বেসরকারি খাতে বৈদেশিক ঋণের বোঝা বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগের বিষয়: আইএমএফ
বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে বেসকারি খাতে বিদেশি ঋণ বাংলাদেশের জন্য চাপ বাড়াবে বলে মনে করছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)।
সংস্থাটির মতে, সরকারি খাতের ঋণের পাশাপাশি বেসরকারি খাতের ঋণও ডলারে পরিশোধ করতে হবে।
সোমবার অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে আইএমএফ বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণ নিয়ে এই উদ্বেগ জানায়।
ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, আইএমএফ মনে করছে, এখন সরকারি খাতে বিদেশি ঋণ এবং রাষ্ট্রয়াত্ব প্রতিষ্ঠানের যে ঋণ, তা থাকলে বাংলাদেশ ঋণ পরিশোধে কোনো সমস্যায় পড়তো না।
কিন্ত বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণ পরিশোধের কারণে ডলারের সংকট বাড়াবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ৫ বছরে দ্বিগুণ হয়ে বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণ ২০২২ সালের জুনে ২৫.৯৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।
ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ এর জুন পর্যন্ত সরকারের নেওয়া বিদেশি ঋণের আউটস্ট্যান্ডিং ৫৬ বিলিয়ন ডলার।
এছাড়া বিভিন্ন রাষ্ট্রয়ত্ব প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ রয়েছে প্রায় ১৬.৭৪ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশে আইএমএফ এর মিশন চিফ রাহুন আনন্দের নেতৃত্বে চার সদস্যের প্রতিনিধি দল বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন। এসময় ইআরডি সচিব শরিফা খান, অতিরিক্ত সচিব আবদুল বাকি, মো. মোস্তাফিজুর রহমানসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
বর্তমান ৪.৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণ আলোচনা অংশ হিসেবে আইএমএফর সঙ্গে ইআরডি এই বৈঠক হয়।
গত মাসের শেষ সপ্তাহে ১৫ দিনের সফরে আসে আইএমএফ প্রতিনিধি দল। দলটি, ইতোমধ্যে বাংলাদেশে ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব রোর্ড, অর্থ বিভাগ, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, বিদ্যুৎ বিভাগ, জ্বালানি বিভাগ, পেট্রোবাংলাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে বৈঠক করেছে।
এর আগে ৩১ অক্টোবর ইআরডির সঙ্গে আইএমএফর আরেকটি বৈঠক হয়। সেখানে বৈদেশিক ঋণের বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য চেয়েছিল সংস্থাটি।
আইএমএফ প্রতিনিধি দল ঋণ পরিশোধের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে বৈঠকে। ওই সময়, আগামী কয়েক বছরের ডেবট সার্ভিং এর প্রাক্কলনসহ বিভিন্ন তথ্য নিয়েছে আইএমএফ।
আসন্ন মন্দা পরিস্থিতিতে ঋণ পরিশোধে বাংলাদেশের সক্ষমতা নিয়ে আলোচনা করেছে প্রতিনিধি দল।
ডলারের মূল বৃদ্ধি, লাইনবার, এবং এসওএফআর রেট বেড়ে যাওয়ায় ঋণ পরিশোধে তা কেমন প্রভাব ফেলেছে , সে বিষয়ে জানতে চেয়েছিল সংস্থাটি।
নমনীয় ঋণ, বাণিজ্যিক ঋণ, রাষ্ট্রায়ত্ব প্রতিষ্ঠানগুলোর বর্তমান ঋণের পরিমাণ এবং ভবিষ্যৎ প্রাক্কলনের তথ্যও সংস্থাটি নিয়েছে বলে জানান ইআরডির কর্মকর্তারা।
গত সপ্তাহে ইআরডির সঙ্গে অনুষ্ঠিত মিটিংয়ে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে বাংলাদেশের চাপ বাড়বে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল আইএমএফ।
আইএমএফের মতে, বর্তমান বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতে বাংলাদেশে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় কমে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। আর এর প্রভাব পড়বে ঋণ পরিশোধে।
আইএমএফ-এর মতে, জিডিপি অনুপাতে বৈদেশিক ঋণের কম হলেও বিশ্বপরিস্থিতির কারণে ঋণ পরিশোধে কিছুটা সতর্ক হওয়ার সময় এসেছে।
ইআরডির তথ্য অনুযায়ী তিন অর্থবছরের বাংলাদেশ যথাক্রমে পরিশোধ করতে হবে ২.৭৭ বিলিয়ন ডলার, ৩.৩ বিলিয়ন ডলার এবং ৪.০২ বিলিয়ন ডলার।
২০২১-২২ অর্থবছরে সরকার বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাকে মোট ২ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করেছে।
এদিকে, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ ব্যয়বহুল হচ্ছে। বেশিরভাগ বৈদেশিক ঋণের সুদহার ২ শতাংশ ছাড়িয়েছে। এ অবস্থায় ঋণের বিষয়ে কিছুটা সতর্ক হওয়া দরকার বলে মনে করছে আইএমএফ।
বিডার সঙ্গে বৈঠকে আইএমএফ
অন্য একটি বৈঠকে, আইএমএফ প্রতিনিধি দল গতকাল বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) কাছে বিনিয়োগের পরিবেশ, বিনিয়োগ খাতের পরিস্থিতি এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চেয়েছে।
বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান লোকমান হোসেন মিয়ার উপস্থিতিতে বৈঠকে আইএমএফ বাংলাদেশ সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) বাড়ানোর জন্য কী পদক্ষেপ নিয়েছে এবং পরিবেশবান্ধব কমপ্লায়েন্ট কারখানা নির্মাণে কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে তাও জানতে চায়।
তারা নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিষয়ে বাংলাদেশের নীতিরও পর্যালোচনা করেন।
রাহুল আনন্দের নেতৃত্বে আইএমএফ মিশনে সংস্থাটির ম্যাক্রোফাইনান্সিয়াল ইউনিটের (কৌশল, নীতি, এবং পর্যালোচনা বিভাগ) অর্থনীতিবিদ রিচার্ড ভার্গিসসহ আরও ছয়জন ছিলেন, যারা বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেপজা) এবং বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) এর প্রতিনিধিদের সাথেও সাক্ষাৎ করেছেন।
বৈঠক শেষে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান লোকমান হোসেন মিয়া টিবিএসকে বলেন, আইএমএফ বাংলাদেশের গৃহীত পদক্ষেপে সন্তোষ প্রকাশ করেছে।
তিনি বলেন, প্রতিনিধি দলকে জানানো হয়েছিল যে বাংলাদেশে এফডিআই বাড়ছে এবং গত বছরের ৩ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২৫ সালে তা প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে।
লোকমান বলেন, আইএমএফ দলকে বাংলাদেশের বিভিন্ন সাফল্য সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছে - ১০০টি নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল, নিজস্ব তহবিল দিয়ে নির্মিত পদ্মা সেতু এবং মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি ইত্যাদি - এবং 'বিনিয়োগের স্বর্গ' হিসেবে দেশের অবস্থান তুলে ধরা হয়েছিল।
"আমরা প্রস্তাব দিয়েছিলাম যে আইএমএফ বাংলাদেশের সাফল্যকে [বিদেশি মিডিয়াতে] প্রচার করবে। তারা বলেছে তারা বিবেচনা করবে," যোগ করেন তিনি।