রপ্তানি মন্দার আশঙ্কা চামড়া ও চামড়াজাত শিল্পে
করোনা পরবর্তী বৈশ্বিক মন্দা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশসমূহে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় রপ্তানি নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য উৎপাদক ও রপ্তানিকারকরা।
মূল্যস্ফীতির কারণে রপ্তানি ডেসটিনেশনে চামড়ার মতো বিলাসবহুল পণ্য কেনাকাটা কমে যাওয়া, উচ্চ উৎপাদন ব্যয় ও ক্রয়াদেশ সংকুচিত হওয়ার কথাও বলছেন উদ্যোক্তারা।
এই অবস্থায় রপ্তানিতে প্রতিযোগী ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, ভারত ও ব্রাজিলের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে চামড়া ও পাদুকা শিল্পখাতের রপ্তানিকারকদের সক্ষমতা বৃদ্ধি জরুরী বলে মনে করছেন তারা।
পোশাক শিল্পের মতো চামড়া ও পাদুকা শিল্পখাতের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে উন্নয়ন প্রকল্প প্রোগ্রাম টু সাপোর্ট সেফটি রেট্রোফিটস অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল আপগ্রেডস (এসআরইইউপি) অন্তর্ভূক্ত করার দাবি জানিয়েছে লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফেকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ।
এই প্রকল্পে সংগঠনটির সদস্যদের অর্ন্তভূক্তকরণে গত অক্টোবরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে চামড়া ও পাদুকা শিল্পখাতের উদ্যোক্তারা।
চিঠিতে বলা হয়, বছরের শেষ তিন মাসে চামড়ার মতো বিলাসবহুল পণ্য কেনাকাটা যুক্তরাজ্যে ২২%, স্পেনে ১৪%, ইতালিতে ১২% এবং ফ্রান্স ও জার্মানিতে ১১% হ্রাস পাবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
মূলত, বৈশ্বিক কমপ্লায়েন্স অর্জনে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে সহজে অর্থের সংস্থানে এই প্রকল্পে অন্তর্ভূক্ত হতে চায় এই খাতের উদ্যোক্তারা।
২০১৯ সাল থেকে বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী ও সরকারের সহায়তায় পোশাক খাতের নিরাপত্তাজনিত সংস্কার ও পরিবেশগত উন্নয়ন প্রকল্প এসআরইইউপি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
সরকারের এই উদ্যোগ বস্ত্রখাতকে পরিবেশবান্ধব করে রপ্তানিকারকদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে বড় ভূমিকা রাখছে জানিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে দেওয়া চিঠিতে সংগঠনটির সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেছেন, বস্ত্রখাত এবং চামড়াজাত ও পাদুকা শিল্পের প্রধান রপ্তানি গন্তব্য একই। অভিন্ন ক্রেতা, ব্র্যান্ড এবং প্রতিনিয়ত একই ধরনের কমপ্লায়েন্স চাপ নিয়ে পণ্য রপ্তানি করতে হয় এ খাতগুলোকে।
এপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের এই ম্যানেজিং ডিরেক্টর বলেন, "চামড়া ও পাদুকা শিল্পখাতকে উক্ত সহজশর্তে (৫% সুদহার), দ্রুত ও দীর্ঘমেয়াদী তহবিলে অন্তর্ভূক্ত করা হয়নি।"
বৈশ্বিক কমপ্লায়েন্স অনুসরণ জোরদার ও আন্তজার্তিকভাবে প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা বৃদ্ধিতে এসআরইইউপি প্রকল্পে এই খাতের উদ্যোক্তাদের অন্তর্ভুক্ত করতে তিনটি কারণ তুলে ধরেন তিনি।
এ প্রকল্পে অন্তর্ভূক্ত করার দাবি জানিয়ে চিঠিতে বলা হয়, "বস্ত্রখাত এবং চামড়াজাত ও পাদুকা শিল্প ইউরোপ, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য বাজারগুলোতে পণ্য রপ্তানি করে। বস্ত্রের মতোই দীর্ঘ লিড টাইম, চড়া খরচ, ফ্যাশন পণ্যে ভোক্তা চাহিদা হ্রাস, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধদ্ভুত বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতি, রপ্তানি গন্তব্যে উচ্চ সুদের হার ও সার্বিক ব্যবসায়িক ধীরগতির চ্যালেঞ্জে চামড়াজাত ও পাদুকা শিল্প খাত।"
চিঠিতে আরো বলা হয়, "লেদার সেক্টর বিজনেস প্রমোশন কাউন্সিলের সহযোগিতায় অ্যাসোসিয়েশন ইতোমধ্যে চামড়াজাত পণ্য ও জুতা কারখানায় বৈদ্যুতিক মূল্যায়ন ও বিপদ চিহ্নিত করে তা প্রশমনের নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু এসব কমপ্লায়েন্স অর্জনে অবকাঠামোগত উন্নয়নে যে বাড়তি বিনিয়োগ প্রয়োজন, সেটা যোগান দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।"
নাসিম মঞ্জুর বলেন, "এসআরইইউপি এর চলমান প্রকল্পে চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকা শিল্পকে অন্তর্ভুক্ত করলে তহবিল থেকে ঋণ নিয়ে কারখানা সংস্কার ও মানোন্নয়নে আরও বেশি কারখানা এগিয়ে আসবে।"
তিনি আরো বলেন, "সংস্কার কাজে অর্থায়ন করা অপেক্ষাকৃত মাঝারি ও ক্ষুদ্র কারখানাগুলোর জন্য যথেষ্ট কষ্টকর। ঋণ আবেদন ও অনুমোদনে দীর্ঘপ্রকৃয়া, উচ্চ ও অনাকর্ষণীয় সুদ হারের কারণে বিভিন্ন নিরাপত্তা উদ্যোগ চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। এই ক্ষেত্রে এই প্রকল্পে অন্তর্ভূক্ত করার মাধ্যমে কারখানাগুলোকে টেকসই অর্থায়নে সহায়তা ও প্রয়োগিক সক্ষমতা তৈরীর ব্যবস্থা করলে বিশ্ববাজারে এই শিল্প আরও শক্তিশালী হবে।"
চামড়া এবং চামড়াজাত পণ্য রপ্তানির চিত্র
ইপিবির তথ্যানুযায়ী, ২০১০ সালের পর থেকে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি ধারাবাহিকভাবে বাড়ছিল। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে রপ্তানির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১.২৩ বিলিয়ন ডলারে।
এরপর থেকে পরপর তিনবছর চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানির পরিমাণ কমেছে।
২০১৮-১৯ সালে এ খাত থেকে রপ্তানি আয় কমে দাঁড়ায় ১.০২ বিলিয়ন ডলারে। করোনা মহামারির সময় ২০১৯-২০ অর্থবছরে এই খাত থেকে রপ্তানি আয় কমে দাঁড়ায় ৭৯৭.৬ মিলিয়ন ডলারে।
তবে ২০২০-২১ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত দ্রব্যের রপ্তানির পরিমাণ আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৮% শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় ৯৪১.৬ মিলিয়ন ডলার।
২০২১-২২ অর্থবছরে এ খাত থেকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে রেকর্ড হয়। ওইবছর এই খাতে মোট রপ্তানি ছিল ১.২৫ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের চেয়ে ৩২% বেশি।
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরেও ঊর্ধ্বমুখী ধারায় চামড়া ও চামড়াজাত দ্রব্য রপ্তানি।
এই বছরের জুলাই-অক্টোবর মাসে চামড়া রপ্তানি ১৭% বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সময়ে পণ্য রপ্তানি হয়েছে ৪২৮.৫ মিলিয়ন ডলারের, যা গত অর্থবছরের একই সময় ছিল ৩৬৪.৯ মিলিয়ন ডলার।
গ্র্যান্ড ভিউ রিসার্চের একটি নতুন প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২৮ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী চামড়াজাত পণ্যের বাজারের আকার ৬২৪.০৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারে।
গ্লোবাল বিজনেস ডেটা প্ল্যাটফর্ম স্ট্যাটিস্টার হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালে রপ্তানিকৃত চামড়াজাত পণ্যের বৈশ্বিক রপ্তানি মূল্যের ৩০.৩ শতাংশই ছিল চীনের দখলে, যা তাদেরকে শীর্ষস্থানীয় লেদার রপ্তানিকারক হিসেবে পরিণত করেছে।
একই সময়ে বৈশ্বিক রপ্তানি বাজারে ইতালি এবং ফ্রান্সের অংশ ছিল যথাক্রমে ১৭.৮% ও ১৪.৮%।
অন্যান্য এশীয় দেশ, যেমন ভিয়েতনাম এবং ভারতেরও বৈশ্বিক রপ্তানি বাজারে একটি অংশ ছিল। ভিয়েতনামের ছিল ৬.৪% এবং ভারতের ২.৬%।