প্রবাসী সেভিংস অ্যাকাউন্টে আমানত বাড়লেও, প্রত্যাশার চেয়ে কম
দুই বছর আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুসরণ করে বেশ কয়েকটি ব্যাংক প্রবাসীদের জন্য আলাদা কোনো সেভিংস স্কিম চালু না করলেও, দুই বছর ধরে নিম্নমুখী প্রবণতায় থাকার পর গত এক বছরে স্থানীয় ব্যাংকে প্রবাসী বাংলাদেশিদের আমানত কিছুটা বেড়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক বছরে প্রবাসীদের সেভিংস একাউন্টে জমার পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ১০০০ কোটি টাকা।
তবে গত কয়েক বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ওয়েজ আর্নার্সদের ডিপোজিট বাড়ার বদলে উল্টো কমেছে।
২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর শেষে ৩৫৩৬ কোটি টাকার মতো সেভিংস ডিপোজিট ছিল রেমিটারদের। ২০১৯ সালে কিছুটা বাড়লেও তার পরের দুইবছর টানা কমেছে ডিপোজিট।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে ব্যাংকাররা বলেছেন, যে প্রত্যাশা নিয়ে প্রবাসীদের জন্য ডিপোজিট স্কিম খোলার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল, তার তুলনায় প্রবাসীদের আমানতের পরিমাণ কম। বিদেশে কর্মরত প্রবাসীদের অর্থ সঞ্চয় ও এ দেশে বিনিয়োগের লক্ষ্যে ডিপোজিট স্কিম খোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু বেশিরভাগ প্রবাসীরই সঞ্চয় করার প্রবণতা কম। তারা সাধারণত বাংলাদেশে নিজেদের পরিবারের খরচ মেটানোর জন্যই রেমিট্যান্স পাঠায়। এছাড়া, কিছু প্রবাসী আছেন যারা রেমিট্যান্সের অর্থ জমা করার পরিবর্তে জমি কেনা এবং ভবন নির্মাণের মতো স্থায়ী সম্পদে বিনিয়োগের দিকেই বেশি ঝুঁকছেন।
আর যারা ব্যাংকে আমানত রাখতে চান তারা পরিচিতি ও গ্রহণযোগ্যতার ভিত্তিতে ব্যাংক বেছে নেন। এ কারণে নতুন ব্যাংকগুলো প্রবাসীদের কাছ থেকে আমানত গ্রহণের ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে।
এছাড়া, সুদের হার হ্রাস এবং অন্যান্য সুবিধা কম থাকায় জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর কর্তৃক প্রবাসীদের জন্য চালু করা তিনটি বন্ডে নতুন বিনিয়োগে আগ্রহীর সংখ্যা কম বলে জানিয়েছেন তারা।
২০২০ সালের ৯ আগস্ট এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে প্রবাসীদের জন্য এক বছর বা তার বেশি মেয়াদের নতুন সেভিংস স্কিম চালুর নির্দেশ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ফরেইন এক্সচেঞ্জ পলিসি ডিপার্টমেন্ট।
বৈদেশিক মুদ্রায় অনুমোদিত ডিলার শাখার পাশাপাশি প্রবাসী আয় বিতরণ করে শাখাগুলোও এসব হিসাব খুলতে পারবে বলে জানিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
প্রবাসীরা যেন এসব হিসাব খুলতে আগ্রহী হয়, এ জন্য এই সঞ্চয় স্কিমের ওপর প্রতিযোগিতামূলক হারে সুদ দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল।
এ নির্দেশনার আগে প্রবাসীরা ব্যাংক হিসাব খোলার পাশাপাশি বন্ডে বিনিয়োগ করতে পারতেন। তবে সঞ্চয় স্কিমে টাকা জমা রাখার সুযোগ ছিল না।
টিবিএস এর প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, অন্তত আটটি স্থানীয় মালিকানাধীন তফসিলি ব্যাংক এখনও প্রবাসীদের জন্য কোনো সেভিংস স্কিম চালু করেনি।
বিভিন্ন ব্যাংকের সেভিংস প্যাকেজ
প্রবাসীদের জন্য আলাদা সেভিংস প্যাকেজ করায় সফলতা দেখিয়েছে বেশ কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংক।
এর মধ্যে প্রবাসীদের জন্য তিনটি সেভিংস প্যাকেজ চালু করেছে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক। জানা গেছে, ব্যাংকটি সেভিংস, ৫ ও ১০ বছর মেয়াদী ডিপিএস ও এফডিআর এই তিনটি আলাদা প্যাকেজ করেছে প্রবাসীদের জন্য।
এক মাস থেকে এক বছর মেয়াদী এফডিআরগুলোকে গ্রাহক চাইলেই অটো রিনিউয়াল করতে পারবেন।
এছাড়া প্রবাসীদের ডিপিএস জমার বিপরীতে ৮০% পর্যন্ত ঋণ সুবিধাও দিচ্ছে ব্যাংকটি।
বেসরকারি মিডল্যান্ড ব্যাংকে ইসলামী ব্যাংকিং আমানত প্রকল্পের অধীনে এমডিবি সালাম প্রবাসী সেভিংস একাউন্ট খোলার সুযোগ রয়েছে।
১০ হাজার টাকা জমা দিয়ে এ একাউন্ট খোলা যায়। প্রতিদিন ব্যালেন্স ৫ হাজার টাকার বেশি থাকলে দিনভিত্তিক প্রোফিট হিসাব করে বছরে দুইবার মোট প্রোফিট শেয়ার করা হয়।
এছাড়া এমডিবি ডিজিটাল প্রবাসী সেভিংস নামে তাদের আরেকটি প্যাকেজ রয়েছে। ওয়েবসাইটের মাধ্যমে পাসপোর্ট দিয়েই একজন প্রবাসী বিদেশে অবস্থান করেই এ একাউন্ট খুলতে পারে। সেইসঙ্গে ইন্টারনেট ব্যাংকিং এর মাধ্যমে লেনদেনও করতে পারে।
অন্যদিকে, ইসলামী ব্যাংকে মুদারাবা ফরেন কারেন্সি ডিপোজিট একাউন্ট খুলে সেখানে ফরেন কারেন্সি জমা করতে পারেন প্রবাসীরা। কমপক্ষে ১ হাজার ডলার জমা করতে হয় এই একাউন্ট খুলতে।
এছাড়া মুদরাবা এনআরবি সেভিংস বন্ড অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ৫-১০ বছর মেয়াদী বন্ডে ২৫ হাজার থেকে ১০ লাখ পর্যন্ত বিনিয়োগ করা যায়।
এছাড়া আরো কিছু ব্যাংক রয়েছে যারা সেভিংস প্যাকেজ ঘোষণা করে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স থেকে ডিপোজিট নিচ্ছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক এবং বেসরকারি খাতের ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক এবং মধুমতি ব্যাংক সহ আরও কয়েকটি ব্যাংক প্রবাসীদের জন্য সেভিংস প্যাকেজ ঘোষণা করেছে এবং তাদের রেমিটেন্স থেকে আমানত গ্রহণ করছে।
রেমিটারদের সেভিংস প্যাকেজ খুলে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক ভালো ডিপোজিট সংগ্রহ করতে পারছে উল্লেখ করে ব্যাংকটির এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "আমরা গ্রাহকদের থেকে ভালো রেসপন্স পেয়েছি বলেই ভিন্ন ভিন্ন প্যাকেজ করেছি।"
"রেমিট্যান্স যে এভাবে বাড়বে এটা অনেক ব্যাংকই আন্দাজ করতে পারেনি। ফলে, ব্যাংকগুলো সেভাবে তাদের নেটওয়ার্ক নির্মাণ করতে পারেনি। আমাদের নেটওয়ার্ক ভালো থাকার কারণে আমরা রেমিটারদের সেভিংস ডিপোজিটের আওতায় নিয়ে আসতে পেরেছি।"
রেমিটারদের উৎসাহিত করে তাদের সঞ্চয় বাড়ানো সম্ভব বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এনআরবি ব্যাংকগুলোতে আমানত গ্রহণের হার কম
২০১২ সালে বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ বাড়ানো ও বৈদেশিক বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার শর্তে কয়েকজন প্রবাসী বাংলাদেশি নাগরিকের উদ্যোগে করা তিনটি এনআরবি ব্যাংকের অনুমোদন দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
২০১৩ সালে ব্যাংকগুলো কার্যক্রম শুরু করলেও রেমিট্যান্স নিয়ে আসাসহ প্রবাসীদের জন্য সেভিংস প্যাকেজ খোলায় তাদের তেমন সক্রিয়তা নেই।
ব্যাংকগুলোর একটি এনআরবি কমার্সিয়াল ব্যাংক রেমিটারদের জন্য 'প্রবাসীর হাসি' নামে একটি সেভিংস প্যাকেজ খুলেছিল। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই প্যাকেজ চালুর দুই বছর পার হলেও ডিপোজিট তো একরকম নেই-ই, তার উপর একাউন্ট খোলার সংখ্যাও নগণ্য।
তাদের ওয়েবসাইট ঘুরেও প্রবাসীদের জন্য আলাদা কোনো সেভিংস প্যাকেজ পায়নি টিবিএস।
এনআরবি ব্যাংকে রেসিডেন্ট ফরেইন কারেন্সি ডিপোজিট অ্যাকাউন্ট খোলার সুযোগ থাকলেও প্রবাসীদের জন্য কোনো সেভিংস একাউন্টের তথ্য পাওয়া যায়নি।
অবশ্য প্রবাসী বাংলাদেশিদের অর্থায়নে প্রতিষ্ঠিত গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক একটি প্যাকেজ খুলেছে। এই ব্যাংকে ১ হাজার টাকা জমা দিয়ে মুদরাবা স্বদেশ সেভিংস অ্যাকাউন্ট খুলতে পারে প্রবাসীরা। এছাড়া এক লাখ থেকে এক কোটি টাকা পর্যন্ত বাই-মুয়াজ্জাল উৎসাহ বিনিয়োগ নিতে পারেন তারা।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রবাসীদের অর্থায়নে প্রতিষ্ঠিত হলেও ব্যাংকগুলো রেমিট্যান্স নিয়ে আসায় তেমন আগ্রহী নয়।
এর অন্যতম কারণ, তাদের ডিসট্রিবিউশন চ্যানেল অন্য ভালো ব্যাংকগুলোর মতো বিস্তৃত নয়। এছাড়া বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউজগুলোর সঙ্গেও সরাসরি চুক্তিও নেই অনেকের। ফলে অন্য ব্যাংকের সঙ্গে তাদের রেমিট্যান্স নিয়ে আসার জন্য চুক্তি করতে হয়। এসব কারণে ব্যাংকগুলোতে রেমিট্যান্সও আসছে কম, স্বাভাবিকভাবেই রেমিটারদের ডিপোজিটও কম খোলা হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনআরবি ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মামুন মাহমুদ শাহ টিবিএসকে বলেন, তারা রেমিট্যান্স প্রাপ্তি বাড়াতে নানাভাবে কাজ করছেন।
"গত ৪/৫ মাস ধরে আমরা ডোর টু ডোর ক্যাম্পেইন চালিয়ে যাচ্ছি। প্রেরকদের তাদের পরিবারকে ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠাতে উৎসাহিত করা হচ্ছে। পাশাপাশি, ভবিষ্যতের নিরাপত্তার জন্য রেমিটারদের সঞ্চয় স্কিমে টাকা জমা দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এসব উদ্যোগ নেওয়ায় আমরা এখন প্রবাসী সেভিংস স্কিমগুলোতে উপযুক্ত আমানত পাচ্ছি।"
একের পর এক সুবিধা কমানোয় প্রবাসী বন্ডেও বিনিয়োগ বাড়ছে না
১৯৮১ সালে এক আদেশে প্রবাসীদের জন্য ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ড চালু করা হয়। পরে সফলতা পাওয়ায় ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ড ও ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ড নামে আরো দুইটি বন্ড চালু করা হয়।
প্রথম দিকে এসব বন্ডে সুদের হার বিদেশি অন্য ব্যাংকের তুলনায় বেশি থাকায় এবং বন্ডে বিনিয়োগের বিপরীতে অন্য অনেক সুবিধা পাওয়ায় প্রবাসীরা এসব বন্ডে বিনিয়োগ করেছিল।
কিন্তু পরবর্তীতে সরকার সুদের হার কমানোসহ বিনিয়োগসীমা নির্ধারণ করে দেওয়ায় প্রবাসীরা বন্ডে বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত হয়েছে বলে জানিয়েছেন এসব বন্ডে বিনিয়োগকারীরা।
নানা বাধাবিপত্তিতে যে বিনিয়োগ কমছে সেটি সরকারও উপলব্ধি করছে।
গত ১৮ ডিসেম্বর বিশ্ব অভিবাসী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেছিলেন, বন্ডে বিনিয়োগ উৎসাহিত করার জন্য লিমিট তুলে দেওয়া উচিত। এতে বিনিয়োগের পরিমাণ আরও বাড়বে।
সুদের হার ও সুযোগ-সুবিধা কমানোর জেরে প্রবাসীরা এসব বন্ডে বিনিয়োগ কমাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রবাসী সিআইপি।
তিনি টিবিএসকে বলেন, বন্ডগুলোতে সুদের হার কমিয়ে আন্তর্জাতিক অন্য অনেক প্রতিষ্ঠানের প্রায় সমান করে ফেলা হয়েছে। সুদ বেশি না পাওয়া ও নিরাপত্তার অভাব বোধ করায় প্রবাসীরা দেশে ডলার বিনিয়োগের তুলনায় বিদেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিনিয়োগ করছেন।
প্রবাসীদের এসব বন্ডে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সুদ ও সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর দাবি করে এই প্রবাসী নেতা বলেন, "প্রবাসী বাংলাদেশিরা বিনা শর্তে এসব বন্ডে বিনিয়োগ করেন। তারা যদি এসব বিনিয়োগ তুলে নেন, তাহলে দেশ থেকে ডলার চলে যায়।"
"আমাদের দেশের ফরেইন কারেন্সি রিজার্ভ কমে যাওয়ার একটি কারণ এই বিনিয়োগ তুলে নেওয়া। এছাড়া নতুন করে বিনিয়োগও আসছে না। শ্রীলঙ্কা এখন ৩০% সুদ দিয়েও ফরেইন কারেন্সি পাচ্ছে না। আর আমরা সুদের হার কমিয়ে বিনিয়োগগুলো চলে যেতে দিচ্ছি," যোগ করেন তিনি।