তুলার দাম পড়ে গেছে, আগে বেশি দামে কেনা তুলার মজুদ নিয়ে বিপাকে মিলাররা
মাত্র এক বছর আগেও বিশ্বব্যাপী পোশাকের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় কারণে এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চে উঠে গিয়েছিল তুলার দাম। এর ফলে টেক্সটাইল শিল্প রীতিমতো খাবি খাচ্ছিল।
মূল্য আরও বেড়ে গেলে যাতে সেই ধাক্কা সামাল দেওয়া যায়, সেজন্য অনেক শিল্পোদ্যোক্তাই তখন মজুদ বাড়াতে বেশি দামে তুলা কিনে রাখেন।
কাজটি ঝুঁকিপূর্ণ ছিল, কিন্তু অপর বিকল্প ছিল অপেক্ষা করা। কিন্তু বাংলাদেশে হেজিংয়ের প্রচলন নেই বলে দাম আরও বেড়ে যায়। হেজিং মানে ঝুঁকি হ্রাস বা নিয়ন্ত্রণ করা।
বিশ্বজুড়ে মন্দার পূর্বাভাস দেখা দিতেই পরিস্থিতি পাল্টে যায়, কমে যায় তুলার দাম।
আইসিই ফিউচারস ইউএস-এর তথ্য বলছে, কাঁচামালের দাম পাঁচ মাসের ব্যবধানে ৪৯ শতাংশ কমেছে। গত মে মাসে প্রতি পাউন্ড তুলার দাম ছিল ১.৫৫ মার্কিন ডলার, বর্তমানে তা ০.৭৩ ডলার।
এতে স্থানীয় স্পিনিং মিলমালিক ও পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদের স্বস্তি পাওয়ার কথা। কিন্তু স্থানীয় টেক্সটাইল খাতসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, তাদের বেশিরভাগই স্বস্তিতে নেই, বরং বিপুল পরিমাণ লোকসানের আশঙ্কায় রয়েছেন। কারণ বেশি দামে কেনা তুলা এখনও তাদের গুদামে রয়ে গেছে।
লিটল স্টার স্পিনিং মিলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান খোরশদে আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে (টিবিএস) বলেন, 'কেবল তুলার দাম কমে যাওয়ায় পূর্বে বুক করা ও এলসি করার তুলার লোকসান গুণতে হবে প্রায় ১৬ লাখ ডলার।'
এ সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে চলমান গ্যাস সংকটে। গ্যাসের অভাবে উৎপাদন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে উঠেছে। এর ফলে বাধা কাটিয়ে উঠে তুলার দর পতন থেকে সুবিধা নেওয়ার আশা ম্লান হয়ে গেছে।
শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে মিলাররা বলেন, বর্তমানে গ্যাসের তীব্র সংকটের কারণে গ্যাসনির্ভর টেক্সটাইল মিলগুলোর উৎপাদন ৪০ শতাংশে নেমে এসেছে।
এ পরিস্থিতির উন্নতি না হলে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে ৬০ শতাংশ গ্যাসনির্ভর টেক্সটাইল মিল বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিল অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন।
পরিস্থিতির উন্নয়নে তারা সরকারের কাছে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের দাবি জানিয়েছেন এবং তা নিশ্চিত করা গেলে প্রয়োজনে গ্যাসের জন্য তারা কিছুটা বাড়তি টাকা দিতেও রাজি আছেন বলে জানান তিনি।
সমস্যার এখানেই শেষ নয়। বিশ্বব্যাপী পোশাকের চাহিদা কমে যাওয়া ও ডলারের উচ্চমূল্যের কারণে ধেয়ে আসা আসন্ন মন্দায় অনেক টেক্সটাইল কারখানাই বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
তুলার দরপতন হাসি ফোটাতে পারছে না স্পিনারদের মুখে
তৈরি পোশাকের মূল কাঁচামাল তুলার দাম কমে যাওয়া মিলারদের জন্য সুখবর হতে পারেনি।
অন্য সময় হলে এই দরপতনের কারণে স্থানীয় স্পিনিং মিল মালিক ও পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদের মুখে হাসি ফুটত। কিন্তু বৈশ্বিক মন্দার মুখে এতে বলতে গেলে কোনো লাভই হয়নি।
বিশ্ববাজারে অনিশ্চয়তা ও ভবিষ্যতে আরও দাম বাড়ার শঙ্কায় বেশি দামে তুলা কিনে ইয়ার্ন তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু এখন চাহিদা কমে যাওয়ায় বিপুল ইয়ার্ন মজুদ হয়ে আছে।
অন্যদিকে বাড়তি দামে কেনা তুলা দেশে আসছে, যা তাদের লোকসান বাড়াচ্ছে। আবার ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান কমে যাওয়ায় ঋণপত্র (এলসি) খুলতে বাড়তি ব্যয় হচ্ছে। ফলে উৎপাদন খরচও বাড়ছে।
বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তুলা আমদানিকারক। মোট চাহিদার মাত্র ১ শতাংশ তুলা দেশে উৎপাদন হয়। ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল ও আফ্রিকার দেশগুলো আমদানি করা তুলার ওপর নির্ভরশীল বাংলাদেশ।
চুক্তি করার প্রায় ছয় মাস পর তুলার চালান দেশে আসে। অবশ্য ভারত থেকে কিনলে তুলনামূলক দ্রুত পৌঁছায়।
বিটিএমএর সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, 'একে তো আগের বেশি দামে কেনা তুলার ইয়ার্ন বিক্রি না হয়ে জমে আছে, এর মধ্যে একের পর এক তুলার চালান আসছে, যা এ খাতের উদ্যোক্তাদের বিপুল লোকসানে ফেলে দেবে।'
তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, 'ডিসেম্বর পর্যন্ত এভাবে চলতে থাকলে অনেক কারখানা উদ্যোক্তাই দেউলিয়া হয়ে যাবে।'
মালেক স্পিনিং মিলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও বিটিএমএর সাবেক সভাপতি এ মতিন চৌধুরী বলেন, 'বর্তমান তুলার দর কমার এ সুযোগ আমরা নিতে পারছি না। কেননা অনিশ্চয়তার সময় ভবিষ্যতে দাম আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় অনেকেই আগাম বুকিং দিয়ে রেখেছেন, যা তাদের বাড়তি দামেই আমদানি করতে হবে। লোকসানে পড়ে ইতিমধ্যে কিছু কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। আরও বন্ধ হয়ে যাবে, যদি দ্রুত মার্কেট পিক আপ না করে।'
এর সঙ্গে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হওয়ায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। অন্যদিকে ইয়ার্নের চাহিদা কমার কারণে গত তিন মাসে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের অর্ডার বাতিল হয়েছে।
অর্থাৎ প্রাথমিক আলোচনা হওয়ার পর এলসি নিশ্চিত করা হয়নি বলে দাবি করেন অনেক ব্যবসায়ী।
বিটিএমএর সহসভাপতি ও ইশরাক টেক্সটাইল মিলস লিমিটেডের এমডি মো. ফজলুল হক টিবিএসকে বলেন, প্রতি কেজি ইয়ার্নে তার এখন লোকসান গুণতে হচ্ছে ১.৫ ডলার করে।
প্রতিদিন ৬০ টন ইয়ার্ন উৎপাদন করা একটি মিল ৯০ হাজার ডলার লোকসান গুনছে বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, 'এতদিন তুলার দাম কমতে থাকায় ক্রেতাদের বেশিরভাগই অর্ডার হোল্ড করে রেখেছিল। এখন নতুন দাম ধরে পোশাকের দর নেগোশিয়েট করছে এবং আমাদেরও তা মেনে নিতে হচ্ছে। ফলে তুলার দাম কমার সুফল আমাদের পাওয়ার সুযোগ নেই।'
গত ২৮ সেপ্টেম্বর ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, অনলাইন খুচরা বিক্রেতা এএসওএস সম্প্রতি সতর্ক করেছে যে, তারা যা আশা করেছিল তারচেয়ে অনেক কম মুনাফা হবে তাদের।
ফেডারেল রিজার্ভ সুদের হার বাড়িয়ে দেওয়ায় ডলারের দাম বেড়ে গেছে। এতে বিদেশি মিলগুলোকে যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদিত তুলা কিনতে হচ্ছে বেশি দামে। বিটিএমএর তথ্যমতে, বাংলাদেশের মোট তুলার চাহিদার ১১ শতাংশ আমেরিকা থেকে আমদানি করে মেটানো হয়।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও সুদের হার বাড়াচ্ছে। এতে প্রবৃদ্ধি মন্থর হবে এবং শেষতক ভোক্তাদের পোশাক ও অন্যান্য তুলাপণ্যের চাহিদা কমে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।
স্টোনএক্স গ্রুপের ঝুঁকি পরামর্শদাতা ডোনা হিউগস বলেছেন, সুদের হার বৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির কারণে এবং সাধারণ মন্দার আশঙ্কায় ভাবা হচ্ছে, পোশাক ও আসবাবপত্রের পেছনে মানুষ খরচ কমাবে। অন্যদিকে খাদ্য, জ্বালানি ও নিত্যপণ্যের পেছনে ব্যয় বাড়াবে।
এর আঁচ পাওয়া যাচ্ছে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাকের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানেও। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসাব অনুযায়ী, সর্বশেষ সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি কমেছে সাড়ে ৭ শতাংশ।
তুলার দাম কমার সুবিধা পোশাক রপ্তানিকারকরাও নিতে পারবেন না বলে মনে করছেন এ খাতের উদ্যোক্তারা।
কোভিড থেকে উত্তরণের পর্যায়ে বিশ্ববাজারে চাহিদা বাড়তে থাকায় গত বছরের মে থেকে তুলার দামও বাড়তে থাকে।
গ্যাসের জন্য বেশি দাম দিতেও প্রস্তুত
গত জুন মাস থেকে ক্যাপটিভ বিদ্যুতের জন্য ব্যবহার হওয়া প্রতি ঘনফুট গ্যাসের জন্য ১৬ টাকা দাম দিচ্ছেন মিলাররা। এর আগ পর্যন্ত তা ছিল ১৩.৮৫ টাকা।
বিটিএমএ সভাপতি হিসাব করে দেখিয়েছেন, বর্তমানে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি অনুযায়ী পেট্রোবাংলার সরবরাহ করা ৫০০ এমএমসিএফ গ্যাস পাওয়া গেলে এবং স্পট মার্কেট থেকে ২০০ এমএমসিএফ বর্তমান দর অনুযায়ী (প্রতি এমএমবিটিইউ ২৫ ডলার) কেনা হলে প্রতি ঘনফুট গ্যাসের দাম পড়বে প্রায় ২২ টাকা।
বিটিএমএর একাধিক পরিচালক জানিয়েছে, তারা এই পরিমাণ অর্থ দিতে রাজি আছেন।
বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন মূল্য নির্ধারণের আরও চারটি ফর্মুলা দেখিয়েছেন। প্রতি এমএমবিটিইউ গ্যাসের আমদানি মূল্য যদি ৩০ বা ৪০ ডলার হয়, তাহলে প্রতি ঘনফুটের গড় মূল্য পড়বে ২৩ বা ২৫ টাকা।
তিনি জানান, তারা যে হিসাব করেছেন, তা সরকারের কাছে জমা দেবেন।
খোকন বলেন, গ্যাসের বর্তমান চাপে ৯০ শতাংশ কারখানার অবস্থাই খারাপ। ওইসব কারখানা গড়ে ১২ ঘণ্টা করে বন্ধ রাখতে হচ্ছে। মাত্র ১০ শতাংশ কারখানা কিছুটা ভালো আছে।
নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, সাভার, গাজীপুর, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহ পরিস্থিতি সবচেয়ে নাজুক।
এসব এলাকার উৎপাদন গড়ে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশে নেমে এসেছে। এ কারণে প্রতি কেজি ইয়ার্ন উৎপাদনের খরচ ১.২৫ ডলার বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। গ্যাস না থাকলেও স্পিনিং মিলগুলো বন্ধ রাখা যায় না।
এসব কারণে অনেক টেক্সটাইল মিল আগামী কয়েক মাসের মধ্যে দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার আশঙ্কার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, 'কীভাবে ব্যাংকের টাকা শোধ করব? শ্রমিক চাকরি হারাবে, অনেক ব্যাংক রুগ্ণ হয়ে যাবে, আর বিনিয়োগকারীরা রানআউট হয়ে যাবে।'
তিনি বলেন, যদি জ্বালানির নিশ্চয়তা না পাওয়া যায়, তাহলে নিশ্চিতভাবে বিনিয়োগ অপবিনিয়োগ হতে বাধ্য।
হেজিং ভালো বিকল্প
বিশ্বব্যাপী পণ্যমূল্য দ্রুত ওঠানামা করে বলে ক্রেতার ঝুঁকি কমাতে হেজিংয়ের প্রচলন থাকলেও বাংলাদেশে তা নেই। এ বিষয়ে দেশের খুব অল্পসংখ্যক আমদানিকারকদেরই ধারণা আছে।
গত এক বছরের ব্যবধানে বিশ্বের বিভিন্ন বাজারে পণ্যমূল্য অস্বাভাবিক ওঠানামা করায় হেজিং ব্যপকভাবে আলোচনায় এসেছে। কিন্তু হেজিংয়ের অনুমোদন দানকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকও এ-সংক্রান্ত পরিপূর্ণ কোনো ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করেনি।
হেজিং হলো একটি বিনিয়োগ অবস্থান যা দ্বিতীয় বিনিয়োগ থেকে সম্ভাব্য ক্ষতি বা লাভের ভারসাম্য বজায় রাখে। এক্ষেত্রে ঝুঁকি নেয় তৃতীয় পক্ষ, যেমন ব্যাংক।
বাংলাদেশে তুলা আমদানির ক্ষেত্রে একটি প্রতিষ্ঠান হেজিংয়ের সহায়তা নিয়েছিল স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের মাধ্যমে।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন পেতে দেরি হওয়ায় ব্যাংকটি আর এ পথে এগোয়নি।
স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের এমডি নাসির এজাজ বিজয় টিবিএসকে বলেন, 'বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনুমোদন পেতেই ১০ দিনের বেশি সময় লেগে যায়। এই সময়ের মধ্যে দাম অনেক ফ্ল্যাকচুয়েট করে, যার জন্য তুলার একটি চালানে হেজিং করার পর আর করিনি।
'কমোডিটি হেজিং স্ট্রাকচার গড়ে উঠলে হলে হয়তো হেজিং বাংলাদেশে কার্যকর হতো।'
একই কথা বলেছেন এ মতিন চৌধুরী। তিনি বলেন, 'এখনও বাংলাদেশে এর পরিপূর্ণ কাঠামো তৈরি হয়নি। আমদানিকারকরাও সচেতন নন।'
টেক্সটাইল শিল্পে প্রায় এক মিলিয়ন লোকের কর্মসংস্থান রয়েছে এবং মালিকরা গত বছরই নতুন ৩ বিলিয়ন বিনিয়োগ করার পরিকল্পনা প্রস্তুত করেছিলেন।