চাপে দিশেহারা ভোক্তারা: ২০২২ সালে দাম বেড়েছে সব পণ্যের
চাল, আটা, ময়দা, মাছ-মাংস, তেল, লবণ, সাবান, কাঁচামরিচ থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য ও ব্যবহার্য ৫৬টি পণ্যের সবগুলোরই দাম বেড়েছে ২০২২ সালে, যেখানে ৫টি পণ্যের দাম ৬০ শতাংশের বেশি বেড়েছে বলে জানায় কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)।
শনিবার ক্যাব '২০২২ সালে ঢাকা মেগাসিটিতে মূল্যস্ফীতির চাপ' শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই প্রতিবেদনে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির একটি চিত্র তুলে ধরা হয়। এই মূল্য বৃদ্ধির হিসেবটি করা হয়েছে ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসের সঙ্গে তুলনা করে। ঢাকায় সাধারণ মানুষ ও নিম্ন আয়ের মানুষ প্রতিনিয়ত যেসব খাবার খায় ও পণ্য ব্যবহার করে সেরকম ৫৬টি পণ্যের তালিকা করে ক্যাব।
মূল্যবৃদ্ধির তালিকায় দেখা গেছে, ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসের তুলনায় সারা বছরে টমেটো, গাজর, মটরশুঁটি, শুকনো মরিচ ও পোশাকের দাম বেড়েছে ৬০.৮-৭৭.২৭ শতাংশ। আদা, সবুজ পেঁপে/কলা ও কাঁচামরিচের ক্ষেত্রে এই বৃদ্ধির হার ৩৮.৬৪-৪৭.৪৭ শতাংশ পর্যন্ত।
মূল্যবৃদ্ধির এই প্রভাব মোট চালের উপর খুব বেশি না হলেও ১৭.২২ শতাংশ বেড়েছে চিকন চাল ও ১০.০২ শতাংশ বেড়েছে মাঝারি মানের চালের দাম। এই সময়ে গমের আটা ও ময়দার দাম বেড়েছে ২৭ শতাংশের বেশি। আর এই আটা-ময়দার দামের প্রভাব পড়েছে বিস্কুট, কেক সহ প্রক্রিয়াজাত খাবারের বাজারে।
ক্যাবের হিসেবে দেখা গেছে, লবণের দাম সাধারণ ভোক্তা পর্যায়ে ৭.৫৯ শতাংশ বাড়লেও নিম্ন আয়ের মানুষের পর্যায়ে এই দামটা বেড়েছে ২৮.৭৯ শতাংশ। ভোজ্যতেলের দামও প্রায় ১৪ শতাংশের মত বেড়েছে।
এছাড়া দাম বেড়েছে মাছ, মাংস, ডিম, মুরগি, সব ধরনের দুধ, চিনি, আদা, রসুন, সাবান, রান্নার জ্বালানি, মশার কয়েল সহ সব পণ্যের।
ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, 'দ্রব্যমূল্য একবার বাড়লে যে তা কমে আসবে এমনটা আশা করা ঠিক নয়। তাই মানুষের আয় যাতে বাড়ে সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। বিশেষ করে কর্মসংস্থানের উপর গুরুত্বারোপ করতে হবে।'
তিনি বলেন, 'আমাদের দেশে আয় বৈষম্য বাড়ছে। তাই সরকারকে বৈষম্য কমাতে বিত্তবানদের আয়ের থেকে সাধারণ মানুষের আয় এবং নিম্নমধ্যবিত্তদের আয় বৃদ্ধিতে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলেও সংকট আরও বাড়বে।'
প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের গবেষণা পরিচালক ড. মাহফুজ কবির। তিনি বলেন, 'এনার্জি প্রাইসের আপওয়ার্ড ট্রেন্ড পণ্যের দাম ও মূল্যস্ফীতি বাড়াতে ভূমিকা রেখেছে। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে পণ্যমূল্য এবং পরিবহন খরচ বেড়েছে। এর প্রভাবে বেড়েছে উৎপাদন খরচ।'
তিনি বলেন, আমন মৌসুমে কৃষক ডিজেল দিয়ে চাষ করেছে। আন্তর্জাতিক বাজারের বাড়তি দাম ও দেশে সরবরাহ সংকটের কারণে সারের দাম বেশি ছিল। সবমিলে উৎপাদন খরচ বেড়েছে।
অন্যদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ডলারের বাজারে অস্থিরতার কারণে আমদানিকৃত আইটেমের দাম বেড়েছে। ফিনিশড প্রডাক্টের বাইরেও বিভিন্ন কাঁচামালের আমদানি মূল্য বেড়ে যাওয়ায় ফুড ও নন-ফুড আইটেমের উৎপাদন খরচ বেড়েছে বলেও জানান তিনি।
ড. মাহফুজ কবির বলেন, 'বাজারে চালের বাজারে একসময় ৫০-৫৫ জন মিলমালিক দাম বাড়াতে ভূমিকা রাখলেও এখন দুটি গ্রুপের কারণে বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। এক পক্ষে মিলমালিক, অন্য পক্ষে রয়েছেন চালের বাজারের কর্পোরেট ব্যবসায়ীরা। এরা প্রতিযোগীতা করছে কার আগে কে কিনবে।'
তিনি বলেন, 'চালের বাজার এখন মনোপলির স্থলে ডুয়োপলির দিকে যাচ্ছে। এই অবস্থায় পণ্যের দাম কখনো কমে না, শুধু বাড়ে। এ কারণে এখানে সরকারের পলিসি থাকা উচিত।'
২০২২ সালের প্রথম মাসের তুলনায় ঢাকায় গড় মূল্যস্ফীতি ১১.০৮ শতাংশ বেশি
ঢাকা মেগাসিটিতে ২০২২ সালের জানুয়ারী মাসের তুলনায় গড় মূল্যস্ফীতি সামগ্রিকভাবে ১১.০৮ শতাংশ বেশি ছিল। যেখানে নিম্ন আয়ের মানুষের ক্ষেত্রে এই হার ছিল ৯.১৩ শতাংশ বেশি।
ক্যাবের প্রতিবেদনে বলা হয়, এই সময়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার সামগ্রিকভাবে ১০.০৩ শতাংশ এবং নিম্ন আয়ের মানুষের ক্ষেত্রে ৭.৭৬ শতাংশ বেশি ছিল। তবে এর চেয়েও বেশি ছিল খাদ্য বহির্ভূত মূল্যস্ফীতি।
খাদ্য বহির্ভূত সামগ্রিক মূল্যস্ফীতির হার ১২.৩২ শতাংশ এবং নিম্ন আয়ের মানুষের ক্ষেত্রে তা ছিল ১০.৪১ শতাংশ বেশি।
এদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসেবে ২০২২ সালের গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৭.৭০ শতাংশ। যেখানে খাদ্য মূল্যস্ফীতির গড় ছিল ৭.৭৪ শতাংশ এবং খাদ্য বহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ছিল ৭.৫৯ শতাংশ। এই শহরের গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৭.২০ শতাংশ।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের গবেষণা পরিচালক ড. মাহফুজ কবির বলেন, ২০২২ সালের জানুয়ারির তুলনায় সাধারণ মূল্যস্ফীতি ফেব্রুয়ারী থেকে বাড়তে শুরু করে, যা আবার মে মাসে হ্রাস পায়। আবার জুন থেকে এটা বাড়তে শুরু করে। জ্বালানী তেলের মূল্য বৃদ্ধির প্রভাবে আগস্টে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। ডিসেম্বরের দিকে এটা আবার কিছুটা কমে আসে।
তিনি বলেন, 'গ্রামে সরকার নানা ধরনের খাদ্যবান্ধব, কর্মসংস্থান বান্ধব প্রগ্রাম চালাচ্ছে। যে কারণে তাদের উপর মূল্যস্ফীতি বেশি হলেও প্রভাবটা কম। কিন্তু শহরে যারা নিম্ন আয়ের মানুষ তাদের জন্য শুধুমাত্র ওএমএস (খোলাবাজারে খাদ্যপণ্য বিক্রি) ছাড়া আর কোন প্রগ্রাম নেই। কিন্তু তাদেরকে এই উচ্চ মূল্যস্ফীতির হাত থেকে বাঁচাতে হলে তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।'
একইসঙ্গে কৃষির উৎপাদন ব্যয় কমানোর জন্য সরকারকে ডিজেলে ভর্তুকি দেওয়ারও সুপারিশ করা হয় ক্যাবের এই অনুষ্ঠানে।