যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আরএমজি রপ্তানি বৃদ্ধিতে পুষিয়ে যেতে পারে ইইউ-এর ক্ষতি
অর্থনৈতিক মন্দায় ইউরোপের দেশগুলোতে পোশাকের চাহিদা কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে এর মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রে অব্যাহতভাবে রপ্তানি বৃদ্ধি পেতে থাকায় তা গোটা পোশাক খাতকে আশার আলো দেখাচ্ছে বলে মনে করছে রপ্তানিকারকরা।
একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের পোশাকের বৃহত্তম রপ্তানি গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্রে। দেশটিতে চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে এ খাতের রপ্তানি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪৮.৬ শতাংশ বেড়েছে। এই সময়কালে অর্থ ও পরিমাণ দুদিক থেকেই রপ্তানি বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অভ কমার্সের সহযোগী সংস্থা অফিস অভ টেক্সটাইলস অ্যান্ড অ্যাপারেল-এর (ওটিইএক্সএ) হিসাব থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
রপ্তানিকারকরা আশা প্রকাশ করেছেন, অর্থনৈতিক মন্দায় ইউরোপের দেশগুলোতে রপ্তানি কমে যাওয়ার ক্ষতি পুষিয়ে যাবে যুক্তরাষ্ট্রে এই বর্ধিত রপ্তানিতে।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্রে দেশের পোশাক খাতের পারফরম্যান্স খুবই ভালো।
তিনি বলেন, 'এ বছরের প্রথম দশ মাসে মার্কিন বাজারে রপ্তানি পুরো ২০২১ সালের চেয়ে বেশি।'
চলতি বছর শেষে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি ১০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। গত বছর দেশটিতে ৭.১৪ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছিল।
বিজিএমইএ সভাপতি যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানির এই বৃদ্ধির পেছনে তিনটি মূল কারণ চিহ্নিত করেছেন—এখন পর্যন্ত অনুসরণ করা পোশাক কূটনীতির কারণে বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের ওপর ক্রেতাদের আস্থা, কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে ইউনিটের দাম বৃদ্ধি এবং বাংলাদেশি পোশাক প্রস্তুতকারকদের মূল্য-সংযোজিত আইটেম উৎপাদন।
এছাড়া বাংলাদেশের পোশাকশিল্পে কর্মক্ষেত্র ও অন্যান্য নিরাপত্তার উন্নতির জন্য বড় বিনিয়োগ রয়েছে বলেও জানান তিনি।
ফারুক হাসান বলেন, 'বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা সত্ত্বেও মার্কিন বাজারে পোশাকের চাহিদা বাড়ছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশি টাকার তুলনায় মার্কিন ডলার শক্তিশালী হয়েছে—এটাও তাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করেছে। এর প্রতিফলন পড়েছে ইউনিট অ্যান্ড স্কয়ার মিটার ভ্যালু (এসএমভি) এবং ভ্যালু-অ্যাডেড পণ্য রপ্তানির বিবেচনায় মূল্যবৃদ্ধিতে।'
ভ্যালু-অ্যাডেড পণ্যের উদাহরণ দিয়ে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, 'আমরা শার্ট রপ্তানি করতাম প্রতি ইউনিট ১২ ডলার এফওবি (ফ্রি অন বোর্ড) মূল্যে, কিন্তু এখন এই পণ্য প্রতি ইউনিট ২৫ ডলার এফওবি মূল্যে রপ্তানি করছি।'
তিনি আরও জানান, কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধির কারণে পোশাক খাত মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রপ্তানিতে বেশি দাম পেয়েছে।
স্প্যারো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শোভন ইসলাম বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাজার ধারাবাহিকভাবে বড় হচ্ছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের আরও প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে, যা এ বছর ইউরোপের দেশগুলোতে সম্ভাব্য রপ্তানি ক্ষতি পুষিয়ে দেবে।
বড়দিন ও থ্যাঙ্কসগিভিং ডে-তে মার্কিন বাজারে বিক্রি খুব ভালো হয়েছে বলেও জানান শোভন।
ভূরাজনৈতিক কারণে চীন থেকে পোশাক আমদানি কমিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এটিও বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছে।
শোভন ইসলাম বলেন, 'আমরা কিছু অর্ডার পাচ্ছি যেগুলো চীন, শ্রীলঙ্কা ও মিয়ানমার থেকে স্থানান্তরিত হয়ে এখানে এসেছে।'
বাংলাদেশ গার্মেন্টস বায়িং হাউস অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি মো. আনোয়ার শহীদও তার সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানি বাড়লে ইউরোপের বাজারের সম্ভাব্য ক্ষতি পুষিয়ে যাবে।
তিনি আরও বলেন, ইউরোপের বাজারগুলোতে মূলত নিট আইটেমের চাহিদা বেশি, অন্যদিকে মার্কিন বাজারে চাহিদা বেশি ওভেন আইটেমের।
শোভন ইসলাম আরও জানান, সুদের হার এবং জ্বালানির দাম বাড়তে থাকায় যুক্তরাষ্ট্রেও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার ধাক্কা লাগছে। তবে মানুষ এখনও সেখানে কাপড় কিনছে বলেও জানান তিনি।
যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারলে সেখানে পোশাকের বড় চাহিদা তৈরি হবে বলে উল্লেখ করেন শোভন। তবে আগামী বছরের প্রথমার্ধে পোশাক রপ্তানি মন্থর থাকতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। তারা অর্ডারে ধীরগতি লক্ষ করেছেন।
২০২৩-এ মন্দা থেকে বেঁচে যেতে পারে যুক্তরাষ্ট্র
তবে গোল্ডম্যান স্যাকসের গবেষণা পূর্বাভাস দিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র আগামী বছর অল্পের জন্য মন্দার হাত থেকে বেঁচে যাবে। এ সময় দেশটির মূল্যস্ফীতি সামান্য কমবে ও বেকারত্ব বাড়বে।
গত মাসে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে গোল্ডম্যান স্যাকসের অর্থনীতিবিদরা বলেন, আগামী বছর যুক্তরাষ্ট্রের মন্দার দিকে যাওয়ার সম্ভাবনা ৩৫ শতাংশ। অন্যদিকে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের সমীক্ষায় এ সম্ভাবনা ৬৫ শতাংশ বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের তথ্য মন্দার কাছাকাছি নেই বলে দেশটি আংশিকভাবে মন্দা এড়াতে পারে বলে মন্তব্য করা হয় গোল্ডম্যান স্যাকসের গবেষণায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একটি অগ্রিম প্রতিবেদন অনুসারে, তৃতীয় প্রান্তিকে যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ২.৬ শতাংশ (বার্ষিকীকৃত)। আর অক্টোবরে দেশটিতে ২ লাখ ৬১ হাজার কর্মসংস্থান যোগ হয়েছে।
সিএনএন বিজনেসের তথ্যমতে, তৃতীয় প্রান্তিকে মার্কিন অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ছিল প্রত্যাশার চেয়ে অনেক দ্রুত। এ সময় দেশটির জিডিবি প্রবৃদ্ধি ছিল ২.৯ শতাংশ (বার্ষিকীকৃত)।
অক্টোবরে সরকারি পূর্বাভাস ছিল, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রবৃদ্ধি হবে ২.৬ শতাংশ। সেই হিসাবে সরকারি পূর্বাভাসের চেয়ে ভালো করেছে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি।
প্রত্যাশার চেয়ে ভালো এই প্রবৃদ্ধি হয়েছে ভোক্তাদের ব্যয় সরকারের আগের পূর্বাভাসের চেয়ে বৃদ্ধি পাওয়ায়।
ইইউ-এর পূর্বাভাসে আশঙ্কা
এদিকে ইউরোপীয় কমিশনের শরৎকালীন অর্থনৈতিক পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, ইউরোজোন ও ইইউয়ের অধিকাংশ সদস্যদেশ ২০২২ সালের শেষ প্রান্তিকে অর্থনৈতিক মন্দার দিকে ধাবিত হবে।
ইউরোনিউজ ডটকম জানিয়েছে, ইইউয়ের অর্থনীতি কমিশনার পাওলো গেন্তিলোনি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, অর্থনৈতিক অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে। আরও দুই প্রান্তিক তাদের সংকোচনের মধ্য দিয়ে যেতে হবে।
ইইউ জুলাইয়ে দেওয়া মূল্যস্ফীতির পূর্বাভাসও সংশোধন করে জানিয়েছে যে, ২০২৩ সালের শেষ দিকে পণ্যমূল্য চূড়ায় পৌঁছাবে। ব্রাসেলস জানিয়েছে, ২০২২ সালে ইইউর গড় মূল্যস্ফীতি ৯.৩ শতাংশ এবং ইউরোজোনের গড় মূল্যস্ফীতি ৮.৫ শতাংশ হবে।
ইউরোপীয় কমিশন এক বিবৃতিতে বলেছে, ভৌগোলিকভাবে যুদ্ধের সবচেয়ে কাছাকাছি এবং রাশিয়ার গ্যাস আমদানির ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় ইইউতে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি।
এছাড়া জ্বালানি সংকটে ইউরোপের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা তো কমছেই, সেইসঙ্গে কমছে উৎপাদনও।
জানুয়ারি-অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি
২০২২ সালের জানুয়ারি-অক্টোবর সময়কালে যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক আমদানি বার্ষিক ৩০.১৬ শতাংশ বেড়ে ৮৭.০৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে।
এর আগে ২০১৯ সালে একই সময়কালে সর্বোচ্চ ৭২.৫২ বিলিয়ন ডলারের পোশাক আমদানি করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। ২০২২ সালে আগের এ আমদানি রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে দেশটি।
শীর্ষ পাঁচটি আমদানি গন্তব্যের মধ্যে শতকরাভিত্তিক শেয়ারে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে। ২০২১ সালের জানুয়ারি-অক্টোবরের বাংলাদেশের হিস্যা যেখানে ৮.৫১ শতাংশ ছিল, এ বছর একই সময়ে তা ৯.৭১ শতাংশ হয়েছে।
উল্লিখিত সময়ে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ৮.৪৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পোশাক রপ্তানি করেছে, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪৮.৫৬ শতাংশ বেশি।
এ সময়ে বাংলাদেশ থেকে ২.৭৬ বিলিয়ন বর্গমিটার পোশাক আমদানি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ২০২১ সালে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি করা ২.১০ বিলিয়ন বর্গমিটারের চেয়ে এটি ৩১.৩৯ শতাংশ বেশি।
ওটিইএক্সএর তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে সারাবিশ্ব থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক আমদানি ৩০.১৬ শতাংশ বেড়ে ৮৭.০৯ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।
যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি পোশাক আমদানি করেছে চীন থেকে। ২০.৭৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধিতে চীন থেকে ১৯.৩৩ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পোশাক আমদানি করেছে দেশটি। তবে ভ্যালু-ভিত্তিক শেয়ার আগের বছরের ২৩.৯২ শতাংশ থেকে কমে এ বছর ২২.১৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
২০২২ সালের জানুয়ারি-অক্টোবর সময়কালে ভিয়েতনামের বাজার হিস্যাও কমে ১৮.৪২ শতাংশ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ১৬.০৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমমূল্যের পোশাক রপ্তানি করে ২য় স্থানে রয়েছে দেশটি।
রপ্তানির ক্ষেত্রে ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার মধ্যে নিবিড় প্রতিযোগিতা দেখা গেছে। ভারত যুক্তরাষ্ট্রে ৫ বিলিয়ন ডলারের (৪৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি) পোশাক রপ্তানি করেছে। অন্যদিকে ইন্দোনেশিয়া থেকে মার্কিন বাজারে পাঠানো হয়েছে ৪.৯৫ বিলিয়ন ডলারের (৪৭.৫৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি) পোশাক।