অনিয়মের অভিযোগে সৌদির সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগ থেকে সরে আসতে চায় বিসিআইসি
আর্থিক কার্যক্রমে অস্বচ্ছতা, প্রকল্পের মূল কাজ শুরুর আগেই ব্যয় বৃদ্ধি, টেন্ডারে অনিয়ম ও খরচ না করেও কোটি কোটি টাকার খরচ পাস করিয়ে নেওয়ার অভিযোগ ওঠার পর, সিলেটের ছাতকে সৌদি-বাংলাদেশের যৌথ বিনিয়োগে নির্মিতব্য সৌদি-বাংলা ইন্টিগ্রেটেড সিমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড (এসবিআইসিসিএল) থেকে সরে আসতে চাইছে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন (বিসিআইসি)।
দুই দেশের সমন্বয়ে গঠিত জয়েন্ট ভেঞ্চার কোম্পানি (জেভিসি) প্রাথমিকভাবে ৩২১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয় এই প্রকল্পে; যেখানে বিনিয়োগের ৪০ শতাংশ বাংলাদেশ এবং বাকি ৬০ শতাংশ সরবরাহ করবে সৌদি আরব।
শিল্প মন্ত্রণালয় ও বিসিআইসি সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হসিনার সৌদি সফরের সময় এক চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে এই কারখানা তৈরির যৌথ উদ্যোগ নেওয়া হয়। চুক্তি অনুযায়ী, প্রতিদিন ১২ হাজার মেট্রিক টন ক্লিংকার ও ৩ হাজার মেট্রিক টন সিমেন্ট উৎপাদনের ক্ষমতাসম্পন্ন হবে কারখানাটি।
বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে বিসিআইসি এবং সৌদি আরবের পক্ষে ইঞ্জিনিয়ারিং ডাইমেনশন ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট এলএলসি বিনিয়োগ করছে এই প্রকল্পে। কারখানাটি তৈরি হবে ছাতক সিমেন্ট কারখানার পাশেই।
কিন্তু সম্প্রতি শিল্প মন্ত্রণালয়ের কাছে এক চিঠিতে, নানান অনিয়ম ও অসঙ্গতির কথা তুলে ধরে প্রকল্পটি থেকে সরে যেতে চাইছে বিসিআইসি। সংস্থাটি বলছে, এসব অনিয়মের কারণে উভয় দেশের বিনিয়োগ ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।
এসবিআইসিসিএল সূত্রে জানা যায়, যৌথ উদ্যোগের এই সিমেন্ট কোম্পানিটিতে বিসিআইসি'র ৫ জন এবং সৌদি বিনিয়োগকারী মনোনীত ৩ বাংলাদেশিসহ ৬ জন পরিচালক রয়েছেন।
কেমিক্যাল কর্পোরেশনের অভিযোগগুলো মূলত ওই তিন বাংলাদেশি পরিচালকের বিরুদ্ধে।
চিঠিতে বিসিআইসি জানায়, ওই ৩ পরিচালক বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান দিপন গ্রুপেরও পরিচালক। প্রতিষ্ঠানটি ইঞ্জিনিয়ারিং, কনস্ট্রাকশন, ইনভেস্টমেন্ট, প্রজেক্ট ডেভেলপমেন্ট, আইটি, শিপিং ও লজিস্টিকস সরবরাহের ব্যবসা করে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিসিআইসির এক পরিচালক যিনি এসবিআইসিসিএল-এরও পরিচালক, টিবিএসকে বলেন, "তারা তিনজন যে দিপন গ্রুপের পরিচালক, এটি তারা আগে প্রকাশ করেননি। যখন দিপন গ্রুপ ছাড়া আর কেউ টেন্ডার দাখিল করেনি এবং এই প্রতিষ্ঠানটিই কাজ পেল, তখনই খোঁজ নিয়ে জানা যায় এই তিন পরিচালক দিপন গ্রুপেরও পরিচালক। অর্থাৎ, নিজেরা মূল্যায়ন করে নিজেরাই নিজেদেরকে কাজ দিয়েছে। এটি পুরোপুরি অনিয়ম।"
চিঠিতে বিসিআইসির চেয়ারম্যান শাহ্ মো. ইমদাদুল হক বলেন, ইঞ্জিনিয়ারিং ডাইমেনশন ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট এলএলসি কর্তৃক মনোনীত দিপন গ্রুপের পরিচালকদের যৌথ মূলধনী কোম্পানি এসবিআইসিসিএল প্রকল্পের বিভিন্ন কার্যক্রম, সম্ভাব্য আর্থিক ব্যয়, ব্যবস্থাপনা বিধি বিধান ও স্বচ্ছতায় যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে।
"এতে সৌদি বিনিয়োগ এবং সরকারের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হওয়ার উচ্চ ঝুঁকি তৈরি হয়েছে," বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
সম্ভাব্যতা যাচাই নিয়ে সন্দেহ
জানা গেছে, প্রথমবারের ফিজিবিলিটি স্টাডিতে (সম্ভাব্যতা যাচাই) বিনিয়োগের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয় ৩২১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু প্রয়োজন না থাকলেও পরের বার আরও একটি ফিজিবিলিটি স্টাডি করা হয়; তবে এ নিয়ে বোর্ডের কোনো পরিচালকই সে সময়ে কোনো প্রশ্ন তুলেননি। কিন্তু যখন এই স্টাডিতে সিমেন্ট কারখানা তৈরির জন্য ব্যয় প্রায় দ্বিগুণ করে ৩২১ মিলিয়ন ডলার থেকে বাড়িয়ে ৬০৪ মিলিয়নের সুপারিশ করা হয়, তখন বিসিআইসি এটি নিয়ে প্রশ্ন তুলে।
এ বিষয়ে এসবিআইসিসিএলের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ জাবেদ ইকবাল বোর্ডকে জানান, দ্বিতীয় ফিজিবিলিটি স্টাডি করা হয়েছে মুম্বাইয়ের প্রতিষ্ঠান বিওই কন্সাল্টিং ফার্মের মাধ্যমে। কিন্তু স্টাডি রিপোর্টটি জমা দেওয়া হয়েছে এসবিআইসিসিএলের প্যাডে। যেখানে বিওই কন্সাল্টিং ফার্মের কারো কোনো স্বাক্ষর, প্রতিষ্ঠানটির সিল কোনোকিছুই নেই। যে কারণে বিসিআইসির পরিচালকদের এটি নিয়ে সন্দেহ বেড়ে যায় এবং তারা খোঁজখবর করতে থাকেন।
একইসঙ্গে এই ফিজিবিলিটি রিপোর্টে একটি লং কনভেয়ার বেল্ট (এলবিসি) (একটি ১৮ কিলোমিটার লম্বা ফিতা, যা দিয়ে একটি নির্দিষ্ট স্থান থেকে সরাসরি স্টোন সিমেন্ট কারখানায় প্রবেশ করবে) এর জন্য ১১৭ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ের কথা বলা হয়, যা প্রথম ফিজিবিলিটি স্টাডিতে ধরা হয়েছিল ৪৯.৮ মিলিয়ন ডলার।
কিন্তু স্টাডি রিপোর্টে এই ব্যয় দ্বিগুণেরও বেশি দেখানো হলেও এলবিসি টি কেমন হবে, তার কোনো চিত্র, ডিজাইন, প্রাক্কলিত ব্যয় ও বিল অফ কোয়ান্টিটি (বিওকিউ)-এর বিষয়ে বিস্তারিত কিছুই বলা হয়নি।
একইসঙ্গে এলবিসি কেনা ও স্থাপনের জন্য যে টেন্ডার করা হয়েছে, সেখানেও পাওয়া গেছে অনিয়মের চিত্র। এমনভাবে টেন্ডার করা হয়েছে, যেখানে শুধুমাত্র দিপন গ্রুপের সিস্টার কনসার্ন দিপন ইনফ্রাস্ট্রাকচার সার্ভিসের লিমিটেড (ডিআইএসএল) ছাড়া আর কোনো প্রতিষ্ঠান টেন্ডারই দাখিল করতে পারেনি।
বিসিআইসির অভিযোগ, সৈয়দ জাবেদ ইকবালের নেতৃত্বে দিপন গ্রুপের তিন পরিচালক বোর্ডে প্রভাব বিস্তার করে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত জোর করে পাস করিয়ে নিচ্ছেন, যে কারণে বিসিআইসর পরিচালকদের সঙ্গে তাদের বিভিন্ন বোর্ড মিটিং এ কথা কাটাকাটি ও হট্টগোলের ঘটনাও ঘটছে।
বিসিআইসির মতে, প্রকল্প শুরুর আগেই অযৌক্তিকভাবে খরচ বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই।
মন্ত্রণালয়ের তদন্তের বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি নন এমডি
এসবিআইসিসিএলের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ জাবেদ ইকবাল টিবিএসকে বলেন, "আমি মিডিয়াতে কোনো বক্তব্য দিতে চাই না। সৌদি পক্ষের বিনিয়োগকারী আমাদের কাছে কিছু জানতে চাইলে সেখানে আমি বলবো, বোর্ডে কথা বললো; এগুলো বোর্ডের অভ্যন্তরীণ বিষয়। আর এখানে কোনো ঝামেলা মনে হলে সরকারের তো বড় স্টেক রয়েছে, তারা কোর্টে যেতে পারে, আইনের আশ্রয় নিতে পারে, প্রেস কনফারেন্সও করতে পারে।"
শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব জাকিয়া সুলতানা জানান, তারা দুইভাবে বিষয়টি নিয়ে এগোচ্ছেন।
"প্রথমত, আমরা একটি তদন্ত দল গঠন করব এবং ফলাফলের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেব," রোববার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বলেন।
"যেহেতু এই ধরনের যৌথ বিনিয়োগের সঙ্গে দেশের ভাবমূর্তিও জড়িত, তাই আমরা বিডা (বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ)- এর সঙ্গে আলোচনা করেছি। আমরা পর্যায়ক্রমে সব পক্ষের সঙ্গেই আলোচনা করব," যোগ করেন তিনি।