গ্রামীণ জীবনযাত্রা বদলে দিচ্ছে গ্রোথ সেন্টার
বগুড়া জেলার শেরপুরের রানীরহাট এলাকার বাসিন্দা ৪৩ বছরের স্বপন কুমার মণ্ডল। ২৩ বছর আগে কাজ শুরু করেন তার বাবার গড়া দোকানে। সেই দোকানে মিলত শুধু নির্দিষ্ট কিছু মুদিপণ্য। বর্তমানে তিনি দোকানের বাড়তি আয়ে সাত বিঘা ধানী জমি কিনেছেন। তিনজন কর্মচারী বর্তমানে তার ব্যবসার দেখাশোনা করছে।
স্বপনের দোকানের পাশেই এলজিইডির তৈরি পাকা সড়ক। সেদিকে ইঙ্গিত করে স্বপন জানান, এই সড়কই তারসহ এই এলাকার অনেক মানুষের ভাগ্য বদলে দিয়েছে। গ্রামীণ অর্থনীতি শক্তিশালীকরণে গ্রোথ সেন্টার নির্মাণের অংশ হিসেবে এই সড়কটি নির্মিত হয়। পরিকল্পনাটিকে এপর্যন্ত সফলই বলা যায়। সরকার এখন এধরনের আরও গ্রামীণ অর্থনৈতিক উন্নয়ন কেন্দ্র নির্মাণ এবং কিছু গ্রোথ সেন্টারকে টাউনশিপ বা ছোট শহরে রুপান্তরের পরিকল্পনা করছে।
গ্রামীণ এলাকা বদলে দিচ্ছে- 'আমার গ্রাম আমার শহর' প্রকল্প
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)- এর আওতাধীন 'আমার গ্রাম আমার প্রকল্পের' ছোঁয়ায় এ বাজারের পরিবর্তনের গতি নতুন মাত্রা লাভ করে।
গ্রামীণ হাটগুলিকে আমূল বদলে- গ্রামীণ গ্রোথ সেন্টার বা অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে– নারী বিক্রেতাদের জন্য নির্ধারিত চারটি স্টল; মাছ, মাংস, সবজির আলাদা আলাদা দোকান; একটি কসাইখানা, সুপেয় পানির জন্য একটি টিউবওয়েল, বৈদ্যুতিক পাম্প ও পানির ট্যাঙ্ক ইত্যাদি গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। হাটের ভেতর আরও থাকছে কংক্রিটের পেভমেন্ট; নারী ও পুরুষের জন্য পৃথক টয়লেট। এসব উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য আনয়ন ও তার মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টির আশা করছে সরকার।
গ্রোথ সেন্টার হবে ৭০০ হাট-বাজার
নতুন ভাবে তালিকাভুক্ত ৮ হাজার ২৬৪টি হাট-বাজার থেকে গুরুত্ব বিবেচনায় ৭০০টিকে গ্রোথ সেন্টারে উন্নীত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এরমধ্যে কয়েকটিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
এ ছাড়া বিদ্যমান ১ হাজার ৬৮৯ গ্রোথ সেন্টারের সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়নের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে 'হাট-বাজার ডেটাবেজ, দেশব্যাপী গ্রামীণ গ্রোথ সেন্টার ও নগর কেন্দ্র নির্বাচন ও উন্নয়ন' শীর্ষক সমীক্ষা প্রতিবেদনে।
এরমধ্যে বিদ্যমান ২৩৬টি গ্রোথ সেন্টারকে টাউনশিপ (নগর কেন্দ্র) করা হবে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ৪৪৮টি গ্রোথ সেন্টারকে আরও সম্প্রসারণের প্রস্তাবও করা হয়েছে।
এলজিইডি কর্মকর্তারা জানান, সরকারের শহরের সকল সুযোগ-সুবিধা গ্রামে পৌঁছে দেওয়ার অঙ্গীকার রয়েছে।
'আমার গ্রাম- আমার শহর' প্রকল্প পরিচালক মনজুর সাদেক জানান, ১৯৯০ এর দশকে এ গ্রোথ সেন্টারগুলোকে নির্ধারণ করা হয়েছিল। এইসব গ্রোথ সেন্টার উন্নয়ন এবং সেগুলোকে মানসম্মত সড়কের সাথে সংযুক্ত করার মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নকে চলমান রাখতে সারাদেশে গ্রোথ সেন্টারের সংখ্যা বাড়ানো খুবই দরকার।
তিনি আরও বলেন, হাট-বাজারকে বাংলাদেশের গ্রামীণ রূপান্তরের কেন্দ্রবিন্দু বললে অত্যুক্তি হবে না। এই রূপান্তর প্রক্রিয়ায় ছোট ছোট হাট-বাজারগুলো চাহিদা বৃদ্ধির ফলে বড় হাট-বাজারে রূপান্তরিত হয় বা গ্রোথ সেন্টারের উপযুক্ত হয়ে উঠে। আবার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিস্তারের মাধ্যমে বড় গ্রোথ সেন্টারগুলো ছোট শহরে রূপান্তরিত হয়।
যেমন মহেশখালী পাওয়ার হাবের সন্নিকটে অবস্থিত চকরিয়ার বদরখালি বাজারকে উন্নয়নের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। কয়লা বিদ্যুৎকে কেন্দ্র করে বরগুনার তালতলি বাজারসহ স্থলবন্দর এবং অর্থনৈতিক অঞ্চলের সন্নিকটে থাকা অন্যান্য হাট-বাজারকেও পরিকল্পিত নগর হিসেবে গড়ে তোলার প্রস্তাব করা হয়েছে।
গ্রোথ সেন্টার থেকে ছোট শহরে রুপান্তর
এলজিইডি কর্মকর্তাদের মতে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেক গ্রোথ সেন্টার নগরে পরিণত হচ্ছে। তবে নগরায়ন হচ্ছে অপরিকল্পিত ভাবে।
এছাড়া সরকার সারা দেশে বেশ কিছু মেগা প্রকল্প ও অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের কাজ করছে। এসব এলাকায় ভবিষ্যতে টাউনশিপ গড়ে উঠবে। একারণে এখন থেকে এসব সম্ভাবনাময় গ্রোথ সেন্টারগুলো কেন্দ্র করে উন্নয়ন পরিকল্পনা করা দরকার।
কর্মকর্তারা জানান, নগর কেন্দ্র ছাড়াও- বিদ্যমান ৪৪৮টি গ্রোথ সেন্টারের বাজার অবকাঠামো সম্প্রাসারণে, প্রতিটিতে গড়ে ৩ থেকে ৫ কোটি টাকা ব্যয় হবে।
সমীক্ষায় প্রস্তাবিত নতুন ৭০০ গ্রোথ সেন্টারকে দুইভাবে নির্বাচন করা হয়েছে। এর একটি হলো- অর্থনৈতিক দক্ষতার ওপর এবং অন্যটি বৈষম্য নিরসনে ভূমিকার ওপর ভিত্তিতে।
যেসব অঞ্চল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের দিক থেকে পিছিয়ে আছে, বা জনঘনত্ব কম বা দুর্গম এলাকার– সেখানকার বাজারগুলোর লেনদেনের পরিমাণ, ইজারায় আহরিত অর্থ- ইত্যাদি বিবেচনায় পিছিয়ে থাকার কারণে বাদ পড়ে যায়। কিন্তু, সেগুলোর ওপর অনেক মানুষ নির্ভর করে। এই বাজারগুলো দারিদ্র্য নিরসনে এবং আঞ্চলিক বৈষম্য হ্রাসে ভুমিকা রাখবে। তাই সমতার বিবেচনায়- কিছু বাজারকে গ্রোথ সেন্টারে উন্নীত করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে।
সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৯০ এর দশকে তালিকাভুক্ত ৪১১টি গ্রোথ সেন্টার অর্থনৈতিক গুরুত্ব হারিয়ে ছোট হাট-বাজারে পরিণত হয়েছে; কিংবা নদী ভাঙ্গন বা অন্যান্য কোনো কারণে বিলীন হয়ে গেছে।
এ ধরণের গ্রোথ সেন্টারের মধ্যে রয়েছে বরিশালের বাদুরতলা হাট, চাঁদপুরের কোটের হাট, টাঙ্গাইলের চর পাউলি বাজার, ভোলার আলুমুদ্দিন হাট- ইত্যাদি।
অধ্যয়নের প্রতিবেদনটি অনুযায়ী, প্রতি দশকে অন্তত একবার গ্রোথ সেন্টার নির্বাচন প্রক্রিয়া চালানো উচিত এবং পুরোনোগুলির দক্ষতা পর্যালোচনা করা উচিত।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আমরা যদি পরিকল্পিত শহর চাই- তবে আমাদের হাট-বাজারকেন্দ্রিক পরিকল্পনাকে গুরুত্ব দিতে হবে। এক্ষেত্রে হাট-বাজার এবং তার চারপাশের আবাসন ও অন্যান্য ভূমির ব্যবহারকে রূপান্তর পরিকল্পনার আওতায় আনা দরকার।
অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘিরে আরও গ্রোথ সেন্টার গড়ে তোলার পরিকল্পনা
সরকারের অষ্টম পঞ্চম বার্ষিক পরিকল্পনায়- 'উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় সামঞ্জস্য স্থাপন এবং তার মাধ্যমে অধিকতর কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে' অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর আশেপাশে আরও অনেকগুলো গ্রোথ সেন্টার স্থাপনের কথা বলা হয়েছে।
সরকারের দীর্ঘমেয়াদি এই পরিকল্পনায় আরো বলা হয়েছে, এসব এলাকার বিশেষ পণ্য যেমন- আম, তরমুজ, সবজি, পেয়ারা ইত্যাদির বিপণন শক্তিশালীকরণে সংশ্লিষ্ট এলাকায় বিশেষ ধরণের গ্রোথ সেন্টার স্থাপন করা হবে।
গ্রোথ সেন্টারগুলোতে ই-কমার্স সেবা প্রদান, এজেন্ট ব্যাংকিং সুবিধা, হিমাগার সুবিধা এবং খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও কৃষিপণ্যের ভ্যালু চেইন ব্যবস্থা স্থাপনে উদ্যোগ নেওয়া হবে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এর গবেষণা পরিচালক সাইমা হক বিদিশা বলেন, গ্রামীণ অর্থনীতিতে গ্রোথ সেন্টারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তবে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির বিষয়টি মাথার রেখে এগুলো গড়ে তুলতে হবে। এ ছাড়া, কৃষি-কেন্দ্রিক অর্থনীতিতে উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি কৃষি-ভিত্তিক শিল্পে জোর দিতে হবে। এটা করা গেলে- কৃষির মাধ্যমে কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধি বাড়বে।
'বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে স্থানীয় ব্যবসায়ী ও যুব সমাজকে যুক্ত করা গেলে– গ্রামে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। এ ছাড়া কৃষকদের সার, বীজ পরিবহন এবং গুদাম-সুবিধার নিশ্চয়তা দিতে হবে। তখনই গ্রোথ সেন্টারের গুরুত্ব আরো বাড়বে'- যোগ করেন তিনি।
বড় শহরের ওপর চাপ কমাবে গ্রোথ সেন্টার
এলজিইডির সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গ্রামে কৃষিতে উচ্চতর ফলন নাহলে- ক্রমবর্ধমান এই নগরমুখী জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা এবং কৃষিনির্ভর ফরোয়ার্ড-লিঙ্কেজ শিল্পকে সহায়তা দেওয়া সম্ভব হবে না।
"গ্রামীণ অর্থনীতি থেকে কৃষিপণ্যের যোগান নিশ্চিত হওয়া কেবল গ্রামের জন্যই নয়, নগরের অস্তিত্বের জন্যও দরকারি। ফলে নগরায়ণ যতই বাড়বে গ্রাম এবং গ্রামের উৎপাদনশীলতা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। এই বিনিময়ে গ্রামের অর্থনীতি শক্তিশালী হলে এবং গ্রামে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা থাকলে- শহরগুলো গ্রাম থেকে কাজের সন্ধানে শহর অভিমুখী মানুষের ভিড়ে জর্জরিত হবে না। একইসাথে, আমরা সুখী এবং সমৃদ্ধ গ্রাম পাব। এভাবে 'আমার গ্রাম-আমার শহর' স্বপ্নের বাস্তবায়ন সহজ এবং বেগবান হবে। এভাবে গ্রাম-শহর বিভাজন থেকে আমরা গ্রাম-শহরের টেকসই মিথস্ক্রিয়া এবং সমৃদ্ধির দিকে যেতে পারব"- এতে আরও বলা হয়েছে।
১৯৭৯-৮০ সালে দেশে প্রথমবারের মতো এক জরিপের মাধ্যমে ৯৭২টি গ্রোথ সেন্টার তালিকাভুক্ত করে পরিকল্পনা কমিশন।
১৯৮৯ সালের বিশদ জরিপে মাধ্যমে মোট ১৪০০টি গ্রোথ সেন্টারকে তালিকাভুক্ত করা হয়। ওই সময় রাজস্ব আয়, বেচাকেনার পরিমাণ ছাড়াও প্রভাব অঞ্চলের জনসংখ্যা, অঞ্চলের আয়তন, থানায় ইউনিয়নের সংখ্যা, গ্রোথ সেন্টারের সংখ্যা, দুটি গ্রোথ সেন্টারের মাধ্যবর্তী দূরত্বকে বিবেচনায় নেওয়া হয়।
১৯৯২ সালের আগের সূচকগুলোর সঙ্গে নতুন কিছু সূচক যোগ করে- আরো ৭০০ গ্রোথ সেন্টারকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
এলজিইডির কর্মকর্তারা জানান, ৮০'র দশকে তালিকা করার পরই সরকার- গ্রোথ সেন্টারের উন্নয়নে মনোযোগ দেয়। ওই সময়, বাজার অবকাঠামো ছাড়াও গ্রোথ সেন্টারের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে- বিভিন্ন ধরণের সড়ক নির্মাণকে গুরুত্ব দেওয়া হয়, যাতে গ্রামীণ কৃষি পণ্যের বাজারজাতকরণ সহজ হয়। এতে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে কৃষকদের আগ্রহ বাড়ে। কৃষি খাতের এই পরিবর্তনের জন্য কৃষি গবেষণাও- খাদ্য উৎপাদনে ব্যাপক ভূমিকা রাখে।