কারাবন্দীদের মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত সরকারের সঙ্গে আলোচনা নয়: পিটিআই
সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের মুক্তি এবং সরকারের পদত্যাগের দাবিতে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) ডাকা বিক্ষোভে দিনভর উত্তাল পাকিস্তান। দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলেও দেশটির রাজধানী ইসলামাবাদে উত্তপ্ত পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
এদিকে বিক্ষোভের জেরে হামলা ও সংঘর্ষে এ পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চার সদস্য নিহতের খবর পাওয়া গেছে। আহত হয়েছেন একশোরও বেশি পুলিশ সদস্য, যাদের বেশিরভাগেরই অবস্থা গুরুতর। হামলা হয়েছে একাধিক গণমাধ্যমের কার্যালয়েও।
রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত সরকারের সঙ্গে আলোচনা নয়
ডনের খবরে বলা হয়েছে, পিটিআই গতকাল সোমবার জানিয়েছে, কারাগার থেকে তাদের নেতা-কর্মীদের মুক্তি ও অন্যান্য দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তারা সরকারের সঙ্গে কোনো আলোচনায় বসবেন না।
খাইবার পাখতুনখোয়ার মুখ্যমন্ত্রী আলী আমিন গান্দাপুর এক্সে (সাবেক টুইটার) একটি ভিডিও শেয়ার করেছেন। ভিডিওটিতে তাকে নেতা-কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে ডি-চক অভিমুখে যেতে দেখা যায়। সেই ভিডিওতে 'আগে মুক্তি, পরে আলোচনা' হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করা হয়েছে।
গান্দাপুর বলেন, ইমরান খান সবসময় শান্ত থাকার ও আইনের শাসন বজায় রাখার কথা বলতেন। সেইসঙ্গে তিনি যারা ভুল কাজকে উসকে দিতে পারেন, তাদের বিষয়ে সাবধান থাকতে জনগণকে সতর্ক করতেন।
তিনি জোর দিয়ে বলেন, 'ইমরান খান যতক্ষণ না নির্দেশ না দেন […] আমাদের তাকে (ইমরান) রক্ষা করতে হবে।'
'আমরা শান্ত। আসুন, আমরা শান্তিপূর্ণভাবে বসি', যোগ করেন তিনি।
ইসলামাবাদে উত্তেজনা
বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, সব বাধা উপেক্ষা করে দাবি আদায়ে পিটিআই নেতা-কর্মীরা ইসলামাবাদ শহরের কেন্দ্রস্থল ডি-চক এলাকায় পৌঁছানোর পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। বর্তমানে ওই এলাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
পিটিআই নেতারা জানিয়েছেন, বুশরা বিবির কন্টেইনারকে ডি-চকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। সেটিকে ৭ এভিনিউয়ের দিকে পাঠিয়ে দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বর্তমানে ওই এলাকা তাদের নিয়ন্ত্রণে।
এদিকে বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলেও ইসলামাবাদে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। পিটিআই সমর্থকেরা আশপাশের এলাকায় পুনরায় সংগঠিত হচ্ছে।
শেষ পর্যন্ত লড়াই করুন: ইমরান খান
কারাবন্দী ইমরান খান এক এক্স বার্তায় ইমরান খান নেতা-কর্মীদের শান্ত ও ঐক্যবদ্ধ থাকার অনুরোধ জানিয়েছেন। সেইসঙ্গে 'দাবি আদায়ে শেষ পর্যন্ত নিজেদের অবস্থানে অটল' থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।
এক্সে তিনি লিখেছেন, "আমার দলের প্রতি আমার বার্তা হলো শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাওয়া, আমরা পিছপা হবো না।"
তিনি আরও লিখেন, "যারা সামরিক আদালতে বিচারের হুমকি দিচ্ছেন, তাদের জন্য আমার একটি বার্তা হলো- যা করার করুন, আমি আমার অবস্থান থেকে পিছপা হব না।"
তিনি নেতা-কর্মীরা যারা এখনও ডি-চকে পৌঁছাননি, তাদের দ্রুত সেখানে পৌঁছানোর অনুরোধ জানান।
তিনি বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহসিন নাকভির নির্দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালিয়ে কয়েকজনকে হত্যা ও আহত করেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে এ কাজের জন্য জবাবদিহি করতে হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানে হামলা
ঘটনাস্থল থেকে প্রত্যক্ষদর্শী বেশ কয়েকজন সাংবাদিক জানিয়েছেন, বিক্ষোভকারীরা কয়েকটি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানেও হামলা চালিয়েছেন। তবে পিটিআই এ ঘটনাকে 'দুঃখজনক' উল্লেখ করে দাবি করেছে যে তাদের কেউ এ হামলায় জড়িত নয়।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সেনাবাহিনী মোতায়েন
এদিকে বিক্ষোভ-সংঘাতে অবরুদ্ধ ইসলামাবাদে, পাকিস্তানের সংবিধানের ২৪৫ ধারায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। সূত্র মোতাবেক জানা গেছে, পরিস্থিতি বুঝে 'দেখামাত্র গুলি' বা 'শুট অ্যাট সাইট'-এর ক্ষমতা দেয়া হয়েছে সেনাবাহিনীকে। ক্ষমতাসীন শেহবাজ শরিফের সরকার পিটিআই-এর এই আন্দোলনকে অবৈধ বলে অভিহিত করেছে।
তবে পিটিআই চেয়ারম্যান গহর আলী খান সরকারের প্রতি বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি না চালানোর আহ্বান জানিয়েছেন।
এর আগে বুশরা বিবির নেতৃত্বে রোববার (২৪ নভেম্বর) থেকে শুরু হয়েছে ইমরান সমর্থকদের আন্দোলন। গোটা দেশ থেকে ইসলামাবাদের উদ্দেশে রওনা দেন দলীয় সমর্থকরা।
ইসলামাবাদের উপকণ্ঠে জড়ো হন হাজারো বিক্ষোভকারী। বিক্ষোভ ঠেকাতে একদিন আগে থেকেই ইসলামাবাদের সব প্রবেশপথ বন্ধ করে দেওয়া হয়। দুইমাসের জন্য ইসলামাবাদে জারি করা হয়েছে ১৪৪ ধারা।
নিরাপত্তা বাহিনী বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে স্টান গ্রেনেড এবং টিয়ার গ্যাস ব্যবহার করছে। কিন্তু বিশাল এই বিক্ষোভকারীদের দমিয়ে রাখা কার্যত কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংঘর্ষ এবং ব্লকেডের মধ্যেও পিটিআই সমর্থকেরা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ইসলামাবাদে প্রবেশ করেছেন। সেখান থেকে পিটিআই'র প্রতিবাদী দল ডি-চকে পৌঁছায়। সরকারের সঙ্গে বিরোধী দলের আলোচনা অচলাবস্থায় পৌঁছেছে।
এদিকে, বিক্ষোভ ঠেকাতে ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে পিটিআইয়ের পাঁচ পার্লামেন্ট সদস্যসহ প্রায় চার হাজার নেতা-কর্মীকে। ইসলামাবাদের বেশিরভাগ প্রধান সড়ক শিপিং কনটেইনার দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
সংঘাতপূর্ণ বিভিন্ন এলাকায় বন্ধ করা হয়েছে ইন্টারনেট ও মোবাইল পরিষেবা। বাতিল হয়েছে ইসলামাবাদ বিমানবন্দরের বেশ কয়েকটি ফ্লাইট।
নিরাপত্তা–সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শ্রীনগর মহাসড়কে কিছু দুষ্কৃতকারী কিছু দুর্বৃত্ত নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের ওপর গাড়ি চালিয়ে দিয়ে হামলা চালিয়েছে, যার ফলে চারজন রেঞ্জার্স সদস্য নিহত এবং আরও পাঁচজন রেঞ্জার্স সদস্য ও দুই পুলিশ কর্মকর্তা আহত হয়েছেন। এছাড়া আহত হয়েছে শতাধিক পুলিশ কর্মকর্তা, তাদের বেশিরভাগের অবস্থাই আশঙ্কাজনক।
প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ আজ মঙ্গলবার (২৬ নভেম্বর) শ্রীনগর মহাসড়কে রেঞ্জার্স ও পুলিশ সদস্যদের ওপর গাড়ি চালিয়ে হামলার ঘটনায় প্রতিবাদ জানিয়ে, এই ঘটনার সাথে জড়িতদের দ্রুত চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার নির্দেশ দেন।
প্রধানমন্ত্রী আহত রেঞ্জার্স ও পুলিশ সদস্যদের জন্য সর্বোচ্চ চিকিৎসা সেবা প্রদান করারও নির্দেশ দেন।
তিনি বলেন, শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের ছদ্মবেশে পুলিশ ও রেঞ্জার্সের ওপর হামলা নিন্দনীয়। পুলিশ এবং রেঞ্জার্সকে শহরে আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
শেহবাজ বলেন, 'অরাজকতাকারী গোষ্ঠী রক্তক্ষয় চায়, এটা কোনো শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ নয়, বরং একধরনের চরমপন্থা।'
প্রধানমন্ত্রী বলেন, পাকিস্তান কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা বা রক্তপাত সহ্য করতে পারে না। রাজনৈতিক স্বার্থে রক্তপাত গ্রহণযোগ্য নয় এবং এটি অত্যন্ত নিন্দনীয়।
পিটিআই নেতাদের সঙ্গে সরকারের আলোচনা চললেও, পিটিআই জানিয়েছে যে তারা ইসলামাবাদে অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাবে যতক্ষণ না তাদের নেতা ইমরান খান মুক্তি পান। আলোচনা চলার মধ্যে, ফেডারেল সরকার পিটিআইকে প্যারেড গ্রাউন্ড অথবা পেশাওয়ার মোড়ে বসার অনুমতি দিয়েছে, তবে নেতৃবৃন্দ স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন যে তারা ইসলামাবাদে যাওয়ার সিদ্ধান্ত বদলাবেন না।
ইসলামাবাদের রেড জোনে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহসিন নকভি বলেন, 'বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালানো সরকারের জন্য খুব সহজ, কিন্তু আমরা ধৈর্য ধরব।'
এক সংক্ষিপ্ত মধ্যরাতের সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, 'গতকাল যেমন বলেছি, আজও বলছি: ক্ষয়ক্ষতির জন্য দায়ী তারাই, যারা এই কর্মসূচি ডেকেছে।'
রাস্তা বন্ধ থাকার কারণে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে, নকভি দায় চাপান পিটিআই কর্মীদের ওপর। তিনি বলেন, 'এই প্রশ্ন তাদের করতে হবে, যারা এই স্থানে হামলা চালাচ্ছে, আর আমরা আমাদের মানুষদের সুরক্ষিত রাখছি।'
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ইমরান খানের দল যেন সরকারকে চরম পদক্ষেপ নিতে বাধ্য না করে।
তিনি বলেন, 'তারা যেন এমন সীমা অতিক্রম না করে, যা আমাদের চূড়ান্ত পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করে। প্রয়োজনে আমরা ২৪৫ ধারা প্রয়োগ করব, শহরে কারফিউ জারি করব, অথবা অন্য কোনো কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করব।'
