চলতি বছরে ১৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের অনুমতি চেয়েছে ৫৭ বহুজাতিক কোম্পানি
ভারতের অন্যতম শীর্ষ একটি কেমিকেল কোম্পানি ইন্দোকেম বাংলাদেশে ১,৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)-র থেকে বিনিয়োগের অনুমোদন পেয়ে ঢাকায় একটি ক্যাম্প অফিস-ও খুলেছে।
এখন কোম্পানিটি বাংলাদেশে শাখা খোলার জন্য যৌথমূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর (আরজেএসসি)-তে আবেদন করেছে। তারা কারাখানা স্থাপনের জন্য একটি বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলে জমিও বরাদ্দ চেয়েছে।
ইন্দোকেম ছাড়াও আরো ৫৬টি ছোট, বড় আরো ৫৬টি বহুজাতিক কোম্পানি (এমএনসি) বাংলাদেশে বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী আমদানি, স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন করে স্থানীয় বাজারে বিপণন এবং রপ্তানির জন্য শাখা খোলার অনুমোদন চেয়ে আরজেএসসি-তে আবেদন করেছে।
এই আবেদনগুলো প্রক্রিয়াধীন বলে জানিয়েছে আরজেএসসি-র একটি সুত্র।
আরজেএসসি এবং বিডার সূত্র জানিয়েছে, এসব প্রতিষ্ঠান প্রায় ১৫,০০০ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করবে। তাদের স্থানীয় কার্যক্রম শুরু হলে প্রায় ৩০ হাজার নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবে।
চলতি বছরেই এসব প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয় অনুমোদন সম্পন্ন হলে, আগামী বছর নাগাদ কোম্পানিগুলো ব্যবসা পরিচালনা এবং উৎপাদন কাজ পরিচলনা করতে পারবে বলে জানিয়েছে বিডা।
যৌথমূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তরের নিবন্ধক (অতিরিক্ত সচিব) শেখ শোয়েবুল আলম এনডিসি
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিদেশি কোম্পানি গত তিন মাসে নিবন্ধনের জন্য আরজেএসসি-তে আবেদন করেছে। এবছরের জানুয়ারি থেকে ১০ মার্চ পর্যন্ত এসব আবেদন জমা পড়েছে। এত অল্প সময়ে এত বেশি কোম্পানির আবেদনের ঘটনা এর আগের বছরগুলো হয়নি।"
আগ্রহী কোম্পানির সংখ্যা বাড়ার বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, "বাংলাদেশ এখন বিনিয়োগের হাব হিসেবে বিশ্বের কাছে পরিচিতি পেয়েছে। বিশেষ করে, সরকারের ১০ টি অর্থনৈতিক অঞ্চল বাস্তবায়নের পরিকল্পনা এরকম বিনিয়োগকে আরো হাতছানি দিচ্ছে। এর পাশাপাশি বাংলাদেশে কম খরচে জনবল পাওয়া এবং অনেক ধরনের পণ্যের বাজার থাকায় বিদেশি কোম্পানিগুলো বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছে।"
এই ৫৬টি কোম্পানির মধ্যে ৯টি কোম্পানির বাংলাদেশে অনুমোদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করাতে সহায়তা করছে একটি স্বনামধন্য ল' ফার্ম কাজ করছে। ফার্মটির কর্ণধার জানান, এই কোম্পানিগুলো সরকারের কাছে দরকারি সব ধরনের অনুমোদন পেলে – এবছর বাংলাদেশের জন্য সর্বোচ্চ বিদেশি বিনিয়োগ পাওয়ার বছরে পরিণত হতে পারে।
আরজেএসসি-র সূত্রমতে, গত ফেব্রুয়ারি মাসের হিসাব অনুসারে ২ লাখ ৭৯ হাজার ১৬৭টি পাবলিক, প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি, বিদেশি কোম্পানি, অংশীদারত্বমূলক প্রতিষ্ঠান এবং এক ব্যক্তি মালিকানাধীন কোম্পানি রয়েছে। এরমধ্যে বিদেশি কম্পানি রয়েছে ১,০৫১টি।
বিডার তথ্যমতে, "২০২১ সালে দেশে প্রায় ১১ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকার এবং ২০২২ সালে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার নতুন বিদেশি বিনিয়োগ আসে। আর বাংলাদেশে ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২২ সালে নতুন ও পুরাতন বিদেশি কোম্পানিগুলো প্রায় ৩৫০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে।
বেলজিয়াম-ভিত্তিক বহুজাতিক কোম্পানি 'আজেলিস' ওষুধ, খাদ্য, কৃষি, টেক্সটাইলের জন্য রাসায়নিক এবং ব্যক্তিগত পরিচর্যা (প্রসাধনী) ও লাইফ সায়েন্স পণ্যের কাঁচামাল সরবরাহকারী বিশ্বের অন্যতম প্রধান বহুজাতিক কোম্পানি। বাংলাদেশে বড় বিনিয়োগ নিয়ে কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছে তারা।
একটি সূত্রের মতে, এদেশে কোম্পানিটি প্রায় ১,২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে।
আজেলিস-ইন্ডিয়া'র ব্যবস্থাপনা পরিচালক অপর্না খুরানা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আজেলিস বাংলাদেশের বাজারে নেতৃত্ব দেওয়ার পরিকল্পনা করছে।" বিনিয়োগের অঙ্ক প্রকাশ না করলেও তিনি ইঙ্গিত দেন যে, বাংলাদেশে এইখাতে অন্যান্য কোম্পানির করা বিনিয়োগের চেয়ে সেটা উচ্চই হবে।
আরজেএসসি'র সূত্রগুলো জানায়, বেলজিয়াম-ভিত্তিক বহুজাতিক কোম্পানিটির আবেদন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
জাপান ভিত্তিক মোটর টায়ার উৎপাদনকারী 'ব্রিজস্টোন কর্পোরেশন' বাংলাদেশে টায়ার উৎপাদন করে স্থানীয় বাজার এবং বিভিন্ন দেশে রপ্তানির লক্ষ্যে কারখানা করার জন্য এরমধ্যেই বিডার অনুমোদন পেয়েছে।
আরজেএসসি সূত্র জানায়, কোম্পানিটি বাংলাদেশে অনুমোদনের জন্য আবেদন করেছে। সেটি এখন প্রক্রিয়াধীন। আগামী মে/জুন মাস নাগাদ তারা অনুমোদন চূড়ান্ত অনুমোদন পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ব্রিজস্টোনের একজন বাংলাদেশি কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, বিডার কাছে প্রস্তাব দেয়ার পর সেটি গৃহীত হয়েছে। আমাদের কোম্পানি প্রাথমিকভাবে প্রায় ২,০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে।
নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার এলাকায় বাংলাদেশ স্পেশাল ইকোনমিক জোনে জমি বরাদ্দ চেয়েছে ব্রিজস্টোন।
আরজেএসসির অনুমোদনের পর কারখানা গড়ে তোলার জন্য বিদেশি কোম্পানিগুলোকে আরো প্রায় ১৭টি বিভিন্ন ধরনের অনুমোদন নিতে হয়। এসব অনুমোদন প্রক্রিয়ায় কোম্পানিগুলোকে সহায়তা সেবা দিচ্ছে বিডার ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টার।
কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক চীনা কোম্পানি সিনোভ্যাক বাংলাদেশে প্লাজমা-ডিরাইভড মেডিকেল প্রোডাক্টস (পিডিএমপি) উৎপাদন শুরু করতে যাচ্ছে।
সিনোভ্যাক বায়োটেক (বাংলাদেশ) লিমিটেডের একজন কর্মকর্তা টিবিএসকে জানান, তারাও আরজেএসসির অনুমোদন পাওয়ার অপেক্ষা করছেন।
সিনোভ্যাক বায়োটেক (বাংলাদেশ) লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক কেভিন ঝাং, টিবিএসকে বলেন, "প্লাজমা-ভিত্তিক ওষুধ উৎপাদনের জন্য বাংলাদেশ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যযুক্ত দেশগুলির মধ্যে একটি। বাংলাদেশে আসার আগে আমরা ইতোমধ্যে দক্ষিণ আমেরিকা, চিলি, কলম্বিয়া এবং তুরস্কে কিছু শাখা স্থাপন করেছি। আমরা বিভিন্ন দেশে আরও শাখা স্থাপনের পরিকল্পনা করছি।"
বর্তমানে, বাংলাদেশ অন্যান্য নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশের মতো প্লাজমা-ভিত্তিক পণ্যের ১০০ শতাংশই আমদানি করে, যার জন্য প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন হয়।
বাংলাদেশ-জার্মান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (বিজিসিসিআই) এর সভাপতি ব্যারিস্টার ওমর সাদাত বলেন, প্রতিনিয়ত বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাচ্ছে বাংলাদেশে। তবে কোম্পানির কার্যক্রম পরিচালনার অনুমোদনের জন্য যে জটিলতাগুলো আছে সেগুলো সমাধান করা দরকার।
তিনি উল্লেখ করেন, "সরকার চাইছে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে। কিন্তু, কিছু আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে অনেক বিদেশি কম্পানি বিনিয়োগ করতে চেয়েও অনেক সময় ফিরে যাচ্ছে।"
বিডা সুত্র জানায়, আলোচিত ৫৬ কোম্পানির মধ্যে ২০টি বিভিন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ করবে। আর বাকীরা ঢাকা ও চট্টগ্রামের পার্শ্ববর্তী এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যবসা পরিচালনা ও উৎপাদন কারখানা করবে।
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, বাংলাদেশে বহুজাতিক ও বিদেশি কোম্পানিগুলোকে বিনিয়োগে আকৃষ্ট করার জন্য সরকারের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
তিনি বলেন, "বাংলাদেশে ব্যবসা পরিচালনা ও উৎপাদন করার জন্য বিদেশি কোম্পানিগুলোকে সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহায়তা দেওয়া হবে। এতে সরকার যেমন বিপুল রাজস্ব আয়ের পাশাপাশি বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।"