিটার।
তিতাসের আওতাধীন সব এলাকায় প্রিপেইড মিটার স্থাপন করা গেলে আবাসিক পর্যায়ে প্রতিদিন প্রায় ৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস সাশ্রয় হতে পারে বলে উল্লেখ করেন এ বিশেষজ্ঞ।
মিটার স্থাপনের সুফল
২০১৮-১৯ অর্থবছরে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) একটি নিবিড় মূল্যায়ন প্রতিবেদনে প্রিপেইড মিটার স্থাপনের সুফল প্রতিফলিত হয়েছে বলে মনে করছেন অধ্যাপক তামিম। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, এ ধরনের মিটার স্থাপনের পর গ্যাসের পেছনে গ্রাহকের খরচ ৮৭ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পেয়েছে।
তিতাস গ্যাসের প্রিপেইড মিটার প্রকল্পের নিবিড় মূল্যায়ন শেষে ২০১৯ সালে আইএমইডি জানায়, প্রিপেইড মিটার সংযোগের আওতায় থাকা ৩৩টি পরিবারের গ্যাস ব্যবহার ৩৩ ঘনফুট কমেছে।
প্রথম দফায় সংযোগ পাওয়া ৩৩ পরিবারের মাসিক গড় বিল নেমে আসে ৩০০.৩৮ টাকায়, যা ওই সময়ের ডাবল ব্রর্নার গ্যাস লাইন চার্জ ৮০০ টাকার চেয়ে ৬২.৪৫ শতাংশ কম।
বিশ্বব্যাংক তাদের প্রকল্প তথ্য নথিতে বলেছে, সঠিকভাবে মিটার স্থাপনের ফলে গ্যাস সংযোগ ব্যবস্থায় কোথায় এবং কীভাবে লিকেজ হচ্ছে তা নির্ধারণ করা যাবে, এতে বিদ্যমান প্রযুক্তির ব্যবহার করেই গ্যাস খাতের মিথেন নিঃসরণ ও অপচয় ৭০ শতাংশ পর্যন্ত রোধ করা যাবে।
নথিতে আরও উঠে এসেছে, এর মাধ্যমে আবাসিক গ্রাহকরা গ্যাস ব্যবহারের সঠিক মাত্রা জানতে পারবেন এবং সরবরাহকারীদের থেকে গ্যাস লিকের ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া পেতে পারবেন, যা গ্যাসের আরও সচেতন ও খরচ সাশ্রয়ী ব্যবহার নিশ্চিত করবে।
প্রিপেইড মিটার স্থাপনের ফলে গ্যাস বিতরণকারী কোম্পানিগুলোর রাজস্ব কমতে পারে। তবে আইএমইডি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যে পরিমাণ গ্যাস সাশ্রয় হবে তা দিয়ে শিল্পখাতে আরও দুই লাখ উচ্চমূল্যের সংযোগ দিয়ে প্রতি মাসে ৫ কোটি টাকা আয় করতে পারবে তিতাস গ্যাস।
প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব:
বিভিন্ন সূত্র জানাচ্ছে, ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে প্রিপেইড মিটার স্থাপনের কাজ শুরু হয়। কিন্তু, প্রকল্পের ক্রয় ও অনুমোদনে দেরি হয় এলসি নিয়ে জটিলতা এবং ঠিকাদাররা নির্ধারিত সময়ে সরবরাহে ব্যর্থ হওয়ায়।
আইএমইডির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নির্ধারিত সময়ের সাড়ে আট মাস পর মিটার কেনার চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলি আরও জানিয়েছে, গ্যাস লাইনে মরিচা পড়াসহ নানান কারণে মিটার বসানো যাচ্ছে না।
অনেক গ্রাহকও তাদের নিজস্ব খরচে মিটার রাখার বা ছিদ্র হওয়া লাইন মেরামত করতে আগ্রহী ছিলেন না, যার ফলে আরও বিলম্ব হয়।
তবে বুয়েটের অধ্যাপক তামিম বলেন, প্রিপেইড মিটার পাইলট প্রকল্পের সময় ৪৭ শতাংশ রাজস্ব হ্রাসের বিষয়টিও গ্যাস বিতরণকারী সংস্থাগুলিকে নিরুৎসাহিত করে থাকতে পারে।
তিনি আরও বলেছেন, তিতাস মিটার ব্যবহারকারীদের জন্য গ্যাসের দাম কিছুটা বাড়িয়ে এবং শিল্প খাতে গ্যাস সরবরাহ করে এই সমস্যার সমাধান করতে পারে।
তিতাস এবং পিজিসিএল ছাড়াও দেশের অন্যান্য গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলি হলো- কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড, জালালাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম লিমিটেড, বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড এবং সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড।