চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস: এইচ এস কোড নিয়ে হয়রানি, বিপাকে ব্যবসায়ীরা
চট্টগ্রামের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান পিওর কেয়ার লিমিটেড সমুদ্রপথে শ্রীলঙ্কা থেকে ২৪০০ লিটার এক্সট্রা ভার্জিন কোকোনাট অয়েল আমদানি করে। নন রিফাইন্ড ক্যাটাগরির এই চালানটি খালাসে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে বিল অব এন্ট্রি দাখিল করে আমদানিকারকের সিএন্ডএফ এজেন্ট। কিন্তু কাস্টমসের সংশ্লিষ্ট শাখার এক রাজস্ব কর্মকর্তা চালানটির এইচ এস কোড পরিবর্তন করে রিফাইন্ড ক্যাটাগরিতে শুল্কায়ন করার চেষ্টা করে।
আমদানিকারকের ঘোষণা অনুযায়ী, প্রয়োজনীয় সব ডকুমেন্ট সরবরাহ করার পরও রাজস্ব কর্মকর্তা পণ্য চালানটি খালাসে একের পর এক জটিলতা সৃষ্টি করেন। রাজস্ব কর্মকর্তার চাহিদা অনুযায়ী আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানটি যাবতীয় ডকুমেন্ট দাখিল করার পর এক পর্যায়ে শুল্কায়ন করতে ১ লাখ টাকা ঘুষ দাবি করার অভিযোগ রয়েছে।
কিন্তু আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানটির মালিক ঘুষ দিতে অস্বীকৃতি জানালে বিল অব এন্ট্রি দাখিলের ২ সপ্তাহ পর গত বৃহস্পতিবার (৩ নভেম্বর) চালানটি শুল্কায়ন করলেও কাস্টমসের সফটওয়্যারে লক করে দেওয়া হয়। ফলে শুল্কায়ন শেষেও এই চালানটি এখন খালাস নিতে পারছেনা আমদানিকারক।
শুধুমাত্র পিওর কেয়ার লিমিটেড নয়, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে আমদানি হওয়া বেশিরভাগ চালান শুল্কায়নের চিত্র প্রায় একই। এইচ এস কোড পরিবর্তন সংক্রান্ত জটিলতা সৃষ্টি করে কাস্টম কর্মকর্তারা শুল্কায়ন করতে হয়রানি করে বলে অভিযোগ আমদানিকারকদের।
এসব হয়রানি বন্ধে আমদানিকারক, গার্মেন্টস মালিকসহ ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো কাস্টম কমিশনারের সাথে একাধিকবার বৈঠক করেছেন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো লিখিতভাবে অবহিত করলেও এর কোন সুফল পাচ্ছেনা ব্যবসায়ীরা।
আমদানিকারকরা বলেন, শুল্কায়ন প্রক্রিয়ায় এসিসটেন্ট রেভিনিউ অফিসার (এআরও), রেভিনিউ অফিসার (আরও) দের অনৈতিক সুবিধা নেওয়ার প্রবণতার কারণে মুলত এসব জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। পণ্য চালান আটকিয়ে টাকা আদায়ের মানসিকতা এসব কর্মকর্তাদের থেকে যতদিন দূর হবেনা এই জটিলতা থেকে সমাধানের কোন পথ নেই।
এইচএস কোড হল একটি বৈশ্বিক মানদণ্ড, যা বিভিন্ন পণ্যকে প্রায় ৫ হাজার কমোডিটি গ্রুপে শ্রেণীবদ্ধ করার জন্য ব্যবহৃত হয়। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ শুল্ক মূল্যায়নের সময় পণ্য সনাক্ত করতে এটি ব্যবহার করে।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে প্রতিদিন গড়ে প্রায় দুই হাজার বিল অব এন্ট্রি আমদানি করা হয়। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানিকৃত পণ্যের প্রায় ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ পোশাক শিল্পের কাঁচামাল। প্রায় সব পণ্যই শুল্কমুক্ত বা বন্ডেড গুদাম সুবিধা নিয়ে আমদানি করা হয়।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে এই মুহুর্তে সবচেয়ে বড় বাধা এইচ এস কোড সংক্রান্ত জটিলতা। এ ধরনের জটিলতা সৃষ্টির কোন ধরনের যৌক্তিকতা নেই। এই জটিলতা তৈরি করে সরকার কিংবা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কোন লাভ নেই। বরং ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দরে যেসব কন্টেইনার দীর্ঘদিন পড়ে আছে এর কারণ খুঁজতে গেলে পাওয়া যাবে কাস্টমসের অহেতুক হয়রানির কারণে এসব হচ্ছে ।
গত ৩০ অক্টোবর চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনারকে হয়রানির বিষয়গুলো উল্লেখ করে একটি চিঠি দিয়েছেন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান।
আমদানিকৃত পণ্য চালানের সংশ্লিষ্ট এইচ এস কোড বন্ড লাইসেন্সে উল্লেখ না থাকলে অঙ্গীকারনামা গ্রহণ করে দ্রুত শুল্কায়ন সম্পন্ন করা প্রয়োজন। এইচ এস কোড বন্ড লাইসেন্স-এ অর্ন্তভূক্ত না থাকলে পরবর্তীতে বন্ডার কর্তৃক তা বন্ড লাইসেন্সে অন্তর্ভূক্ত করে শুল্কায়নের জন্য উপস্থাপন করা হলে জরিমানা আরোপ না করতে কাস্টম কমিশনারের প্রতি আহ্বান জানান বিজিএমইএ সভাপতি।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্পের বন্ডের আওতায় আমদানিকৃত কাঁচামাল ছাড় করতে জটিলতায় পড়ছে এ কারণে রপ্তানিকারকদের পক্ষে লিড টাইমের মধ্যে পণ্য রপ্তানি করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে অনেক রপ্তানি আদেশ বাতিল হয়ে যাচ্ছে এবং রপ্তানিকারকরা আর্থিক সংকটের মধ্যে রয়েছে। এমনকি শ্রমিক কর্মচারীদের বেতন-ভাতাও সময়মতো পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। যার ফলে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিচ্ছে।
পিওর কেয়ার লিমিটেডের মালিক শোয়েব কবির দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "কাস্টমস কর্মকর্তাদের জটিলতার কারণে গত দুই সপ্তাহ ধরে নারকেল তেলের চালান আটকে আছে। সময়মতো ডেলিভারি দিতে না পারায় পণ্যটির অর্ডার বাতিল করা হয়েছে।"
"শুধু ঘুষ না দেওয়ায় কাস্টমস চালানটি ক্লিয়ার করেনি। শুল্ক আদায়ের পরও রাজস্ব কর্মকর্তা চালানটি সফটওয়্যারে তালাবদ্ধ করে দেন। পণ্য ডেলিভারি না করায় বন্দরে পণ্যটি রাখার ভাড়া প্রতিদিনই বাড়ছে। কাস্টমস এভাবে হয়রানি করলে আমরা ব্যবসা করব কীভাবে?"
পিওর কেয়ার লিমিটেডের চালানের জন্য ঘুষ চাওয়ার অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের রাজস্ব কর্মকর্তা মো. সরোয়ার টিবিএসকে বলেন, "আমরা পণ্যটির জন্য ট্যাক্সের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছি। কাস্টমসের কোন শাখা এটি তালাবদ্ধ করেছে তা আমি জানি না।"
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ বলেন, "এইচএস কোড সংক্রান্ত জটিলতার কারণে যে পণ্য দুই দিনের মধ্যে ডেলিভারি দেওয়ার কথা তা ১৫ দিন পরও ডেলিভারি করা হয় না। হয়রানির শিকার ব্যবসায়ীরা কার কাছে অভিযোগ করবেন? অসাধু কাস্টমস কর্মকর্তাদের কারণে ব্যবস্থাপনাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।"
চট্টগ্রাম সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কাজী মাহমুদ ইমাম বিলু টিবিএসকে বলেন, কিছু অসাধু কাস্টমস কর্মকর্তা আমদানিকারকদের হয়রানি করছেন, যা ব্যবসা-বান্ধব পরিবেশে কাম্য নয়।
আমদানিকারকরা জানান, এইচএস কোডে ভুল হলে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ মোটা অঙ্কের জরিমানা করে, যা ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি করছে।