জানুয়ারিতে দেশে ব্যাংক আমানত বেড়েছে ৬.১৪%
চলতি বছরের জানুয়ারিতে দেশের ব্যাংকিং খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি বেড়ে ৬.১৪ শতাংশ হয়েছে; এর আগের মাসে, অর্থাৎ গত বছরের ডিসেম্বরে যা ছিল ৫.৪৪ শতাংশ।
একই সময়ে ঋণদান বেড়েছে ৭ বেসিস পয়েন্ট। ফলে জানুয়ারিতে ঋণের ইয়ার-অন-ইয়ার গ্রোথ বা বার্ষিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৩.৮৯ শতাংশ। গেল ডিসেম্বরে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ১৩.৮২ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত একবছরে ব্যাংক খাতে আমানত বেড়েছে ৮৬,০০০ কোটি টাকা। সেখানে একই সময়ে ঋণ বেড়েছে ১.৭২ লাখ কোটি টাকা। অর্থাৎ, ব্যাংক খাতে ঋণ যে হারে বেড়েছে, সে হারে আমানত বাড়েনি।
মাসভিত্তিক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, জানুয়ারি মাসে ব্যাংকগুলো আমানতের তুলনায় বেশি টাকা ঋণ দিয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আমানত ও ঋণদানের এ বিষয়টি সতর্কতার সঙ্গে পরিচালনা না করলে দেশে সম্ভাব্য তারল্য সংকট দেখা দিতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য দেখায়, দেশের ব্যাংক খাতে গত জানুয়ারি মাসে ডিপোজিট বা আমানত কমেছে ১,৩৯৮ কোটি টাকা। ডিসেম্বরের ১৪.৮৯ লাখ কোটি টাকা থেকে কমে জানুয়ারির শেষে ডিপোজিট দাঁড়িয়েছে ১৪.৮৮ কোটি টাকা।
ডিপোজিট কমলেও ধার দেওয়া বাড়িয়েছে ব্যাংকগুলো। জানুয়ারি শেষে আগের মাসের তুলনায় ঋণ ৮,৪৫১ কোটি টাকা বেড়ে ১৭.৬৭ লাখ কোটি টাকায় পৌঁছেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, ডিসেম্বরে ব্যাংকব্যবস্থায় ডিপোজিট ২,২৮১ কোটি টাকা বেড়েছিল। আর ঋণ বেড়েছিল ২২,৯৩০ কোটি টাকা। অর্থাৎ, গত দুইমাসে মাসে ব্যাংক খাতে আমানতের তুলনায় ঋণের প্রবৃদ্ধি বেশি হয়েছে; ফলে অনেক ব্যাংকেরই তারল্য সংকটে পড়ার কথা। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রেপোসহ বিভিন্ন টুল ব্যবহার করে মানি মার্কেটে টাকা ছাড়ায় আপাতত এই সংকট কিছুটা কম।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঋণ বাড়ার বিপরীতে আমানত যখন কমে, তখন সেটি মানি মার্কেটের এক্সেস লিকুইডিটিকে কমিয়ে দেবে এটিই স্বাভাবিক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, আগের মাসের তুলনায় জানুয়ারিতে ব্যাংকিং খাতে এক্সেস লিকুইডিটি ৮,১২৮ কোটি টাকা কমে ১.৩৮ লাখ কোটি টাকা হয়েছে।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮.৭৮ শতাংশ। তবে ভোক্তার আয় না বাড়ায় নতুন সঞ্চয় কমে গেছে। অনেকে পুরনো সঞ্চয় ভেঙে খরচ করছেন। ব্যাংকিং চ্যানেলে আমানত কমার এটি একটি অন্যতম কারণ বলে মনে করেছেন অর্থনীতিবিদরা।
অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান সেলিম আরএফ হুসাইন এ ধারণার সঙ্গে একমত পোষণ করে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, মূলত মূল্যস্ফীতির কারণেই আমানত কমেছে। বিশেষ করে, যারা চাকুরিজীবী বা যাদের আয় নির্দিষ্ট, তারা এর ভুক্তভোগী হচ্ছে বেশি।
জানুয়ারিতে আমানতের ওপর সুদের হার বাড়িয়েছে বেশিরভাগ ব্যাংক
গত জানুয়ারি মাসে আমানতের ওপর সুদহার বাড়িয়েছে দেশের অধিকাংশ ব্যাংক। ঋণের সুদহার বাড়লেও সেটি আমানতের তুলনায় কম। ফলে ব্যাংকগুলোর ইন্টারেস্ট ইনকাম ডিসেম্বরের তুলনায় জানুয়ারিতে কমেছে।
জানুয়ারিতে বেসরকারি খাতের সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স আমানতের (টাইম ডিপোজিট) ওপর ৮ শতাংশ সুদ দিয়েছে, ডিসেম্বরে যা ছিল সাড়ে ৭ শতাংশ। এক্সিম ব্যাংক জানুয়ারিতে মুনাফার হার ৭ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ এবং আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক ৫.৭৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৬.২৫ শতাংশ করেছে। এবি ব্যাংক টাইম ডিপোজিটে সুদহার ৬.৭৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭.২৫ শতাংশ দিচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারিতে ব্যাংকগুলোর আমানতের ওপর গড় সুদহার ডিসেম্বরের ৪.২৩ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪.২৯ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। আগের বছরের জানুয়ারিতে এই হার ছিল ৪.০১ শতাংশ। এদিকে, ঋণের গড় সুদহার ডিসেম্বরের তুলনায় ২ বেসিস পয়েন্ট বেড়ে ৭.২৪ শতাংশ হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে ব্যাংকিং খাতের ইন্টারেস্ট ইনকাম সুদ আয়ের ওপর। ডিসেম্বরের ২.৯৯ শতাংশ থেকে কমে জানুয়ারিতে ব্যাংকের এই আয় কমে ২.৯৫ শতাংশ হয়েছে।
সাধারণত, আমানতের ওপর সুদহার বাড়ালে আমানতের পরিমাণও বাড়ে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, দেশে জানুয়ারিতে আমানতের পরিমাণ কমেছে।
গত ১৫ জানুয়ারি ৬ শতাংশে বেঁধে দেওয়া ডিপোজিট ইন্টারেস্ট রেটের সীমা তুলে দেওয়াসহ ভোক্তা ঋণে সুদহার ৩ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর সুযোগ করে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মূলত এরপরই ডিপোজিট বাড়ানোর লক্ষ্যে সুদহার বাড়ায় ব্যাংক।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হুসেন বলেন, "মুদ্রাস্ফীতির তুলনায় মানুষের আয়ের প্রবৃদ্ধি কম। রিয়াল ইনকাম কমে গেছে, খরচ বেড়েছে; ফলে সঞ্চয় কমছে।"
"আর সঞ্চয় কমলে সুদহার বাড়ালেও ডিপোজিট বাড়বে না। তবে ঋণে বেশ ভালো গ্রোথ দেখা যাচ্ছে। এখানে একটা অমিল হচ্ছে। আমাদের এ পর্যায়ে ল্যান্ডিং রেটটাকে ফ্ল্যাক্সিবল করার পাশাপাশি ব্যাংক খাতের অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে," যোগ করেন তিনি।