জমির উচ্চমূল্য, শ্রীমঙ্গল বিসিক নগরীতে আগ্রহী নন বিনিয়োগকারীরা
মৌলভীবাজারের বিনিয়োগকারীদের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে শ্রীমঙ্গল উপজেলার উত্তরসুর এলাকায় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পভিত্তিক মৌলিক শিল্প নগরী গড়ে তোলা হয় ২০১২ সালের জুলাই মাসে। এখানে আছে বিশাল প্লট, সুবিশাল বাউন্ডারি ওয়াল, পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা। তবুও সারা বছর তালাবন্ধ অবস্থায় পড়ে থাকছে শ্রীমঙ্গল বিসিক নগরী।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্লটের মূল্যবৃদ্ধি, প্রচারণার অভাব, নিরাপত্তার অভাব ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা নিয়োগের অভাবে চলছে এ অবস্থা। গত ৪ বছরে এখানে আসেনি কোন বরাদ্দও। কাঁচামালের প্রাপ্যতা থাকা সত্ত্বেও উল্লেখযোগ্য শিল্প গড়ে ওঠেনি।
শ্রীমঙ্গলের ব্যবসায়ী আবুল কালাম জানান, 'বিসিকে কোন পরিবেশ নেই, উলটো জমির (ফ্লটের) তিনগুণ দামের কারণে সরকার কোনো ভর্তুকি না দিলে এসব প্লটে শিল্প স্থাপন সম্ভব নয়। সারা দেশে যেখানে মানুষ প্লট নিতে প্রতিযোগিতায় নামে সেখানে শ্রীমঙ্গলের চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত। প্লট আছে কিন্তু ক্রেতা নেই। বিষয়টি নিয়ে কর্তৃপক্ষ ভাবছে কিনা তাও বুঝতে পারছিনা।'
সরেজমিনে বিসিক এলাকা ঘুরে দেখা যায়, এতে একজন প্রহরী ছাড়া কোনো জনবল নেই। যোগাযোগ বা মোবাইল নম্বরের জন্য কোনো সাইনবোর্ড বা ব্যানার নেই। তালাবন্ধ সুউচ্চ সীমানা প্রাচীর উঁকি দিয়ে সীমানার ভেতরে জঙ্গলের মতো দেখা যাচ্ছে।
৭ জন জনবল থাকার কথা থাকলেও দেখা যায় আছেন মাত্র একজন প্রহরী। প্রহরী বিশ্বজিৎ সরকার জানান, 'একা একা কী কাজ করা যায়! কয়দিন আগেও এখানে চুরি হয়েছে। থাকার কথা ৭ জন কিন্তু আমি একা আছি।'
গেইটের পাশেই কথা হয় স্থানীয় যুবক কবির মিয়ার সাথে। তিনি জানান, 'যখন এখানে স্থাপনা তৈরী হয় এলাকার মানুষ খুশি ছিল- এখানে কলকারখানা হবে, এলাকার বেকারত্ব দূর হবে, মানুষ কাজ পাবে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে শুধু এলাকার একটু সৌন্দর্যবর্ধন বৃদ্ধি হয়েছে, আর কিছু না। সারাদিন তালাবন্ধ অবস্থায় থাকে।'
এদিকে বিসিক কর্তৃপক্ষের দেয়া তথ্যমতে, ১২২টি প্লটের শিল্পনগরী গড়ে তুলতে প্রায় ৫০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। ২০১২ সালের জুলাই মাসে ২০ একর জমির উপর বিসিক প্রতিষ্ঠিত হয়। এর বাস্তবায়নের তারিখ ২০১২ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের জুনের মধ্যে।
২০১৯ সালে প্রাথমিকভাবে তিন উদ্যোক্তা মাত্র তিনটি প্লট নেন তবে তারা পরবর্তীতে বরাদ্দ বাতিলের আবেদন করেন।
প্রথমদিকে প্লট বরাদ্দ নিয়ে আবার বাতিল করেছিলেন উদ্যোক্তা পুলক সূত্রধর। তিনি জানান, 'আমি প্লট নিয়েছিলাম পরে অন্যদের কাউকে এখানে প্লট নিতে আগ্রহ না দেখায় আমিও টাকা ফেরত নিয়েছি। বিসিকের বাইরে কম টাকায় জমি কিনে আমি আমার কারখানা স্থাপন করেছি।'
বিসিক সূত্র আরও জানিয়েছে, সম্প্রতি একজন উদ্যোক্তার একই প্রতিষ্ঠানের নামে ৪০টি প্লট বরাদ্দের অনুমোদনের জন্য বিসিক জেলা প্লট বরাদ্দ কমিটির প্রধান কার্যালয় থেকে বর্তমানে ঢাকার প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। সেই সাথে সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন, সেমিনার ও কর্মশালার মাধ্যমে উদ্দোক্তাদের আগ্রহী করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
আশার কথা শুনালেন জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান। তিনি বলেন, 'এখানে সব ধরনের সুযোগ সুবিধা থাকার পরেও কেন বিনিয়োগকারীরা আকৃষ্ট হচ্ছেন না তা সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে দেখা হবে। ক্ষুদ্র কুটির শিল্পে বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা আরও ভাল করে নিশ্চিত করার পরিকল্পনা নেওয়া হবে।'
তবে স্থানীয় উদ্যোক্তারা বলছেন ভিন্ন কথা। তারা বলেন, শ্রীমঙ্গলে প্রচুর ছোট-বড় কারখানা গড়ে উঠেছে এবং গত কয়েক বছরে অনেকেই নতুন কারখানা করতে চাচ্ছেন কিন্তু এত চাহিদা থাকার পরেও বিসিকে মানুষ আগ্রহী না কারণ এখানে জমির দাম বেশি।
স্থানীয় বিনিয়োগকারী রাজু ঘোষ বলেন, 'জমির দাম তুলনামূলক বেশি হওয়ায় ক্রেতারা প্লট কিনতে আগ্রহী নন। তার উপর কোন প্রচার-প্রচারণা নেই, ভবন বানাতে যতটা আগ্রহী দেখা গেছে অন্য বিষয়ে ততই আগ্রহ কম। একজন উদ্যোক্তা কখনো জেনেশুনে তার বিনিয়োগের টাকা শুধু জমিতেই ২ গুণ অতিরিক্ত বিনিয়োগ করবে না। অন্য জায়গায় জমির দাম কমে হলে এখানে বেশী দামে কেন নেবে?'
টি প্ল্যান্টার্স অ্যান্ড ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সদস্য সচিব জহর তরফদার বলেন, 'রাস্তার পাশের জমির বর্তমান মূল্য দেড় লাখ টাকা এবং সামান্য ভেতরে এক লাখ টাকা। তবে ওই স্থানে বিসিকের জমির মূল্য ধরা হয়েছে চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা। এত দাম দিয়ে কে কিনবে বুঝতে পারছি না। বর্তমান দামের চেয়ে প্রায় দুই থেকে তিনগুণ বেশি। এ কারণে উদ্যোক্তারা নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।'
শ্রীমঙ্গল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাজী মোহাম্মদ কামাল হোসেন মনে করেন, 'বিসিক নিয়ে ব্যবসায়ীদের আগ্রহ নেই। নতুন উদ্যোক্তাদের বিসিক টানতে পারছেনা। যারা আগে কারখানা করেছেন তাদের বেশীরভাগ নিজের জায়গাতেই করেছেন। এখন যারা করবেন বা করছেন তাদেরকে সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। জায়গার দামে স্থানীয় বাজারের সাথে মিল থাকতে হবে। দুই-তিনগুণ বেশী টাকা দিয়ে মানুষ কেন জায়গা কিনতে যাবে?'
সামগ্রিক বিষয়ে মৌলভীবাজার বিসিকের উপ-ব্যবস্থাপক মোঃ বেল্লাল হোসেন ভূঁইয়া বলেন, 'প্রথম ধাপে আগ্রহী উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে আবেদন চাওয়া হলেও মাত্র তিনজন উদ্যোক্তা সাড়া দেন। পরে তারা তাদের প্লট বাতিল করেন। ওপরমহল থেকে যেভাবে নির্দেশনা আসছে সেভাবেই প্রচার চালানো হচ্ছে। প্লট তৈরীতে খরচ বেশী হওয়াতে প্লটের দাম বেশী।'
এখানে বিনিয়োগকারীদের জন্য প্লট কেনায় ভাল সুযোগ আছে জানিয়ে তিনি বলেন, তারা এখানে ১০ কিস্তিতে প্লট কিনতে পারেন যা তাদের জন্য একটি ভালো সুযোগ।