বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগর: দক্ষ জনবল গড়তে বেসরকারি উদ্যোগ
দেশের বৃহৎ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগরে (বিএসএমএসএন) দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে উঠছে বিভিন্ন কারিগরী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
শিল্প নগরের কারখানার চাহিদা বিবেচনায় এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চার মাস থেকে তিনবছর মেয়াদে প্রশিক্ষণ ও ডিপ্লোমা কোর্স চালু হচ্ছে।
বর্তমানে, চট্টগ্রাম জুড়ে প্রায় ৬৫টি বেসরকারি কারিগরি স্কুল এবং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে। কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো শিল্প নগরের জনবল চাহিদা পুরণে সক্ষম নয় বলে জানিয়েছেন বেসরকারি টেকনিক্যাল স্কুলের উদ্যোক্তারা।
দক্ষ জনবল গড়ে তুলতে এখনই উদ্যোগ না নিলে শ্রম বাজারে অন্য দেশের লোকবল প্রবেশ করবে বলে জানিয়েছেন তারা।
চট্টগ্রামের মিরসরাই, সীতাকুণ্ড এবং ফেনীর সোনাগাজী উপজেলায় প্রায় ৩০ হাজার একর জায়গা জুড়ে গড়ে উঠছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগর। এই শিল্প নগর পুরোদমে চালু হলে কর্মসংস্থান হবে ১৫ থেকে ২০ লাখ লোকের।
বেজার সহকারী প্রকৌশলী ফেরদৌস ওয়াহিদ বলেন, "বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগরে বর্তমানে চারটি শিল্প প্রতিষ্ঠান উৎপাদনে আছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে এশিয়ান পেইন্টস, ম্যাকডোনাল্ড স্টিল, নিপ্পন ম্যাকডোনাল্ড স্টিল এবং সামদুা কনস্ট্রাকশন। এসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করে প্রায় ৫০০ লোক।"
বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে উঠছে টেকনিক্যাল স্কুল, কলেজ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগরে (বিএসএমএসএন) দক্ষ জনবল তৈরি করতে বেসরকারি পর্যায়ে গড়ে উঠছে টেকনিক্যাল স্কুল। এরমধ্যে একটি হলো অপকা টেকনিক্যাল স্কুল। ২০২১ সালের ১ এপ্রিল কার্যক্রম শুরু করে স্কুলটি।
অপকা'র এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর মোহাম্মদ আলমগীর টিবিএসকে বলেন, "চার মাস মেয়াদে ইলেকট্রিক্যাল এবং ফ্যাশন ডিজাইনিং এর উপর প্রশিক্ষণ নিয়েছে ৪৫০ জন শিক্ষার্থী। প্রশিক্ষণ নেওয়া ৩৫০ জনের চাকরি হয়েছে বিএসএমএসএন সহ দেশের বিভিন্ন শিল্প কারখানায়।"
চলতি বছরের জুলাই থেকে মিরসরাইয়ের নিজামপুর এলাকায় যাত্রা শুরু করবে একটি টেকনিক্যাল স্কুল। ২০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে ইলেকট্রিক, ওয়েল্ডিং, সহ ৫ টি ট্রেডে ৬ মাস মেয়াদী প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।
রাবার বাগান মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ কামাল উদ্দিন মিরসরাই ইকোনোমিক জোনে দক্ষ জনবল গড়ে তুলতে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু করছেন।
এছাড়া মিরসরাইয়ের মলিয়াইশ এলাকায় গড়ে উঠছে ডক্টর মুহাম্মদ কামাল উদ্দিন টেকনিক্যাল এন্ড ইন্জিনিয়ারিং কলেজ। সর্বমোট তিন একর জায়গা নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি চালুর পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
ওই স্থানে রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল এন্ড কলেজ নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
ডক্টর মুহাম্মদ কামাল উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, "তিন বছর দীর্ঘমেয়াদী কোর্স ও এক বছরের স্বল্প মেয়াদী কোর্স চালুর পরিকল্পনা রয়েছে। শীঘ্রই এই টেকনিক্যাল এন্ড ইন্জিনিয়ারিং কলেজের যাত্রা শুরু হবে।"
গড়ে উঠছে সরকারি কারিগরি স্কুল
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগরে দক্ষ মানব সম্পদ গড়ে তুলতে ইকোনোমিক জোন এরিয়ায় ১০ একর জায়গায় একটি টেকনোলজি সেন্টার গড়ে তুলছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
প্লাস্টিক, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য এবং ফুটওয়্যার রপ্তানি পণ্য বহুমুখীকরণ, দক্ষ জনবল তৈরি ও কারিগরি কৌশল উন্নয়নের লক্ষ্যে মিরসরাই ইকোনমিক জোনে এই টেকনোলজি সেন্টার স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় এক্সপোর্ট কম্পিটিটিভনেস ফর জবস প্রজেক্টের আওতায় ১০ একর জমির ওপর প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে ৯৪১ কোটি টাকা ব্যয়ে ৬ বছরে এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে।
প্রকল্পের ডেপুটি ডিরেক্টর নজরুল ইসলাম আজাদ টিবিএসকে বলেন, বঙ্গবন্ধু শিল্প নগরে টেকনোলজি সেন্টার অবকাঠামোর কাজ চলমান আছে।
এছাড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয় মিরসরাইয়ে একটি কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের পরিকল্পনা করছে বলে জানিয়েছেন মিরসরাই উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির।
তিনি বলেন, "শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা ইতোমধ্যে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল এলাকা পরিদর্শন করেছেন।"
বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথোরিটি (বিডা)'র পাবলিক রিলেশন অফিসার প্রশান্ত কুমার মণ্ডল টিবিএসকে বলেন, দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার জন্য বিডার ৪৯ কোটি টাকার একটি প্রকল্প ছিলো। এই প্রকল্পের অধীনে বাংলাদেশে ২৪ হাজার উদ্যোক্তা তৈরি হয়। প্রকল্পটির কাজ এর মধ্যে শেষ হয়েছে।
পর্যাপ্ত নয় বিদ্যমান প্রশিক্ষণ কেন্দ্র
চট্টগ্রামে ছোট বড় মিলিয়ে বেসরকারি পর্যায়ে প্রায় ৬৫টি টেকনিক্যাল স্কুল ও ট্রেনিং সেন্টার রয়েছে। এরমধ্যে চট্টগ্রামে টেকনিক্যাল ইন্সসিটিউট, স্কুল এন্ড কলেজে ডিপ্লোমা কোর্স চালু আছে প্রায় ১৬টি প্রতিষ্ঠানে। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে বছরে গড়ে ৩ হাজার শিক্ষার্থী বের হন।
১৬টি প্রতিষ্ঠান ছাড়া বাকিগুলোতে কম্পিউটার সহ বিভিন্ন বিষয়ে স্বল্প মেয়াদী প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এছাড়া চট্টগ্রামে সরকারি পলিটেকনিক আছে তিনটি।
বেসরকারি টেকনিক্যাল স্কুলের উদ্যোক্তার জানান, চট্টগ্রামে যেসব পলিটেকনিক কলেজ, ইন্সটিটিউট রয়েছে এসব প্রতিষ্ঠানগুলো মিরসরাই ইকোনোমিক জোনে ৩০ ভাগের এক ভাগ জনবল সরবরাহ করতে পারবে না। যেভাবে ইকোনোমিক জোন গড়ে উঠেছে সেই তুলনায় টেকনিক্যাল স্কুল গড়ে উঠেনি। ফলে কারখানাগুলো যখন উৎপাদন শুরু করবে তখন দক্ষ জনবলের তীব্র সংকট তৈরি হবে।
প্রাইভেট পলিটেকনিক উদ্যোক্তারা বলেন, দক্ষ জনবল গড়ে তুলতে বেসরকারি ইন্সটিটিউটগুলোকে প্রণোদনা, সহজ শর্তে ঋণ দেওয়ার প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে সরকারকে। এসব উদ্যোগ নিলে ইন্সটিটিউটগুলো ইকোনোমিক জোনে দক্ষ জনবল সরবরাহ করতে পারবে।
বাংলাদেশ প্রাইভেট পলিটেকনিক উদ্যোক্তা সমিতির সাধারণ সম্পাদক এবং ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজির চেয়ারম্যান আহসান হাবিব বলেন, "আগে জব ফেয়ার আয়োজন করে কোম্পানির মালিকদের আনা যেতো না। এখন কোম্পানি মালিকরা দক্ষ জনবলের জন্য বিভিন্ন টেকনিক্যাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঘুরছে।"
"মিরসরাই ইকোনোমিক জোনে কারাখানায় ইলেকট্রিক্যাল, মেকানিক্যাল পর্যায়ে লোকবলের জন্য কিছুদিন আগে এক বিদেশি কোম্পানি আমার কাছে আসে। সরকার এখনই উদ্যোগ না নিলে চাকরির বাজার অন্য দেশের শ্রমিকরা দখল করবে," যোগ করেন তিনি।
যদিও সরকার একটি ন্যাশনাল স্কিলস ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (এনএসডিএ) গঠন করেছে, এটি এখনও পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি।
এনএসডিএ'র পরিচালক (পরিকল্পনা ও শিল্প সংযোগ) ড. মো. আনোয়ারুল হক বলেন, "কোন ট্রেডে কী ধরনের জনবল প্রয়োজন সেটি নির্ধারণে শিল্প দক্ষতা পরিষদ গঠন করে আমরা ট্রেনিং কারিকুলাম সিলেবাস তৈরির কাজ করছি। এই কারিকুলাম অনুযায়ী প্রশিক্ষণ দিয়ে এনএসডিএ স্কিলড ম্যানপাওয়ার তৈরি করে দেবো।"
তিনি আরো বলেন, ট্রেনিং সেন্টারগুলো কী পড়াবে, কিভাবে পড়াবে সেগুলো রেগুলেটরি অথোরিটি হিসেবে এনএসডিএ মনিটরিং করবে।