জনবলের অভাবে আরো নির্ভুল পূর্বাভাস দিতে ব্যর্থ হচ্ছে আবহাওয়া বিভাগ
আরো নির্ভুল এবং আধুনিক উপায়ে পূর্বাভাস দেওয়ার লক্ষ্যে ২০১৬ সাল থেকে ২২৫টি স্বয়ংক্রিয় আবহাওয়া স্টেশনসহ ব্যয়বহুল আধুনিক প্রযুক্তি রয়েছে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের অধীনে।
কিন্তু প্রশিক্ষিত আবহাওয়াবিদ ও প্রকৌশলীর অভাবে এসব প্রযুক্তি যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারছে না তারা।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা আবহাওয়া অধিদপ্তরের চাহিদাপত্র সংশোধন, সংযোজন ও যাচাইয়ের দীর্ঘ প্রক্রিয়ার পর, চলতি বছরের এপ্রিলে এ অধিদপ্তরে জনবল নিয়োগের জন্য সুপারিশপত্র দেয় প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিবদের একটি কমিটি।
আবহাওয়া অধিদপ্তরে ৯৪ জন বিভিন্ন ক্যাটাগরির আবহাওয়াবিদ এবং ২৬ জন প্রকৌশলীসহ ১৯২টি পদ তৈরির সুপারিশ করা হয়।
অধিদপ্তরটি যদিও কম সংখ্যক জনবল নিয়ে ও নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার না করতে পেরে হিমশিম খাচ্ছে, এ সমস্যা সমাধানের জন্য এখনও কোনো সরকারি আদেশ জারি করা হয়নি।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের অধীনে রামগতি অবজারভেটরি স্টেশন পরিচালনা করছেন মাত্র দু'জন কর্মী; যেখানে কাজ করার কথা পাঁচজনের। একইভাবে চাঁদপুর স্টেশনে সাতজনের কাজ করার কথা থাকলেও, এই স্টেশনে কাজ করছেন মাত্র দু'জন। চলতি বছরের জুলাইয়ের মাঝামাঝিতে সীতাকুণ্ড স্টেশনে একজন কর্মকর্তার বদলি হয়। এর আগ পর্যন্ত একই অবস্থার ছিল সেখানেও।
এই তিনটি স্টেশনের প্রতিটিতে একাধিক স্বয়ংক্রিয় আবহাওয়া স্টেশন ইনস্টল করা আছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের যে ৬২টি স্টেশন জনবল ঘাটতিতে দুরাবস্থার মধ্যে আছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে এ তিনটি স্টেশনও।
আবহাওয়া অফিসের বেশ কয়েকজন আবহাওয়াবিদ এবং প্রকৌশলী বলেছেন, একটি অবজারভেটরি স্টেশন তিন শিফটে চব্বিশ ঘণ্টা চলে। জনবল সংকটের কারণে তাদের অতিরিক্ত চাপ নিয়ে দিনে আট ঘণ্টার বেশি কাজ করতে হয়।
আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ, জলের উচ্চতা পরিমাপ এবং লবণাক্ততার কারণে হওয়া ক্ষতি মূল্যায়নের মাধ্যমে পূর্বাভাসের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য কমপক্ষে ২২৫টি স্বয়ংক্রিয় আবহাওয়া স্টেশন ইনস্টল করা হয়েছে। এর মধ্যে ১২৫টি স্থাপিত হয়েছে কৃষি-ভিত্তিক আবহাওয়ার পূর্বাভাসের জন্য; ৩৫টি স্টেশনে প্রচলিত উপায়ের পরিবর্তে উন্নত পূর্বাভাসের জন্য প্রতিস্থাপিত নতুন স্টেশন; এবং ৬৫টি হলো অপটিক্যাল রেইন গেজ।
২৪৫.৮৭ কোটি টাকার প্রকল্পের আওতায় স্টেশনগুলো স্থাপন করা হয়েছে। এ প্রকল্পের জন্য বিশ্বব্যাংক ২১৭.৫৮ কোটি টাকা অর্থায়ন করেছে।
প্রকল্পটির কাজ পুরোপুরি শেষ হলে, এসব স্বয়ংক্রিয় আবহাওয়া স্টেশন থেকে (প্রতি ১০ মিনিটে ইনপুট) ডেটা বিশ্লেষণ করতে পারবে ঢাকায় অবস্থিত আবহাওয়া অধিদপ্তরের সদর দপ্তর। কমপক্ষে ৫০টি উচ্চ-পারফরম্যান্স পিসি ক্লাস্টারিং সিস্টেমের মাধ্যমে এ বিশ্লেষণকাজ চলবে দপ্তরে। এর মাধ্যমে ১০ দিন আগে থেকেই চরম পরিস্থিতির পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব হবে।
এছাড়া, ২০৮.৫৭ কোটি টাকা ব্যয়ের আরেকটি প্রকল্পের অধীনে অধিদপ্তরটি ঢাকা ও রংপুরে আবহাওয়া সংক্রান্ত রাডার সিস্টেম স্থাপন করেছে। এর মাধ্যমে কালবৈশাখী, টর্নেডো, অতিবৃষ্টি এবং ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস সময়মতো দেওয়া যাবে।
এছাড়াও, ২০১৬ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে, আবহাওয়া অফিস সেন্টমার্টিন ও কুতুবদিয়ায় সমুদ্র পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা এবং ঢাকা, রাজশাহী, খুলনা, চট্টগ্রাম এবং সিলেটে কার্বন প্রোফাইলার স্থাপন করেছে।
তবে, প্রযুক্তিগতভাবে উন্নতি হলেও, দক্ষ জনবল নিয়োগের বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে; ফলে যথাযথভাবে ব্যবহার করা যায়নি এসব প্রযুক্তি।
২০১৭ সাল থেকে প্রতিবছর যথেষ্ট সংখ্যক (কমপক্ষে ১৫ জন) দক্ষ কর্মচারি অবসর নেওয়া সত্ত্বেও, আবহাওয়া অফিস নতুনভাবে কোনো নিয়োগ কার্যক্রম চালায়নি বা কোনো বিদ্যমান কর্মচারিকে পদোন্নতি দেয়নি।
২০২২ সালের মার্চ মাসে অধিদপ্তরের আবহাওয়া পূর্বাভাসে একটি হাই-ইমপ্যাক্ট ওয়েদার অ্যাসেসমেন্ট টুলকিট সংযুক্ত করা হয়। এই টুলকিট নাসার পৃথিবী-পর্যবেক্ষণকারী স্যাটেলাইটগুলোতে ইন্টিগ্রেট করা আছে। মূলত বজ্রপাত, উচ্চ বৃষ্টিপাতের হার, শিলাবৃষ্টি এবং অন্যান্য আবহাওয়াজনিত বিষয়ের সম্ভাব্য পূর্বাভাস ৫৪ ঘণ্টা আগেই দেওয়ার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে এই টুলকিট।
কিন্তু পর্যাপ্ত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে টুলকিটটি অকার্যকর হয়ে পড়েছে। আবহাওয়া অফিসের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, জনবলের অভাব পূরণ করা না হলে নতুন যন্ত্রপাতি, এমনকি স্বয়ংক্রিয় আবহাওয়া স্টেশনগুলোও পর্যায়ক্রমে অকার্যকর হয়ে পড়বে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আজিজুর রহমানও বলেছেন, অটোমেশনের পাশাপাশি পর্যাপ্ত জনবল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, "প্রযুক্তিগুলোকে অন্তত সার্বক্ষণিক সচল রাখার জন্য দক্ষ জনবল থাকতে হবে।"
২০১৫ সালে প্রয়োজনীয় নিয়োগ বিধিসহ আবহাওয়া অফিসের অর্গানোগ্রামকে আপগ্রেড করার জন্য জোরালোভাবে সুপারিশ করেছিল প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এ সুপারিশ গ্রহণ করে।
এরপর থেকে জনপ্রশাসন, আইন এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয়ের মধ্যে অর্গানোগ্রামের আপগ্রেডের বিষয়ে প্রস্তাবনা এবং সংশোধনের জন্য বেশ কয়েকটি চিঠি আদান-প্রদান করা হয়েছে। ১৯২টি নতুন পদসহ অধিদপ্তরে ১,৩৩৮ টি পদের নতুন অর্গানোগ্রাম সুপারিশ করেছে প্রশাসনিক উন্নয়ন বিষয়ক সচিবদের কমিটি। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন প্রত্যাশিত ফলাফল নেই।
অধিদপ্তরের পরিচালক চলতি মাসের মধ্যে নতুন অর্গানোগ্রাম চূড়ান্ত হওয়ার আশাব্যক্ত করলেও নতুন নিয়োগ বিধি সম্পর্কে কোনো আপডেট নিশ্চিত করেননি তিনি।
এদিকে, জনবল নিয়োগে দীর্ঘ বিলম্ব হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ সুবিদ আলী ভূঁইয়া।
গত ৩১ জুলাই তিনি বলেন, "কমিটি যথাযথভাবে উচ্চ প্রযুক্তিগত বিভাগে জনবল ঘাটতির কথা উল্লেখ করেছে। এটি দুর্ভাগ্যজনক যে আট বছরেও এই ঘাটতি কমানো যায়নি। আমরা এ কাজে বিলম্বের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দায়বদ্ধ করব।"
আবহাওয়ার ধরন এবং জলবায়ু পরিবর্তন হতে থাকায়, জীবন ও সম্পদের সুরক্ষায় প্রাথমিক সতর্কতা খুবই জরুরি; আর এজন্য চাই নির্ভুল আবহাওয়ার পূর্বাভাস।
এমনকি আইন অনুযায়ীও নাগরিকদেরকে নির্ভুল পূর্বাভাস দিতে বাধ্য আবহাওয়া অধিদপ্তর; কিন্তু এজন্য দরকার একটি সম্পূর্ণভাবে কার্যকরী অধিদপ্তর।