তৈরি পোশাক খাতে লোকসান কেন হচ্ছে, সামনে কী অপেক্ষা করছে?
বাংলাদেশের বৃহৎ অনেক পোশাক কারখানা উৎপাদন বাড়ালেও, সেক্ষেত্রে মনোযোগ বেশি দেওয়া হয়েছে স্বল্প মূল্যের ব্যাপক উৎপাদনযোগ্য পণ্যে। অপেক্ষাকৃত ছোট কারখানাগুলো চালু রাখতেই হিমশিম খাচ্ছেন মালিকরা, নয় সেগুলো একেবারে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে লোকসানে পরিচালিত হচ্ছে ৪০ শতাংশ পোশাক কারখানা, এই অবস্থায় বাংলাদেশের এই শিল্পের অনিশ্চিত বলেই মনে হচ্ছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম সতর্ক করে বলেছেন, ব্যবসায়ীরা যদি উচ্চ মানের, উচ্চ মুনাফা মার্জিনের পণ্য উৎপাদনের দিকে ঝুঁকতে না পারেন তাহলে সামনের বছরগুলোয় কারখানার সংখ্যা আরো কমে যাবে। এই খাতের ঝুঁকিগুলোর জন্য প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হ্রাস, দুর্বল কৌশল, এবং পণ্য বৈচিত্র্য আনতে চেষ্টার অভাব ও স্বল্প মূল্যের পণ্য উৎপাদনের ওপর অতি-নির্ভরশীলতাকে দায়ী করেছেন তিনি।
তিনি বলেন, 'এমনকী বড় কারখানাগুলো যেগুলো সক্ষমতা সম্প্রসারণ করেছে, তারাও একই কম দামের পণ্য উৎপাদন করেছে। ওভার-ক্যাপাসিটির এই বিষয়টা বায়াররাও জানে।'
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড তৈরি পোশাক (আরএমজি) ও বস্ত্র (টেক্সটাইল) খাতের ১৫ জন উদ্যোক্তার সঙ্গে কথা বলেছে। তাঁদের মধ্যে ৯ জন জানিয়েছেন, তারা এখন লোকসানে কারখানা চালু রেখেছেন। তিনজন ব্রেক ইভেন পয়েন্টে (মোট খরচ ও বিক্রি যখন সমান) অর্ডার নিচ্ছেন, আর দুই জন মুনাফা করলেও আগের তুলনায় তা অর্ধেকের নিচে নেমেছে। কেবল একজন জানিয়েছেন, তার মুনাফা আগের মতই ধরে রাখতে পারছেন।
অর্থাৎ ১৫ জনের মধ্যে ১২ জনই বলছেন, তারা মুনাফায় নেই। লোকসান হচ্ছে, নয়তো মুনাফা কমে গেছে কিংবা কোনমতে খরচ উঠছে। অর্থাৎ, ৮০ শতাংশ কারখানা এখন মুনাফায় নেই।
এর পেছনে বিশ্বব্যাপী পোশাক পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়ায় বাংলাদেশেও অর্ডারের কমতি, স্থানীয়ভাবে গ্যাস-বিদ্যুতের অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধি এবং সরবরাহে ঘাটতি, নতুন মজুরির কারণে উৎপাদন খরচ প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়ে যাওয়া, কম অর্ডারের কারণে দর কষাকষিতে পিছিয়ে যাওয়া, ব্যাক টু ব্যাক এলসি কিংবা ঋণের সীমা বাড়ানোর ক্ষেত্রে ব্যাংকের অনীহা, ব্যাংকের সুদ, পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাওয়া, কাস্টমসে হয়রানি ও বাড়তি খরচ অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন তারা।
উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি এবং অর্ডার কমে যাওয়ার কারণে অনেক পোশাক প্রস্তুতকারক লোকসান দিচ্ছেন নয়তো কোনোরকমে ব্রেক ইভেন পয়েন্টে থাকতে পারছেন। মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার টাকার সাম্প্রতিক অবমূল্যায়ন পোশাক রপ্তানিকারকদের সহায়ক হবে এমনটা আশা করা হলেও – ক্রমবর্ধমান জ্বালানি খরচ, মজুরি বৃদ্ধি কারণে – ঋণ খেলাপি ও কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো আরো খারাপ পরিস্থিতির আশঙ্কা করছেন উদ্যোক্তারা।
বেশ কয়েক বছর ধরেই এসব সমস্যা চলছিল, তবে জুলাইয়ের পর থেকে কিছু ঘটনাপ্রবাহ ও নিয়ন্ত্রক পদক্ষেপের কারণে তার আরো অবনতি হয়েছে। এসব সমস্যার সমাধান নাহলে পোশাক শিল্পে নতুন ঋণ খেলাপি তৈরি হবে, তাতে রপ্তানি আয় ও কর্মসংস্থানে পতন দেখা দিবে বলে সতর্ক করেন শিল্পের অভ্যন্তরীণ ব্যক্তি ও বাণিজ্য বিশ্লেষকরা।
কারখানা বন্ধ হচ্ছে
গত জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যূত্থান পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ এবং গত তিন সপ্তাহের বেশি সময় ধরে গাজীপুর, সাভারের কিছু এলাকায় শ্রম অসন্তোষ শিল্পকে নতুন করে কঠিন পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে আগামী মাসে বেতন পরিশোধে কিছু কারখানা সমস্যায় পড়তে পারে, যা নতুন করে অসন্তোষ উস্কে দেবে বলে আশঙ্কাও করা হচ্ছে।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, গত ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পোশাক কারখানাসহ ৭০টি শিল্প আগস্ট মাসের বেতন দিতে পারেনি।
পোশাক শিল্পের দুই সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) এবং বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গত দুই বছরে উভয় সংগঠনের সদস্য প্রায় ২৫০টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এই সময়ে কিছু কারকানা নতুন করে উৎপাদনে আসলেও – তা বন্ধ হওয়া কারখানার তুলনায় একেবারেই কম বলে জানিয়েছেন দুই সংগঠনের নেতারা।
শুধুমাত্র গত দুই সপ্তাহে, ক্রনি গ্রুপ এবং বার্ডস গ্রুপের মতো প্রধান গ্রুপগুলো তাদের কারখানা বন্ধ করে দিয়েছে, যা পরিস্থিতির তীব্রতাকেই তুলে ধরছে।
একইভাবে, ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত অ্যাডামস অ্যাপারেলস লিমিটেড এবং অ্যাডামস স্টাইলসের মালিকপক্ষ অর্ডার কমতে থাকায়, ব্যাংকের দায়দেনা বাড়তে থাকায় চলতি বছরের শুরুর দিকে একটি কারখানা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন।
কারখানাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শহিদুল হক মুকুল বলেন, 'কোভিড-১৯ থেকেই সমস্যার শুরু। এর পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ… অর্ডার কমতে থাকে। ব্যাংকের সাপোর্ট পাচ্ছিলাম না। কাস্টমসের হয়রানি ছিল – এসবের সাথে কুলিয়ে উঠতে না পেরে এক পর্যায়ে বেতন বকেয়া হয়ে যায়। পরে বাধ্য হয়ে উৎপাদন ছোট করে আনতে হয়।'
হারাচ্ছে মুনাফাযোগ্যতা
কেবল ছোট পুঁজির কারখানা নয়, অপেক্ষাকৃত বড় কারখানাও বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছে এমনকি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। ইউটিলিটি সংকট ও অর্ডার কমতে থাকায় অনেকেই লোকসান দিতে শুরু করেছে।
রাজধানীর অদূরে নারায়ণগঞ্জে ফতুল্লাহ অ্যাপারেলস লিমিটেড ২০২৩-২৪ অর্থবছরে লোকসান গুনেছে ৩ কোটি ৬২ লাখ টাকা। কারণ উৎপাদনের খরচ বাড়লেও – বায়াররা যে দামের প্রস্তাব দিচ্ছে, তাতে মুনাফা দুরে থাক, খরচও পোষাচ্ছে না। এতে একের পর এক অর্ডার মিস করতে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। যার কারণে লোকসান গুনতে হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফজলে শামীম এহসান বলেন, 'এই সময়ে ডলারের বিপরীতে টাকা ডিভ্যালুয়েশন (অবমূল্যায়ন) হওয়ার ফলে প্রাপ্ত গেইন এবং সরকারের ইনসেনটিভ (প্রণোদনা) ক্যালকুলেশন করার পরও লোকসানের এই অঙ্ক দাঁড়িয়েছে।'
একই মালিকের ফতুল্লাহ ডায়িং লিমিটেড নামে আরেকটি কারখানা আলোচ্য সময়ে লোকসান করেছে সাড়ে ৭ কোটি টাকা। এর কারণ হিসেবে এহসান জানিয়েছেন, গ্যাসের (ডায়িংয়ে প্রচুর গ্যাসের প্রয়োজন হয়) দর বেড়েছে, কিন্তু সাপ্লাই কম ছিল। ফলে অর্ধেকের কম ক্যাপাসিটিতে কারখানা চালু রাখতে হয়েছে।
পড়তি দশা দেখছেন ব্যাংকাররাও
পোশাক রপ্তানির ব্যাক টু ব্যাক এলসি বা কাঁচামাল আমদানির প্রক্রিয়ায় জড়িত ব্যাংকাররাও সাম্প্রতিক সময়ে পোশাক প্রস্তুতকারকদের মুনাফায় পতনের কথা জানিয়েছেন।
রাজধানী ঢাকায় সিটি ব্যাংকের একটি প্রধান শাখার শীর্ষ এক কর্মকর্তা, যিনি পাঁচটি বড় রপ্তানিকারক গোষ্ঠীর এলসি ব্যবস্থাপনায় জড়িত তিনিও সাম্প্রতিক সময়ের শ্রম অসন্তোষের কারণে এরমধ্যে তিনটি ব্যবসাই প্রভাবিত হয়েছে বলে জানিয়েছেন।
নাম না প্রকাশের শর্তে ওই কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, 'অর্ডারের ফ্লো কম থাকায় মুদ্রা অবমূল্যায়নের সুবিধা নিচ্ছে বায়াররা।'
তিনি আরো বলেন, 'শ্রম অসন্তোষের কারণে একটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান সম্প্রতি সমস্যার মুখে পড়ে। এরকম বেশকিছু প্রতিষ্ঠান সময়মতো রপ্তানি চালান পাঠাতে না পারায়– ব্যাংকের কাছে তাদের দায়দেনা বেড়ে গেছে।
আইএফআইসি ব্যাংকের উত্তরা শাখার একজন কর্মকর্তাও সাম্প্রতিক সময়ে কিছু কারখানার দায় বেড়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন। যেমন একটি কারখানা সময়মতো কিস্তি দিতে ব্যর্থ হওয়ায়– তাঁদের বিরুদ্ধে ফোর্সড লোন জারি করতে হয়েছে।
'অথচ এই ১০টি কারখানা দুই বছর আগেও কখনো এমন পরিস্থিতির মধ্যে পড়েনি' - যোগ করেন তিনি।
কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, 'আমি যতদূর জানি, মুদ্রার অবনমনের বেশিরভাগ সুবিধাটাই যাচ্ছে বায়ারদের পকেটে। ফলে এর সুবিধা নিয়ে বেড়ে যাওয়া উৎপাদন ব্যয় পুষিয়ে নিতে পারছেন না গার্মেন্টস ব্যবসায়ীরা।'
বেশকিছু কারখানার ব্যাংকের দেনা বাড়ার কথা তিনিও উল্লেখ করেছেন।
পূর্ণ সক্ষমতায় কারখানা চালু রাখতে না পারায় পোশাক উৎপাদকদের মুনাফাযোগ্যতা হ্রাস পেয়েছে বলে মনে করছেন মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। তার মতে, এই পরিস্থিতিতে যাদের ব্যাংক ঋণ বেশি তারা অনেকখানি ঝুঁকির মধ্যে আছে।
কমছে মুনাফা
দেশের শীর্ষ একজন পোশাক রপ্তানিকারক নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, 'সাধারণত পোশাক কারখানায় বিনিয়োগের রিটার্ন হিসাব করা হয় তিন থেকে চার বছর ধরে নিয়ে, আর নিট প্রফিট মার্জিন ধরা হয় ৬ থেকে ৯ শতাংশ। এক সময় আমরাও এই হারে প্রফিট (মুনাফা) করতেও পারতাম। কিন্তু, বর্তমানে কেউই এই হারে প্রফিট করতে পারছে বলে মনে হয় না।'
'আমার প্রফিট নেমে এসেছে ২.৫ শতাংশে' –বলেন ১৫ হাজার শ্রমিকের ওই কারখানার মালিক।
অবশ্য মাত্র ৪৫০ জন শ্রমিকের একটি কারখানা, যারা উচ্চ মানের পণ্য তৈরি করে – এমন একটি কারখানার উদ্যোক্তা জানালেন, তার মুনাফাযোগ্যতা একই রয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে তিনি বলেন, 'আমি কিছু ব্যতিক্রমী পোশাক তৈরি করি অপেক্ষাকৃত উচ্চ মূল্যের। আমার ক্রেতা্রাও বাড়তি কস্ট অব প্রোডাকশন (উৎপাদন খরচ) হিসাব করেই দর দিচ্ছেন।'
উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে ৫০ শতাংশ
পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, গত দুই বছরে উৎপাদন খরচ বেড়েছে ৫০ শতাংশ, আবার একই সময়ে দর না বেড়ে কোন কোন ক্ষেত্রে কমেছে। কিছু কারখানা এই লোকসান পোষাচ্ছে মুদ্রার অবমূল্যায়ন ও সরকারের কাছ থেকে পাওয়া প্রণোদনার টাকায়। তবে গত জুলাই থেকে কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে।
গত এক মাস থেকে গাজীপুর, সাভারের কারখানাগুলো শ্রম অসন্তোষের জেরে বেশিরভাগ সময় উৎপাদন করতে পারেনি। এর সঙ্গে টিফিন বিলসহ কিছু এল্যাউন্স যুক্ত হয়েছে। নতুন করে আলোচনা হচ্ছে মজুরি বৃদ্ধির।
বিকেএমইএ'র সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, 'এই সেক্টরে আমার ৩৬ বছরে বিভিন্ন কঠিন সময় পার করেছি। তবে বর্তমানের মত এত কঠিন পরিস্থিতি আর দেখিনি।'
চট্টগ্রাম-ভিত্তিক এইচকেসি অ্যাপারেলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাকিবুল আলম চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, 'অর্ডার ৩০ শতাংশ কম। লোকসান হচ্ছে, তবুও অর্ডার নিতে হচ্ছে। এ অবস্থায় শ্রমিকের মজুরি, ইউটিলিটি বিল দেওয়ার জন্য ব্যাংক থেকে ঋণ করতে হচ্ছে। ফলে ব্যাংকে দায় বাড়ছে।'
ঋণ খেলাপি হওয়ার আশঙ্কা
উদ্যোক্তাদের বেশিরভাগই জানিয়েছেন, ব্যাংকে তাদের দায় বাড়ছে। পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি নাহলে— আগামী মাসগুলোতে একদিকে শ্রমিকের বেতনের চাপ বাড়বে, অন্যদিকে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়তে পারে। ফলে দ্বিমুখী চাপ তৈরি হয়ে খেলাপির সংখ্যা বাড়তে পারে।
মোহাম্মদ হাতেম বলেন, এতদিন নিয়ম ছিল কেউ ৬টি কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলে খেলাপি হতো। সেপ্টেম্বর থেকে ৩ কিস্তি শোধে ব্যর্থ হলে খেলাপি হিসেবে গণ্য হবেন।'
'সামনে কঠিন সময় অপেক্ষা করছে' –জানিয়ে তিনি বলেন , ' আমিও হয়তো খেলাপিতে পরিণত হতে পারি।'
টেক্সটাইল খাতের উদ্যোক্তাদের পরিস্থিতিও একই রকম। বিশেষত গ্যাস সংকটের কারণে এই খাত বিপাকে পড়েছে বেশি। আবার কেউ কেউ লোকাল ব্যাক টু ব্যাক এলসি'র বিপরীতে ব্যাংকের কাছ থেকে টাকা পাচ্ছেন না।
মিথেলা টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান আজাহার খান তার উদ্বেগের কথা জানিয়ে টিবিএসকে বলেন, 'ব্যাংকের কাছ থেকে টাকা না পেলে আগামী মাসে বেতন কীভাবে দেব জানি না। অসন্তোষ বাড়ে কিনা বুঝতে পারছি না।'
তিনি বলেন, "গ্যাস সংকটের কারণে আমার কারখানা লাইফ সাপোর্টে আছে।"
ফারিহা স্পিনিং মিলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনির হোসেন আরেকটি ভিন্ন তবে একইরকম গুরুতর সমস্যার কথা জানান। তিনি বলেন, 'লোকাল ব্যাক টু ব্যাক এলসি করার পর বায়ারের অনুমোদন পাওয়ার পরেও ব্যাংক আমার টাকা শোধ করছে না। আমার ৫ মিলিয়ন ডলার আটকে আছে। এজন্য গ্যাস বিল শোধ করতে পারছি না। আবার রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) এর আওতায় নেওয়া ঋণের অর্থ শোধ করতে পারছি না, যার সুদের হার ৫ থেকে ৬ শতাংশ, সময়মতো ইডিএফের লোন শোধ না করতে পারলে সুদের রেগুলার রেট হয়ে যাবে।'
'এভাবে চলতে থাকলে ৬ মাস পর ঋণের বোঝা নিয়ে মিলে তালা মারতে হবে। ৪০ বছরের উদ্যোক্তা জীবনে এমন পরিস্থিতি দেখিনি" –বলেন তিনি।
ন্যায্য বাজারমূল্যের চেয়েও কম
ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনার বিবেচনা করে অনেক উদ্যোক্তাই উৎপাদন সক্ষমতা বাড়িয়েছেন ব্যাপকভাবে। কিন্তু, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর অর্ডার কমতে থাকলে— লোকসান কমাতে গিয়ে ন্যায্য দরের চেয়েও কম দরে অর্ডার নেওয়ার প্রতিযোগিতায় নামেন তাদের অনেকে।
অ্যামিটি ফ্যাশনস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শেহাবুদ্দোজা চৌধুরী বলেন, 'অর্ডার ধরার জন্য আমরা নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু করলাম। এর ফলে ক্রেতা দেখছে দর কমিয়েও অর্ডার দেওয়া যাচ্ছে এবং এই সুযোগ তারা নিচ্ছে।'
টিবিএস যে ১৫ উদ্যোক্তার সাথে আলাপ করেছে তাঁদের মধ্যে অন্তত ১০ জন এতে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা জানিয়েছেন। ফলে যারা দামে ছাড় দিতে রাজি ছিলেন না, তারা অর্ডার হারিয়েছেন। আর অন্যরা উৎপাদন ব্যয়ের চেয়েও কম দরে অর্ডার নিয়ে এই খাতে অসুস্থ প্রতিযোগিতার পরিস্থিতি তৈরি করলেন।
মুদ্রার অবমূল্যায়নের সুবিধা বায়ারদের পকেটে?
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, পোশাক রপ্তানিকারকদের কিছু সমস্যা সম্প্রতি বেড়েছে।
তিনি বলেন, 'দুই বছরে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার মান অবনমন হয়েছে ৩৫ শতাংশ। এই সুবিধা পাওয়ার পরও কেন রপ্তানিকারকরা খারাপ অবস্থায় যাবে? তাহলে এই সুবিধা কি বিদেশী বায়ারের পকেটে যাচ্ছে?'
এই অবস্থায়, বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের দর কষাকষির সক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়ে মনযোগী হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ ও গবেষণা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র্যাপিড) চেয়ারম্যান এম এ রাজ্জাক মনে করেন, বিশ্বব্যাপী পোশাকের চাহিদা কমে যাওয়ায় এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
তিনি বলেন, 'রপ্তানি যে কেবল বাংলাদেশের কমেছে, তা নয়। অন্যান্য প্রতিযোগী দেশেরও কমেছে। তবে আমাদের বেশি হারে কমেছে।'