গ্যাস সংকট, বেহাল ড্রেনেজ ব্যবস্থা: নওগাঁয় বিসিক শিল্পনগরীর রুগ্ন দশা
ড্রেনেজ ব্যবস্থা বেহাল। কাদায় একাকার রাস্তাঘাট। কারখানাগুলোতে গ্যাস সরবরাহ নেই। ক্রমাগত বাড়ছে জ্বালানির দাম। বহুমাত্রিক সংকটে অধিকাংশ কারখানা বন্ধ। যে'কটি চালু আছে তাও বছরে তিন থেকে ছ'মাস চলে। ফলে কমেছে উৎপাদন। প্রতিযোগিতার বাজারে টিকতে না পেরে কেউ কেউ ব্যবসাও গুটিয়ে নিচ্ছেন। কয়েকজন আবার কারখানার মধ্যেই বসতি গড়েছেন।
এমন চিত্র নওগাঁর বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) শিল্পাঞ্চলের। সংকটময় অবস্থায় কারখানাগুলোর তিন থেকে ছয়মাস চলার কথা স্বীকার করে বিসিক বলছে, এই শিল্পাঞ্চল রুগ্ন অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে।নওগাঁ শহরের কয়েক কিলোমিটার দূরে শালুকা ও মশরপুরে এই শিল্পনগরী স্থাপন শুরু হয় ২০০০ সালে। ১৫ দশমিক ১৪ একর জমিতে নির্মাণ করা হয় অবকাঠামো। ওই সময় ব্যয় ধরা হয় ২ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। রাস্তাঘাট সহ অবকাঠামোর নির্মাণ কাজ শেষ হয় ২০০৪ সালে। ৮২টি প্লট। অফিস বাদে ৮১টি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সব মিলে শিল্প ইউনিট ৫৩টি। কাগজে-কলমে সচল দেখানো হয়েছে ৫০টি।
এসব প্রতিষ্ঠানে খাদ্য ও খাদ্যজাত পণ্য, কীটনাশক, ট্রাকের বডি, পাম্প, কেবল, কৃষি যন্ত্রাংশ, জৈব সার, প্লাস্টিক, কেমিক্যাল, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং সহ অন্যান্য পণ্য উৎপাদন হয় বলে বিসিক জানিয়েছে।
সংস্থাটির নথিতে ৫০ শিল্প ইউনিট চালু থাকার কথা দাবি করা হলেও বাস্তবতা ভিন্ন। নওগাঁ বিসিকের ৭০ শতাংশ কারখানা (ইউটিন) বন্ধ বলে উদ্যোক্তারাই জানিয়েছেন। অনেক চালু থাকা কারখানা গড়ে ৩ থেকে ৬ মাস সচল থাকে।
বিসিক শিল্প এলাকায় অবস্থিত নাসিম ব্রাদার্স অটোমেটিক রাইস মিল বছরে চারমাস চলে। এই প্রতিষ্ঠানের মালিক নাসিম উদ্দিন বলেন, বিসিকের অব্যবস্থাপনা ও প্রতিযোগিতার বাজারে টিকতে না পেরে কারখানা বছরের অধিকাংশ সময় বন্ধ রাখা ছাড়া উপায় থাকে না।
নাসিমের কথার সাথে একমত পোষণ করে মুনিম এন্টারপ্রাইজের মালিক নূর মুমিনুল হক বলেন, নওগাঁ বিসিক শিল্পনগরীরর অন্যতম প্রধান সমস্যা গ্যাস সরবরাহ না থাকা। এই ব্যবসায়ী বিসিকের মধ্যে থাকা শিল্পকারখানার একাংশ বিক্রি করার বিজ্ঞাপন টাঙিয়েছেন। বলেন, 'কারখানাগুলো বন্ধ থাকার অনেক কারণ। বিসিকের বহু উদ্যোক্তা ব্যাংকের লোন নিয়ে ঋণখেলাপি হয়েছেন। তারা টাকা না দেওয়ার পরিকল্পনা করেও মিল বন্ধ রেখেছেন। এরা আসলে ধান্দাবাজ।'
একটি শিল্পাঞ্চলের রাস্তাঘাট, ড্রেনেজ, কালভার্ট চলাচল উপযোগী না হলে সেখানে ব্যবসায়িক পরিবেশ থাকার কথা নয় বলে মন্তব্য করেছেন এসএস মেটালের অন্যতম পরিচালক মো. সোহান হোসেন। তিনি জানান, 'এখানে মিল-ফ্যাক্টরির চুলার ছাই উড়ে একাকার হয়ে যায় এলাকা। এগুলো বলার কেউ নেই। বলেও লাভ নেই। বিসিকের মধ্যে কারখানাগুলো নামে মাত্র চলে। লোকদেখানো।'
শিল্প মালিকরা প্রতিযোগিতার বাজারে টিকতে পারছে না বলে জানিয়ে ডক্টরস ফুড প্রডাক্টের কারখানা ম্যানেজার এমরান হোসেন বলেন, 'গ্যাসের সাথে খরচ কুলিয়ে গুণগত মানের পণ্য উৎপাদন করা সম্ভব নয়। কেক-মিষ্টির কারখানায় এখন বিরিয়ানি তৈরি করা হয়। কোনমতে টিকে থাকতে হচ্ছে এখন।'
বিসিক কারখানার মধ্যে বাড়িঘরের আদল রয়েছে মতি মুড়ি কোম্পানির। এই প্রতিষ্ঠানের মালিক মো. মনিবুর রহমান সোহাগ বলেন, 'বিসিকের অনেকের অবস্থা ভালো নেই। ব্যবসা করে অনেকে ধ্বংস হয়ে গেছে। ব্যাংকের কাছে ঋণখেলাপি হয়েছেন। এই কারণে বাধ্য হয়ে কারখানার মধ্যেই থাকছেন। এমন পরিস্থিতি না হলে তো কেউ কারখানার মধ্যে থাকতে চাইবেন না। আমার কারখানা চালু থাকলেও লসের মধ্যে মধ্যে আছি। নিরাপত্তার স্বার্থে শ্রমিকদের কারখানায় রাখা হয়েছে।'
ব্যবসায়ীরা জানান, বিসিক এলাকায় সামান্য বৃষ্টি হলে কারখানার মধ্যে পানি ঢুকে যায়। রাস্তাঘাট ঠিক না থাকলে সেখানে ব্যবসা-বাণিজ্য কীভাবে হবে! তাছাড়া নওগাঁয় কয়লা বা বিদ্যুতে উৎপাদিত হচ্ছে পণ্য। এ কারণে অন্য বাজারের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছেন না তারা। কিন্তু মাঝখান থেকে ব্যাংক লোনের বোঝা বড় হচ্ছে। খেলাপি ঋণে অনেকে জর্জরিত হয়েছেন।
টাকার অভাবে নিরাপত্তারক্ষীও রাখা সম্ভব হচ্ছে না, এমন অজুহাতে বিসিক কারখানা এলাকায় বছরের পর বছর ধরে বসবাস করছেন বারিক ইঞ্জিনিয়ারিং কমপ্লেক্সের স্বত্বাধিকারী আব্দুল বারী। এই ব্যবসায়ী বলেন, 'এখানে আমি থাকি এটা সম্পূর্ণ ঠিক নয়। ম্যানেজারেরা থাকেন।'
তবে তার কারখানার একাধিক শ্রমিক জানান, বারিক বিসিকের পাওয়া প্লটে একতলা বাড়ি করেছেন। এসি লাগানো পুরো বাড়িজুড়ে। সেখানে পরিবারের লোকজন নিয়ে তিনি বসবাস করেন।
নওগাঁ বিসিক শিল্পনগরী মালিক সমিতির সহসভাপতি ও ফারিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মালিক মালিক মশিউর রহমান বলেন, 'আমাদের কাছ থেকে বিসিক যে সার্ভিস চার্জ পায় তা দিয়েও তো অনেক কিছু করতে পারে। কিন্তু করে না। অনেকে বাধ্য হয়ে কারখানা বন্ধ রেখেছেন, গুটিয়ে নিচ্ছেন। প্রতিযোগিতার বাজারে টেকা যাচ্ছে না। নওগাঁর মতো পিছিয়ে পড়া অঞ্চলে কোন ধরনের কারখানা হবে, গ্যাসহীন কারখানা টিকানো যাবে কিনা তা নিয়ে কারও কোনো গবেষণা নেই। অবকাঠামো মেরামত করার মতো সামর্থও নেই অনেকের।'
সরকারি কর্মকর্তাদের উদাসীনতার কারণে নওগাঁ বিসিকের করুণ দশা বলে মনে করেন জেলা চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি ইকবাল শাহরিয়ার রাসেল। তিনি বলেন, 'অধিকাংশ কারখানায় পণ্য উৎপাদন হয় না। অথচ বছরের পর বছর ধরে কারখানা গুদাম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আবার কেউ কেউ কারখানার বদলে বসতি গড়েছে। ঠিকঠাক মতো সরকারি পাওনাও পরিশোধ করে না। তাহলে তো বিসিকের রুগ্ন দশা হবেই। এসব বিষয়ে আমরা দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বার বার বলে আসছি। কিন্তু তারা এগুলো কানে তোলেন না।'
ব্যবসায়ীরা এই বিসিকে প্রায় ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। কর্মসংস্থান হওয়ার কথা প্রায় ১১০০ মানুষের। কিন্তু সেই বাস্তবতা এখন নেই। এখানে কতোগুলো শিল্প ইউনিট বিসিকে বন্ধ রয়েছে সেই তথ্য দিতে নারাজ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে নওগাঁ বিসিকের উপ-ব্যবস্থাপক শামীম আক্তার মামুন বলেন, 'এখানকার বাস্তবতা স্বীকার করতে হবে। কারণ এই শিল্পনগরীতে গ্যাস সংযোগ নেই। অধিকাংশ কারখানা ৩ থেকে ৬ মাস চলে। রুগ্ন অবস্থায় চলছে সব। প্রতিযোগিতার বাজারে টিকতে না পেরে এরপর বন্ধ থাকে কারখানা। বিকল্প উদ্যোগ, বিকল্প জ্বালানি ব্যবস্থা ছাড়া এই শিল্পাঞ্চলকে বাজারমুখী করা সম্ভব নয়। আমরা বিভিন্ন সংকটের কথা প্রতিবেদন আকারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি।'