গ্যাস-বিদ্যুতের অভাবে অনিশ্চয়তায় কুমিল্লা অর্থনৈতিক অঞ্চলের ৮০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ পরিকল্পনা
বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ পেতে বিলম্ব হওয়ায় কুমিল্লা অর্থনৈতিক অঞ্চলে তিনটি বড় কারখানা স্থাপনের জন্য মেঘনা গ্রুপ অভ ইন্ডাস্ট্রিজের (এমজিআই) পরিকল্পিত ৮০০ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ অনিশ্চয়তায় পড়েছে।
এই প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে ৪০০ মিলিয়ন ডলারের ইস্পাত মিল, ২০০ মিলিয়ন ডলারের পেপার মিল ও ২০০ মিলিয়ন ডলারের গ্লাস কারখানা। প্রাথমিকভাবে ২০২৪ সালের প্রথমদিকে কারখানাগুলোতে উৎপাদন শুরু হওয়ার কথা ছিল। এমজিআই বলছে, তারা ইতিমধ্যেই এসব কারখানার সিভিল কাজে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা (প্রায় ২৫০ মিলিয়ন ডলার) বিনিয়োগ করেছে। এই অর্থের বড় একটি অংশই ব্যাংকঋণের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়েছে। কিন্তু উৎপাদন শুরু না হওয়ায় কোম্পানিটিকে ঋণের বিপরীতে চড়া সুদ পরিশোধ করে যেতে হচ্ছে।
গতকাল (২৪ নভেম্বর) রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান বলেন, 'শিল্পকারখানায় গ্যাস সরবরাহকে আমরা অগ্রাধিকার দিচ্ছি। ভোলায় আবিষ্কৃত গ্যাস ব্যবহারের উদ্যোগ নিচ্ছি। গ্যাস আমদানির বিষয়েও কাজ করছি, যা সরবরাহ বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।'
পাওয়ার গ্রিড নেটওয়ার্ক শক্তিশালীকরণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মো. আলমগীর হোসেন টিবিএসকে বলেন, গজারিয়ায় ৬৬০ মেগাওয়াট সাবস্টেশন নির্মাণের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। নভেম্বরের মধ্যেই এটি চালু হওয়ার কথা রয়েছে।
তিনি বলেন, 'প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে এই স্টেশনটির কাজ দ্রুত সম্পন্ন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তাই আমরা বেশ চাপের মধ্যে আছি। সাবস্টেশনটি চালু হলে কুমিল্লা অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা যাবে।'
মেঘনা গ্রুপ অভ ইন্ডাস্ট্রিজের মালিকানাধীন কুমিল্লা অর্থনৈতিক অঞ্চল ২০২২ সালের ২০ মার্চ সরকারের কাছ থেকে চূড়ান্ত অনুমোদন পায়। অনুমোদনের পরপরই তিনটি কারখানার নির্মাণ কাজ শুরু হয়। কিন্তু তবে গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানি অবকাঠামোর অভাবে উচ্চাভিলাষী এই প্রকল্পটি কার্যত থমকে গেছে।
মেঘনা গ্রুপ অপ ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তফা কামাল টিবিএসকে বলেন, 'অনেক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও আমরা কুমিল্লা অর্থনৈতিক অঞ্চলে গ্যাস এবং বিদ্যুৎ সংযোগ নিশ্চিত করতে পারিনি। এ সংযোগগুলো থাকলে কাচ ও স্টিল রি-রোলিং কারখানার উৎপাদন হতো।'
তিনি বলেন, গ্যাস সংযোগের অভাবে অর্থনৈতিক অঞ্চলটি উৎপাদনে যেতে পারছে না। এর ফলে বিদেশি বিনিয়োগও আসছে না।
মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার শেষ সীমানায় ও কুমিল্লার মেঘনা উপজেলায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাছে ২৪৬.৩ একর জমিতে গড়ে উঠেছে এই অর্থনৈতিক অঞ্চল। এ অর্থনৈতিক অঞ্চলের আয়তন ৩৫০ একর পর্যন্ত সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করছে মেঘনা গ্রুপ অভ ইন্ডাস্ট্রিজ।
সাম্প্রতিক এক পরিদর্শনে টিবিএস দেখতে পায়, মেধনা গ্লাস ইন্ডাস্ট্রিজের ভবন নির্মাণকাজ প্রায় শেষ। গ্যাস সংযোগের অপেক্ষায় রয়েছে তারা। প্রশাসনিক ভবন, সংযোগ রাস্তা নির্মাণও শেষ। স্টিল রি-রোলিং মিল তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। এ কারখানার বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা ১.৪ মিলিয়ন টন।
মেঘনা গ্রুপ অভ ইন্ডাস্ট্রিজ বলছে, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ না পাওয়ার কারণে তারা কাজের গতি কমিয়ে দিয়েছে। পণ্য উৎপাদনের জন্য বিদেশ থেকে মেশিনও আমদানি করতে পারছে না।
মেঘনা গ্রুপ অভ ইন্ডাস্ট্রিজের জেনারেল ম্যানেজার (অ্যাকাউন্টস) সুমন ভৌমিক টিবিএসকে বলেন, 'মেঘনা গ্লাস ইন্ডাস্ট্রিজে প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হয়েছে। স্টিল রি-রোলিং মিলের আবকাঠামো নির্মাণে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়া জোনের অবকাঠামো তৈরিতে প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছে। সব বিনিয়োগ আটকে আছে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ না পাওয়াতে।'
বর্তমানে মেঘনা গ্রুপ অভ ইন্ডাস্ট্রিজের অধীনে তিনটি অর্থনৈতিক অঞ্চল রয়েছে। এর মধ্যে মেঘনা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইকোনমিক জোন ও মেঘনা ইকোনমিক জোনে দেশি-বিদেশি শিল্পপণ্য উৎপাদন করা হচ্ছে।
আর কুমিল্লা ইকোনমিক জোন বিনিয়োগকারীদের কাছে হস্তান্তরের জন্য প্রস্তুত অবস্থায় রয়েছে। কিন্তু গ্যাস সংযোগ না থাকায় এখানে বিনিয়োগকারী আসছে না বলে অভিযোগ মেঘনা গ্রুপ অভ ইন্ডাস্ট্রিজের।
মেঘনা গ্রুপ অভ ইন্ডাস্ট্রিজ আরও জানিয়েছে, কুমিল্লা অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজও চলছে।
মেঘনা গ্রুপ অভ ইন্ডাস্ট্রিজ জানিয়েছে, তাদের আরেকটি অর্থনৈতিক অঞ্চল মেঘনা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইকোনমিক জোনে এখন পর্যন্ত প্রায় ১৩টি বিদেশি প্রতিষ্ঠান তাদের শিল্পকারখানা স্থাপন করেছে। একইভাবে কুমিল্লা অর্থনৈতিক অঞ্চলেও এই বিদেশি বিনিয়োগকারীসহ চীন, কম্বোডিয়া, হল্যান্ড ও ভারত থেকে বেশ কিছু বিদেশি বিনিয়োগেকারী শিল্প স্থাপনের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
কিন্তু গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহের অনিশ্চয়তার কারণে বিনিয়োগে আগ্রহী হলেও এসব বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছে মেঘনা গ্রুপ অভ ইন্ডাস্ট্রিজ।
সমস্যা সমাধানের জন্য তারা ইতিমধ্যে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টাদের কাছে একটি চিঠি জমা দিয়েছে।
গ্যাস ও বিদ্যুতের অবকাঠামো
২০১৬ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) প্রাক-যোগ্যতাপত্র দেয় কুমিল্লা অর্থনৈতিক অঞ্চলকে।গ্যাস সরবরাহের লক্ষ্যে কুমিল্লা ইকোনমিক জোন কর্তৃপক্ষ ২০১৮ সালের ১৫ অক্টোবর তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন বরাবর আবেদন করে। এরপর অনেক আলোচনা পর কুমিল্লা ইকোনমিক জোনের জন্য বাখরাবাদ থেকে হরিপুর-মেঘনাঘাট ৪২" পাইপলাইনের ভবেরচর নামক স্থানে নতুন অফ-টেক স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
ওই সিদ্ধান্তের আলোকে কুমিল্লা ইকোনমিক জোন কর্তৃপক্ষ পাইপলাইনের প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণের লক্ষ্যে গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেডের জন্য (জিটিসিএল) জন্য ২০ বিঘা ও তিতাস গ্যাসের জন্য ১৫ বিঘা জমি কেনে।
একইভাবে কুমিল্লা ইকোনমিক জোনে বিদ্যুৎ সরবরাহের লক্ষ্যে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি বাংলাদেশ-এর (পিজিসিবি) চাহিদা মোতাবেক মুন্সীগঞ্জ জেলাধীন গজারিয়ায় ২৩০/১৩২ কেভি গ্রিড উপকেন্দ্র (সাবস্টেশন) নির্মাণের জন্য ২৫ বিঘা জমি কেনা হয়। বর্তমানে সেখানে অবকাঠামোগত ও সিভিল কাজ চলমান রয়েছে।
এছাড়া গ্যাস সংযোগ স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও সারঞ্জমাদি ক্রয় বাবদ প্রায় ৩০০ কোটি টাকা ব্যয় করে কুমিল্লা ইকোনমিক জোন কর্তৃপক্ষ। কিন্তু গ্যাস সংযোগের লক্ষ্যে কোনো সমঝোতা স্মারক (এমইউ) এখনও পর্যন্ত স্বাক্ষরিত হয়নি।
বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন টিবিএসকে বলেন, 'কুমিল্লা ইকোনোমিক জোন যেন দ্রুত গ্যাস সংসযোগ পায়, সে বিষয় বেজা সব পক্ষের সঙ্গে সমন্বয় করছে। আমাদের জাতীয় চাহিদা অনুযাগী গ্যাসের সরবরাহে প্রায় ২৫ শতাংশ ঘাটতি আছে। এছাড়া আমাদের গ্যাস সবরাহের যে পাইলাইন, সেটা অনেক পুরোনো। সার্বিকভাবে বললে, দেশের গ্যাসের যে চাহিদা, সেটা রাতারাতি পূরণ করা সম্বব না—একটু সময় লাগবে।'
তিনি বলেন, আগামীতে অর্থনেতিক অঞ্চল যখন অনুমোদন দেওয়া হবে, তখন অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করা হবে যে তারা তাদের সেবা কতদিনে দিতে পারবে। 'যেমন জ্বালানি মন্ত্রণালয় বলবে যে কতদিনে তারা গ্যাস সংযোগ দিতে পারবে। এর ফলে বিনিয়োগকারীরা একটা পরিষ্কার ধারণা পাবেন। তারা সেই অনুয়ায়ী বিনিয়োগ করবেন।'