স্বল্প আমদানির ধাক্কায় কমেছে শুল্ক আদায়
ডলার সংকট কাটাতে আমদানি নিরুৎসাহিত করার ধাক্কা এসেছে আমদানি পর্যায়ের শুল্ক আদায়ে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে গতবারের তুলনায় শুল্ক আদায় কমেছে।
এছাড়া বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য কিছুটা কমে আসাও এর পেছনে অন্যতম কারণ।
দেশের ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমদানি কমে যাওয়ায় রাজস্ব কমার পাশাপাশি তা দেশের শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থানেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
ন্যাশনাল বোর্ড অব রেভিনিউ'র (এনবিআর) হিসাব অনুযায়ী, গত জানুয়ারি মাসে আমদানি শুল্ক আদায় আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় কমেছে ০.৫৩ শতাংশ। অথচ গত বছরের একই সময়ের এই প্রবৃদ্ধি ছিলো প্রায় ২৩ শতাংশ।
বিশ্ববাজারে আমদানি পণ্যের দাম বাড়া সত্বেও চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত প্রথম সাত মাসে আমদানি শুল্ক আদায়ে গ্রোথ ৮ শতাংশেরও কম, যা গত অর্থবছরের একইসময়ে ছিল ২২ শতাংশের বেশি।
বাংলাদেশের শীর্ষ বাণিজ্য সংস্থা ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমদানি শুল্ক আদায় কমার মূল কারণ ডলার সংকটের জন্য আমদানি কমে যাওয়া। সরকার রিজার্ভকে স্ট্যাবল রাখতে গিয়ে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করেছে। ব্যাংকগুলো ডলার দিতে পারছে না, যার কারণে এই পরিস্থিতি।"
তিনি আরো বলেন, "এর ফলে শিল্পায়ন ব্যহত হবে ও তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কর্মসংস্থানের উপর। আমি নিজেও একটি কারখানার উৎপাদন ৬০ শতাংশ কমাতে বাধ্য হয়েছি। কিছু কর্মীও ছাঁটাই করতে হয়েছে।"
এনবিআরের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, শুল্ক আদায়ের পাশাপাশি জানুয়ারি মাসে ইনকাম ট্যাক্স আদায়েও প্রত্যাশিত গতি নেই। এ খাতে গ্রোথ ৩ শতাংশেরও কম।
উল্লেখ্য কারণে আলোচ্য সময়ে রাজস্ব আদায়ে গ্রোথ ৫ শতাংশেরও কম। এ সময়ে ৩১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছে ২৬ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা।
অথচ গত অর্থবছরের জানুয়ারি মাসে গ্রোথ ছিলো ১৮ শতাংশ।
চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় রাজস্ব আদায় কম হয়েছে ১৭ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিলো প্রায় ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা।
গত ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষিতে দেশে ডলার সংকট দেখা দিলে সরকার আমদানি নিরুৎসাহিত করতে বেশকিছু পদক্ষেপ নেয়। যারমধ্যে গত বছরের মে মাসে আমদানি নিয়ন্ত্রণে চার খাতের বিলাসজাত পণ্য আমদানির রেগুলেটরি ডিউটি বাড়িয়ে দেওয়া হয়।
তার এক মাস আগে, এপ্রিলে এলসি'র নগদ মার্জিন প্রাথমিকভাবে ২৫%-নির্ধারণ করা হয়। পরবর্তীতে ২৭টি পণ্যের জন্য পর্যায়ক্রমে এই মার্জিন ১০০% নির্ধারণ করা হয়। এছাড়া দেশের ব্যাংকগুলোকে ৩ মিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যের এলসির জন্য অগ্রিমভাবে অবহিত করার নির্দেশ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলার হার কমেছে ২৫ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যে দেখা যায়, জুলাই থেকে জানুয়ারি মাসে পেট্রোলিয়াম ছাড়া মূলধনী যন্ত্রপাতি, ভোগ্যপণ্য, ইন্টারমিডিয়েট পণ্য এবং শিল্পের কাঁচামাল আমদানি উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে মূলধনী যন্ত্রপাতির জন্য এলসি খোলা হয় ১.৪১ বিলিয়ন ডলারের, যা গত বছরের একই সময়ের মধ্যে ছিল ৪.২৫ বিলিয়ন ডলার।
এছাড়া, ২০২৩ অর্থবছরের সাত মাসে ভোক্তা ও মধ্যবর্তী পণ্যের আমদানি যথাক্রমে ১৮.২২% এবং ৩৩.৩০% কমেছে। এই দুই খাতে আমদানি হয়েছে ৪.৭ বিলিয়ন ডলার এবং ৩ বিলিয়ন ডলার।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের মাধ্যমে শীর্ষ ২০টি পণ্যের আমদানি গত বছরের তুলনায় এ বছরের জানুয়ারিতে কমেছে ৩১.৮৮ শতাংশ। এর ফলে ৬৩৭.৬৩ কোটি টাকা কম রাজস্ব আয় হয়েছে এবার। প্রায় ৯০ শতাংশ শুল্ক সংগ্রহ হয় এ পণ্যগুলোর মাধ্যমে।
চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমদানি কমার পাশাপাশি বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমে গত কয়েক মাস ধরে আমদানি শুল্ক আদায় কমতির দিকে রয়েছে। জানুয়ারিতেও তা নেগেটিভ ছিলো।"
অবশ্য আগামী মাসগুলোতে আমদানি স্বাভাবিক হবে এবং কিছু আমদানি পণ্যের মূল্য বাড়তে থাকায় ফের কাস্টমস ডিউটি আদায় বাড়বে বলে আশা করেন তিনি।
এদিকে রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে গত রোববার (২৬ ফেব্রুয়ারি) মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে দিনভর সভা করেছেন এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনীম।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সভায় রাজস্ব আদায়ে প্রত্যাশিত গতি না আসায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন তিনি।
সভায় উপস্থিত একজন কমিশনার নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমদানি কমে যাওয়া, বিশেষত কমার্শিয়াল পণ্যের আমদানি কমায় কাস্টমস থেকে রাজস্ব আদায় কমছে বলে জানানো হয়েছে।"
মনিটরিং জোরদার করা, বাড়তি জোর দেওয়া ও বকেয়া আদায় বাড়াতে মনোযোগী হতে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন এনবিআর চেয়ারম্যান।