গ্যাস সংকট দক্ষিণ এশিয়ার দুর্বল অর্থনীতিগুলোকে আরো দুর্ভোগে ফেলেছে
আর মাত্র মাস দেড়েক, তারপরই শুরু হবে পবিত্র রমজান। এই সময়টা বিভিন্ন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের মতো- পাকিস্তানেও কেনাকাটার সর্বোচ্চ সময়। কিন্তু, মুখে হাসি নেই দেশটির খুচরা বিক্রেতাদের। এই খাতের জোট নেতারা ব্যতিব্যস্ত সময় পার করছেন একের পর এক বৈঠক করে। বৈঠকে সরকারি কর্তাদের রাত সাড়ে ৮টার মধ্যে দোকানপাট বন্ধের আদেশ শিথিল করার অনুরোধ জানাচ্ছেন। এই আদেশ সরকার জারি করেছে, জ্বালানি বাঁচানোর লক্ষ্যে। খবর রয়টার্সের
পুরুষদের পোশাক বিক্রির একটি প্রতিষ্ঠান রয়্যাল ট্যাগ- এর প্রধান নির্বাহী তারিক মাহবুব সরকারকে দেওয়া এক চিঠিতে লিখেছেন, বার্ষিক খুচরা বিক্রিবাট্টার ৪০ শতাংশ হয় মাহে রমজানের ৩০ দিনে। আর রাত ৮টা থেকে ১০টার মধ্যেই মার্কেট ও মলগুলোয় ক্রেতা সমাগম বেশি থাকে। 'তার আগেই দোকান বন্ধ করলে ৩০-৪০ লাখ মানুষ চাকরি হারাতে পারে'।
খুচরা বিক্রয় খাতের এই গভীর উদ্বেগ – পাকিস্তানের অর্থনীতিতে আমদানিকৃত গ্যাসের স্বল্পতার প্রভাবকেই তুলে ধরছে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমাতে বাধ্য হয়েছে কর্তৃপক্ষ, পাকিস্তানের দুর্বল অর্থনীতির ওপর যা প্রবল আঘাত হেনেছে। তার সঙ্গে চড়া মূল্যস্ফীতি, স্থানীয় মুদ্রার মান পতনের যন্ত্রণা তো আছেই। দক্ষিণ এশিয়ার আরেক দেশ– বাংলাদেশও কমবেশি একই সমস্যার শিকার।
গত বছরের গ্রীষ্মে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে ব্যাপক লোডশেডিং হয় জ্বালানি ও ডলার সংকটে; এই গ্রীষ্মেও যেন সেই পরিস্থিতি দেখা না দেয় তারই আপ্রাণ চেষ্টা করছে দুই দেশ। কিন্তু, বিভিন্ন শিল্পের কর্মকর্তা ও বিশ্লেষকরা বলছেন, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি ব্যাপক হারে কমায় এবছরে আরো বাজে রূপ নিতে চলেছে বিদ্যুৎহীনতা।
বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের ওপর ব্যাপক নির্ভরশীল পাকিস্তান ও বাংলাদেশ। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ইউরোপ রাশিয়া থেকে গ্যাস আমদানি কমিয়ে মধ্যপ্রাচ্য থেকে এলএনজি ক্রয় বাড়ায়। এশিয়ার বাজার থেকেও তারা উচ্চ মূল্যে চালান কিনেছে। এতে এলএনজির দাম এতোটা আকাশচুম্বী হয় যে পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে এলএনজি আমদানি হ্রাস করতে হয়।
জ্বালানি গ্যাস বাণিজ্যের পরামর্শক সংস্থা এফজিই'র বিশেষজ্ঞ পূর্না রাজেন্দ্র বলেন, 'স্পট এলএনজির উচ্চ দাম এবং স্থানীয় উৎপাদন কমে আসায় গ্যাস-পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে সমস্যার মধ্যেই থাকবে পাকিস্তান। তাই ২০২৩ সালে আমরা সেখানে বিদ্যুৎ বিভ্রাট আরো ব্যাপক হওয়ার আশঙ্কা করছি'।
আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম গত বছরের রেকর্ড উচ্চতা থেকে কমেছে। কিন্তু, নিজ নিজ মুদ্রার অবমূল্যায়নের কারণে অতি-হিম এই জ্বালানির দাম এখনও বেশ ব্যয়বহুলই বলতে দক্ষিণ এশিয়ার ক্রেতাদের জন্য। ডলার সংকটে থাকায়, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের পক্ষে এবছর এলএনজি আমদানি বৃদ্ধিও দুরুহ হবে।
#পাকিস্তানে দুর্দশার অন্ত নেই
পাকিস্তানের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের এক-তৃতীয়াংশ হয় গ্যাস থেকে; অথচ তলানি ছুঁই ছুঁই বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ। ফলে জ্বালানি আমদানি করার অর্থ যোগানই এক মহাসমস্যা ইসলামাবাদের সামনে।
জাহাজের গতিবিধি অনুসরণ বা ট্র্যাক করে কেপলার নামক একটি সংস্থা। তাদের তথ্যমতে, ২০২২ সালে পাকিস্তানে এলএনজি আমদানি আগের বছরের চেয়ে ১৭ শতাংশ কম হয়েছে। পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন ছিল গত বছরের আমদানি চিত্র।
ফলস্বরূপ; ২০২২ সালের প্রথম ১১ মাসে পাকিস্তানে গ্যাস-ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৪.৪ শতাংশ পতন হয়। যদিও এসময়ে সার্বিক উৎপাদন (অন্যান্য উৎস থেকে) ১.৮ শতাংশ বেড়ে ১২৯ গিগাওয়াট ঘণ্টায় দাঁড়ায় বলে জ্বালানি বিষয়ক চিন্তক সংস্থা এম্বারের তথ্যসূত্রে জানা গেছে।
তবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে মোট সক্ষমতা ছিল দেশটির- তার চেয়ে কম হয়েছে উৎপাদন। বাড়তি চাহিদা মেটানোর জন্যও যা যথেষ্ট ছিল না। এজন্য জ্বালানি স্বল্পতাই দায়ী বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্লেষক ও সরকারি কর্মকর্তারা। একারণে গত বছরের শেষ ছয় মাসে দেখা দেয় শোচনীয় অবস্থা। এ সময়ে প্রতি সপ্তাহে লাগাতার কয়েক ঘণ্টাব্যাপী বিদ্যুৎহীন থাকতে হয় গ্রাহকদের।
উৎপাদন বাড়ানোর পথে একটি প্রধান সমস্যা হলো– দেশটির তেল-চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বেশ পুরোনো এবং তাদের সক্ষমতা সীমিত, তাছাড়া এগুলো পরিচালনার খরচও গ্যাস-চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের চেয়ে বেশি বলে জানান পাকিস্তানের জ্বালানিমন্ত্রী খুররম দস্তগীর খান।
জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্যউপাত্ত নিয়ে বার্তাসংস্থা রয়টার্সের নিজস্ব হিসাব অনুসারে, ২০২০ এ সমাপ্ত অর্থবছরে পর্যাপ্ত এলএনজি থাকলে পাকিস্তানের বিদ্যুৎ উৎপাদন আরো ১.২৫ শতাংশ বেশি হতো।
তবে জুলাইয়ের পর থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ বেড়ে যায়। খর গ্রীষ্মের এই সময়ে বিদ্যুৎ চাহিদা সর্বোচ্চ হতে থাকে বলে জানান কর্মকর্তারা। চাহিদার ফলে এলএনজি সংকটও তীব্র হয়ে ওঠে। বর্তমানে দেশটির চারটি বৃহৎ এলএনজি-চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে মাত্র দুটি সচল রয়েছে।
দস্তগীর রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, 'অন্য সব গ্রীষ্মকালের মতো এবারের গ্রীষ্মও কঠিন সময় হবে; কারণ আমরা ক্রয় সক্ষমতা ও প্রাপ্যতার মাঝখানে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করছি'।
বাংলাদেশকেও সংগ্রাম করতে হচ্ছে
বাংলাদেশে দুই-তৃতীয়াংশ বিদ্যুৎ গ্যাস পুড়িয়ে উৎপাদন করা হয়। এদেশেও পাকিস্তানের প্রবণতা দেখা দেওয়ার শঙ্কা রয়েছে বলে জানান জ্বালানি পরামর্শক সংস্থা উড ম্যাকেঞ্জির বিশ্লেষক রাঘব মাথুর।
২০২২ সালে বাংলাদেশের এলএনজি আমদানিতে আগের বছরের চেয়ে ১৪ শতাংশ পতন দেখা গেছে বলে জানাচ্ছে কেপলার, এতে চাহিদা বৃদ্ধির সময়ে বিদ্যুতের উৎপাদন কমে যায়।
এতে গত ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত ৯২ দিনের মধ্যে ৮৫ দিনই লোডশেডিং করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ গ্রিড পরিচালক সংস্থার তথ্য বিশ্লেষণ করে এ তথ্য জেনেছে রয়টার্স। সে তুলনায়, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত মাত্র দুইদিন বাধ্য হয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রেখেছিল কর্তৃপক্ষ।
বাণিজ্যিক কার্যক্রম তথা শিল্প পর্যায়ে তুমুল আঘাত হানে বিদ্যুৎ ঘাটতি। ফলে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি শিল্প তৈরি পোশাক খাতও এতে প্রভাবিত হয়। এখাতের শীর্ষ ক্রেতা ব্রান্ড ওয়ালমার্ট, গ্যাপ ইনকর্পোরেশন, এইচঅ্যান্ডএম এবং জারা-র কাছে রপ্তানিও এতে ব্যাহত হয়েছে।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন- বিজিএমইএ গত মাসে সরকারকে দেওয়া এক চিঠিতে জানিয়েছে, 'গার্মেন্টস শিল্পের জন্য টিকে থাকাই মুশকিল হয়ে গেছে'। চিঠিতে সরকারের প্রতি বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ নিয়মিত করার পাশাপাশি গ্যাসের মূল্য কমানোর দাবি করা হয়।
বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের জন্য সুলভ হওয়ার সম্ভাবনা কম বলেই জানাচ্ছেন বিশ্লেষকরা। এর পেছনে ভূমিকা রাখবে চলতি বছরে চীনের এলএনজি ক্রয়। এতে দাম আরো ঊর্ধ্বমুখী হবে।
জ্বালানি বাজার গবেষক সংস্থা- রিস্টার্ড এনার্জির আভাস দিয়েছে, চলতি বছরে এশিয়ার বাজারে প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজির দাম গড়ে ৩২ ডলার থাকবে। সে তুলনায়, স্পট মার্কেটে ২০ ডলার এমএমবিটিইউ থাকলেই তা গ্রহণযোগ্য মূল্য হতে পারে বলে মতপ্রকাশ করেন বাংলাদেশের জ্বালানি উপদেষ্টা।
চলতি বছর স্পট মার্কেট বা খোলাবাজার থেকে মাত্র দুটি এলএনজি চালান ক্রয়ের দরপত্র জারি করেছে বাংলাদেশ। পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা রয়টার্সকে বলেন, এরমধ্যে প্রায় ১৯ ডলার এমএমবিটিইউ দরে একটি পেয়েছে টোটালএনার্জি।
ওই কর্মকর্তারা বলেন, বাংলাদেশ স্পট বাজার থেকে আরো এলএনজি কার্গো কিনতে চায়; পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি ক্রয় চুক্তিতেও আগ্রহী পাপুয়া নিউ গিনি এবং ব্রুনাইয়ের সাথে। তবে এমন চুক্তি করা যাবে কিনা সেবিষয়ে সন্দেহ পোষণ করেছেন বিশ্লেষকরা।
উড ম্যাকেঞ্জির বিশেষজ্ঞ মাথুর মনে করেন, বাংলাদেশ বা পাকিস্তানের উচ্চ দামে এলএনজি কেনার সক্ষমতা নেই।
বিকল্প জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিষয়েও উদ্বিগ্ন উভয় দেশের ব্যবসা খাত। রয়্যাল ট্যাগের সিইও মাহবুব ধারণা করছেন, কর্তৃপক্ষ কেনাকাটার সর্বোচ্চ সময়ে দোকানপাট বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় খুচরা বিক্রিবাট্টা ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যাবে।
তিনি বলেন, 'আমাদের আশঙ্কা এর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে মোট দেশজ উৎপাদন- জিডিপি, কর্মসংস্থান, ও কর সংগ্রহে। এতে পুরো সরবরাহ চক্রই ব্যাহত হবে'।