উত্তরের ১৬ জেলায় ৪৩০ কোটি টাকার সেমাই উৎপাদন, মধ্যপ্রাচ্যে রপ্তানির সম্ভাবনা
ছোট পরিসরে হলেও উত্তরের জেলা বগুড়ায় তৈরি লাচ্ছা সেমাই দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ইতিমধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে পা রেখেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, অচিরেই বগুড়ার লাচ্ছা সেমাই মধ্যপ্রাচ্যে বড় বাজার দখল করবে।
পানি, ময়দা আর ডালডার মিশ্রণে তৈরি রোল থেকে প্যাচের পর প্যাচ দিয়ে কয়েকধাপে রূপ নেয় লাচ্ছা। মূলত মৌসুমী সেমাই ব্যবসার কর্মযজ্ঞ শুরু হয় রোজার ১৫ দিন আগে থেকে। এরপর থেকে চলে বড় আকারে কর্মযজ্ঞ। বগুড়ায় সেমাই প্রস্তুতের সঙ্গে মূলত বেকারি ব্যবসায়ীরাই জড়িত। তাদের সংগঠনের নাম বাংলাদেশ ব্রেড বিস্কিট এন্ড কনফেকশনারী দ্রব্য প্রস্তুতকারক সমিতি উত্তরবঙ্গ পরিষদ।
এ সংগঠনের তথ্যমতে, জেলায় এবারের ঈদ বাজারে অন্তত ১৫০ কারখানা লাচ্ছা সেমাই প্রস্তুত করছে। তবে সমগ্র উত্তরবঙ্গ মিলে এই সংখ্যা ২০০ ছাড়িয়ে গেছে। প্রতি কারখানায় গড়ে দুটি করে মোট ৪০০ চুলায় লাচ্ছা সেমাই উৎপাদন হচ্ছে। কারখানাপ্রতি দৈনিক ১২ বস্তা ময়দার সেমাই তৈরি হয়।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, ৪৫ দিনের ঈদ বাজারে গড়ে ২৫ হাজার ২০০ টনের বেশি লাচ্ছা সেমাই উৎপাদন হয়। এর মধ্যে নন-ব্র্যান্ড সেমাই হয় প্রায় ১৯০ কোটি টাকার। আর ব্র্যান্ডের সেমাই উৎপাদন হয় ২৪০ কোটি টাকার উপরে। অর্থাৎ মোট ৪৩০ কোটি টাকার সেমাই উৎপাদিত হয় উত্তরের ১৬ জেলায়। এসব সেমাই উত্তরাঞ্চলের পাশাপাশি ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল, সিলেটসহ দেশের সব জেলায় চলে যায়। লাচ্ছা সেমাই মূলত সয়াবিন, ডালডা ও ঘিয়ে ভেজে তৈরি করা হয়।
জেলায় ব্র্যান্ডেড (মোড়কজাত) কারখানা ৮ থেকে ১০টি। বাকিগুলো নন-ব্র্যান্ড (খোলা বা বাঁশের খাচিতে)। এসব নন-ব্র্যান্ড কারখানার অধিকাংশই মৌসুমী ব্যবসায়ী। শুধু ব্যবসায়ীরাই নয়, বেশিরভাগ কারিগরেরা ঈদ মৌসুমে সেমাই তৈরি করেন। বাকি সময় অন্য পেশায় নিয়োজিত থাকেন তারা।
বগুড়ার প্রসিদ্ধ প্রতিষ্ঠানের অন্যতম আকবরিয়া গ্রুপের চেয়ারম্যান হাসান আলী আলাল জানান, তার বাপ-দাদার পূর্বপুরুষেরা কলকাতার বাসিন্দা ছিলেন। শত বছর আগে বগুড়ায় আসেন তারা। ওই সময় থেকেই অন্যান্য খাবারের পাশাপাশি সেমাই তৈরি করেন। সময়ের ব্যবধানে সেমাই উৎপাদনে বগুড়ার বিখ্যাত দইয়ের মতো ব্র্যান্ড তৈরি করেছেন তারা।
আলাল বলেন, বগুড়া থেকে রোজার দেড় মাসে সেমাইয়ের অধিকাংশ উৎপাদন তাদের। বলতে গেলে তিনভাগের এক ভাগ তারা করেন। এই সেমাইয়ের চাহিদা আর সুনাম রয়েছে দেশব্যাপী। তবে সৌদি আরব, কাতার, ইয়েমেনে আকবরিয়ার লাচ্ছা সেমাই যাচ্ছে কয়েক বছর ধরে। বাণিজ্যিকভাবে ওসব দেশে বাজার তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে। রপ্তানির ক্ষেত্রে সরকারি বিভিন্ন নীতিমালা শিথিল করা হলে সেমাই থেকেও ব্যাপক পরিমাণ আয় করা সম্ভব।
বগুড়ার আকবরিয়া সেমাইয়ের কারখানায় রোজার মৌসুমে অন্তত দেড় হাজার শ্রমিক কাজ করেন বলে জানান আলাল।
তবে পুরো বগুড়ায় এই কাজের সঙ্গে অন্তত ৬ হাজার শ্রমিক জড়িত। তাদের মধ্যে একজন হলেন বগুড়ার নামুজা ইউনিয়নের রুস্তম আলী। সেমাই তৈরির কারিগর হিসেবে প্রায় ১৫ বছর ধরে কাজ করছেন রুস্তম। আগে শহরের চেলোপাড়ায় কাজ করলেও গত তিন বছর ধরে খাজা কনফেকশনারিতে কাজ করছেন এই কারিগর।
রুস্তম বলেন, 'শুনেছি স্বাধীনতার আগে বগুড়ায় সেমাই তৈরিতে বিহারিদের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। বগুড়ার কারিগরেরা মূলত শহরের কলোনী এলাকায় তাদের কাছ থেকেই শিখেছেন।'
এই কারিগর আরও বলেন, প্রত্যেক কারখানায় ৮ থেকে ১২ জনের দল তৈরি করে কাজ করা হয়। তাদের মধ্যে কেউ খামির তৈরি করেন। কেউ সেমাইয়ের চাকা বানায়। কেউবা সেই চাকা নিয়ে তেলে ভাজেন। বাকি কয়েকজন সেমাই খাচিতে তোলেন অথবা প্যাকেট করেন।
প্রতিটি দল প্রতিদিন প্রায় ১২ বস্তা আটা-ময়দার সেমাই প্রস্তুত করতে পারে বলে জানান কারিগরেরা। তবে এই কাজ বছরের সব সময় থাকে না। কেউ কেউ শুধু রোজার মৌসুমেই সেমাই তৈরি করে থাকেন। তাদের মধ্যে একজন হলেন শহরের গোয়ালগাড়ী এলাকার আনোয়ার হোসেন।
আনোয়ার হোসেন জানান, উত্তরবঙ্গের মধ্যে বগুড়ার মতো সেমাই আর কোথাও তৈরি হয় না। এই কারণে এখানে কারিগরের সংখ্যাও অনেক। এখানে কাজের মানও ভালো। এক মাসে অন্তত ৩০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা আয় করা যায়। এ সময় আমাদের চাহিদা বেড়ে যায়।
চাহিদা বাড়ার কারণ অবশ্য জানা গেলো বগুড়ার নতুন উদ্যোক্তা ডা. রোকনুজ্জামান সোহাগের সেমাই কারখানা দেখে। এই চিকিৎসক শুধু রোজার মধ্যে সেমাই তৈরি করেন। গত তিন বছর হলো এই কাজের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন তিনি। নিজ বাসায় গড়ে তোলা কারখানায় ১০ থেকে ১৫ জন মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে শুধু এই মৌসুমে সেমাই উৎপাদনকে কেন্দ্র করেই।
সোহাগ বলেন, 'আমরা বগুড়ায় সেমাই তৈরি করি ঠিকই। কিন্তু এর ক্রেতা ঢাকা কিংবা চট্টগ্রামে বেশি। এই মৌসুমে প্রায় প্রতিদিন অর্ধ লাখ টাকার সেমাইয়ের চাহিদা পাওয়া যায় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো এর মধ্যে আমার এক বন্ধুকে টেস্ট করার জন্য অস্ট্রেলিয়ায় সেমাই পাঠিয়েছিলাম। সে এখন আমার কাছ থেকে কয়েকশ কেজি সেমাই কেনার আগ্রহ দেখিয়েছে। তার (বন্ধুর) ভাষ্য, সেখানে যে পাকিস্তানি সেমাই চলে তার চেয়ে বগুড়ার লাচ্ছা সেমাই হাজারগুণ বেশি স্বাদযুক্ত।'
তবু সংকটে রয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, দেশে হু হু করে কাঁচামালের দাম বেড়েছে। এ কারণে এবার বাড়বে সেমাইয়ের দাম।
খাজা বেকারির লাচ্ছা সেমাইয়ের ব্যবস্থাপক সাব্বির হোসেন জানান, গত বছরের তুলনায় এবার প্রতি কেজি খোলা সেমাইয়ের দাম ২০ টাকা বেড়ে পাইকারি বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকায়। আর প্যাকেটজাত সেমাই বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকায়। অন্যদিকে নন-ব্র্যান্ড লাচ্ছায় ১০ এবং ব্র্যান্ডের লাচ্ছায় বেড়েছে ২০ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত। আর ব্র্যান্ড প্রতি কেজি ঘিয়ে ভাজা লাচ্ছার জন্য এবার ভোক্তাদের গুনতে হবে ৮০০ থেকে ১৫০০ টাকা। ডালডায় ভাজা সেমাই ২০০ থেকে ২৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। আর সয়াবিনে ভাজা লাচ্ছা বিক্রি হচ্ছে ২৪০ টাকা কেজি দরে।
তিনি জানান, গত বছরের তুলনায় এবার প্রতি ১৬ কেজির ডালডার টিনে কমেছে ২৩০ টাকা। একই পরিমাণ পাম অয়েলে ব্যারেলপ্রতি কমেছে ৩ হাজার টাকা। তবে ৭৪ কেজির প্রতি বস্তা ময়দায় ১২০০ টাকা বেড়েছে। শ্রমিক ও বিদ্যুৎ খরচ বাড়ায় দাম কিছুটা বেড়েছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের অজুহাতে দেশে সেমাই তৈরির সব ধরনের কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যয়ের সামঞ্জস্য রাখতে সেমাইয়ের দাম বাড়িয়েছেন। সব কিছুর দাম বাড়ছে। এতে করে বিক্রি হলেও লাভের পরিমাণ কম থাকে। তাই এবার সেমাইয়ের পরিমাণ কমানো হয়েছে।
জেলা বিসিক কার্যালয়ের ডেপুটি মহাব্যবস্থাপক একেএম মাহফুজুর রহমান জানান, এখানে তৈরি সেমাইয়ের মান ভালো হওয়ায় ড্যানিশ, বনফুল বিসিক এরিয়াতে কারখানা স্থাপন করেছে। এ কোম্পানিগুলো স্থানীয় কারিগরদের কাছে থেকে নিয়মিত সেমাই তৈরি করছে।